ল্যামডা ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্ক কী কী জানা গেছে?
গত বছরের আগস্ট মাসে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে সর্বপ্রথম সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের ল্যামডা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কিছু দক্ষিণ আমেরিকান দেশসহ বিশ্বের ২৯টি দেশে ভ্যারিয়েন্টটি ছড়িয়ে পড়েছে। পেরুতে গত মার্চ মাস থেকে মোট কোভিড শনাক্তদের ৮১ শতাংশই ল্যামডা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সম্প্রতি বাংলাদেশেও এ ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের করা জিনোম সিকোয়েন্সিং এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকার ৪৯ বছর বয়সী এক নারীর নমুনার সিকোয়েন্সিং এর মাধ্যমে ল্যামডা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
ল্যামডা ভ্যারিয়েন্ট কী?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ল্যামডা ভ্যারিয়েন্টের মিউটেশনে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে সাতটি পরিবর্তন এসেছে। এরমধ্যে যে স্পাইক প্রোটিন ভাইরাসকে দেহকষের সঙ্গে যুক্ত করে ওই স্পাইক প্রোটিনেও পরিবর্তন এসেছে। এর সংক্রমণে রোগের তীব্রতাও বাড়তে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও জানিয়েছে, বেশ কিছু দেশে সংক্রমণ বৃদ্ধি ও কমিউনিটি সংক্রমণের জন্য দায়ী এ ভ্যারিয়েন্টটি।
গত জুলাইতে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গ্রসম্যান স্কুল অব মেডিসিনের প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ভ্যারিয়েন্টটিতে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তনই এর সংক্রমণ ক্ষমতা বাড়ার কারণ হতে পারে। এ কারণে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাও কিছু অংশে কমে আসতে পারে বলে উল্লেখ করা হয় ওই গবেষণায়।
এই গবেষণার ফলাফল অন্য বিজ্ঞানীরা এখনো পরীক্ষা (পিয়ার রিভিউড) করে দেখেননি। তবে গবেষণাপত্রটি মেডআরএক্সিভ নামের স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
এটি কি অধিক সংক্রামক?
ভ্যারিয়েন্টটির সংক্রমণ ক্ষমতা সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি। ভ্যারিয়েন্টটির L452Q মিউটেশনটি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায়। ফলে অ্যান্টিবডির প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে আসতে পারে এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
তবে এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে বলার জন্য আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন।
ভিওআই হিসেবে তালিকাভুক্ত
এ বছরের ১৪ জুন সি.৩৭ (C.37) বা ল্যামডা ভ্যারিয়েন্টকে ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট (ভিওআই) হিসেবে তালিকাবদ্ধ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির সংজ্ঞায়ন অনুযায়ী, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের যে সব ভ্যারিয়েন্টের মূল ভাইরাসের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বদলে দেওয়া জেনেটিক সক্ষমতা রয়েছে যার ফলে রোগের তীব্রতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় প্রভাব ফেলা, সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্ষমতা ও চিকিৎসায় প্রভাব ফেলার ক্ষমতা তৈরি হয়- সে সব ভ্যারিয়েন্টই ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট।
ভিওআই নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সিডিসি'র দ্বিমত
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ল্যামডা ভ্যারিয়েন্টকে ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট (ভিওআই) হিসেবে তালিকাভুক্ত করলেও এখনো তা মানতে নারাজ যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-সিডিসি।
মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ভ্যারিয়েন্টটির সংক্রমণ এখনো বেশি না হওয়ার কারণেই ভ্যারিয়েন্টটিকে ভিওআই হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়নি বলে জানিয়েছে সিডিসি। অর্থাৎ সিডিসি'র এ তালিকা শুধু দেশটির ভেতরকার সংক্রমণের পরিস্থিতির নির্দেশক।
ল্যামডা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণের উপসর্গ কী কী?
ল্যামডা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে আলাদা হতে পারে এখনও এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি। সিডিসি'র তথ্য অনুযায়ী, জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ক্লান্তি, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, স্বাদ গন্ধ হারানো, বমি, ডায়রিয়া এসব লক্ষনই দেখা যেতে পারে।
তবে যুক্তরাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কর্তৃপক্ষের (এনএইচএস) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে বলা আছে, এসব উপসর্গের মধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে একটানা কাশি দেখা দিতে পারে, ১ ঘণ্টার বেশি সময় ধরেও কাশির প্রকোপ থাকতে পারে। কখনো কখনো ২৪ ঘণ্টায় দুই-তিনবারও এমন একটানা কাশি হওয়ার উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
ভ্যাকসিন কি ল্যামডা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর?
বিস্তারিত গবেষণা না হওয়ায় এখনো কোভিডের ভ্যাকসিনগুলো ল্যামডার বিরুদ্ধে কিরূপ সুরক্ষা দিতে পারে সে ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি। ফাইজার ও মডার্না নিয়ে করা নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির গ্রসম্যান স্কুল অব মেডিসিনের প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ভ্যাকসিন দুটির সৃষ্ট অ্যান্টিবডি প্রতিরোধে কিছুটা সক্রিয় ভূমিকা রাখে ল্যামডা ভ্যারিয়েন্ট। তবে এর ফলে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতায় খুব বেশি তারতম্য আসবে না বলে উল্লেখ করেন গবেষকরা।
তবে, ভ্যারিয়েন্টটি অধিক হারে ছড়িয়ে পড়া দেশ পেরুর গণটিকাদান কর্মসূচিতে ফাইজার বা মডার্নার মতো কোনো এমআরএনএ ভ্যাকসিন ব্যবহার হচ্ছে না। দেশটিতে চীনা ভ্যাকসিন সিনোভ্যাক ও সিনোফার্মের ব্যবহারই বেশি।
ইউনিভার্সিটি অব চিলির প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দুই ডোজ নেওয়া স্বাস্থ্যকর্মীদের দেহেও ল্যামডা ভ্যারিয়েন্টের পরিবর্তিত স্পাইক প্রোটিনের কারণে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার হার হ্রাস পাওয়া ও অ্যান্টিবডির প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে এসেছে। গত ১ জুলাই প্রকাশিত এই গবেষণার ফলাফল অন্য বিজ্ঞানীরা এখনো পরীক্ষা (পিয়ার রিভিউড) করে দেখেননি। তবে গবেষণাপত্রটি মেডআরএক্সিভ নামের স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
তবে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার হার ভ্যাকসিন অনুযায়ী বিভিন্ন। কার্যকারিতার হার কমে এলেও ভ্যাকসিন স্বল্পতার পরিস্থিতিতে কোনো ভ্যাকসিন না নেওয়ার চেয়ে নিজ অঞ্চলে সহজলভ্য ভ্যাকসিনটি গ্রহণ করাই অধিক সুরক্ষা দিতে সক্ষম।
ভাইরাসের অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের মতো এ ভ্যারিয়েন্ট থেকে সুরক্ষা পেতেও মাস্ক পরা, হাত-মুখ পরিষ্কার রাখা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও ভ্যাকসিন নেওয়ার বিকল্প নেই। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত কোনো ভ্যাকসিন শতভাগ সুরক্ষা দেওয়া নিশ্চিত করে না, একারণে সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ নেওয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।