শুঁটকি অভিযানে সমুদ্রে পাঁচ মাস
আগামী ৫ মাস দুবলার চরসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন চরাঞ্চলে গেলে চোখে পড়বে এক অন্যরকম দৃশ্য। সারা বছর নির্জন পড়ে থাকা এসব চর এ সময় জীবন্ত হয়ে উঠবে মানুষের পদচারণায়। দেখা যাবে, একদল দুঃসাহসী মানুষ জীবন হাতে নিয়ে প্রায় অর্ধবছরের জন্য নিবাস স্থাপন করেছে এসব চরাঞ্চলে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ করছে। তারপর সেগুলোকে শুঁটকি করছে।
শুরু হয়েছে সুন্দরবন উপকূলীয় দুবলার চরে শুঁটকি আহরণ মৌসুম। গত মঙ্গলবার সকালে সুন্দরবন বন বিভাগের কাছ থেকে পারমিট নিয়ে সাগরে যাত্রা শুরু করেছেন জেলেরা।
প্রতি বছর শীতের প্রথম দিকে শুঁটকি মৌসুম শুরু হতেই প্রায় পনেরো হাজার জেলে সুন্দরবনের বিভিন্ন চরে অবস্থান নেন। আগামী ৫ মাস ধরে সমুদ্রে মৎস্য আহরণ করবেন তারা। মাছ ধরে চরগুলোতে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত কার্যক্রম চালাবেন।
এই ৫ মাস তাদের জীবন কাটবে অনিশ্চয়তা ও নানা বিপদের মধ্যে। তার সঙ্গে আছে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে মাছ সংগ্রহ করতে না পারার আশঙ্কা। ঋণ করে জালসহ মৎস্য আহরণের সরঞ্জামাদি কিনে মাছ ধরতে যেতে হয় এই জেলেদের। তাই কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে মাছ না পেলে একে তো লোকসান দিতে হবেই, তার ওপরে খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেনায় আকণ্ঠ ডুবে যাবেন।
প্রতিবারের মতো এ বছরও শুঁটকি আহরণে সমুদ্রের বুকে পাড়ি জমিয়েছেন আবু তাহের শেখ। তার জীবনটাই এমন—বছরের ছয় মাস কাটে সমুদ্রে, বাকি ছয় মাস সুন্দরবন উপকূলের জেলেপল্লি আলোরকোলে।
কিন্তু এরপরও অভাব দূর হয়নি তাহেরের জীবন থেকে। গত ৩১ বছর ধরে পরিবারের ভরণপোষণের প্রবল দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়েই সমুদ্র অভিযানে বছরের অর্ধেকটা সময়ের জন্য ঘর ছাড়ছেন তিনি। সামুদ্রিক মাছ আহরণ করে নিয়ে এসে চর পল্লিতে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করে যাচ্ছেন।
তাহেরসহ তার গ্রামের মোট সাড়ে সাতশো জেলে বর্তমানে সাগরে আছেন সামুদ্রিক মাছ আহরণে। মুঠোফোনে তাহের শোনালেন তার কর্মজীবনের আদ্যোপান্ত।
বাড়ি থেকে রওনা হওয়ার পর দিন দুয়েক লাগে চরে পৌঁছাতে। সেখানে ঘর তৈরি ও মাছ ধরার যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে নিতে কেটে যায় আরও চারদিন। জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে জেলেরা চর থেকে দুই-আড়াই ঘণ্টা ট্রলার চালিয়ে সমুদ্রের গভীর থেকে মাছ আহরণ করেন।
সাগরে এখন বেশ ভালোই মাছ পাওয়া যাচ্ছে। সাগর থেকে মাছ আহরণ করে চরে এনে বিভিন্ন প্রকার মাছের প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এরপর সেগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে মাচায় ঝুলিয়ে রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুঁটকি।
এই মুহূর্তে লইট্যা শুটকি ৩০০-৪০০ টাকা, ছুরি ৮০০-৯০০ টাকা, চেলা ৫০০-৫৫০ টাকা, চিংড়ি ৫০০-৬০০ টাকা, ভোলা ৪০০-৪২০ টাকা, চকলেট ২০০-২২০ টাকা, ক্ষয়রা ১৫০-২০০ টাকা, রূপচাঁদা (কাঁচা) ৪০০-৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়।
গত বছর অবশ্য করোনা মহামারিতে বড় ধরনের লোকসান গুনতে হয়েছিল আবু তাহেরকে। ৬৫ লাখ খরচের বিপরীতে তিনি শুঁটকি বিক্রি করেন মাত্র ৪০ লাখ টাকার। ফলে ২০ লাখ টাকা দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি।
এ প্রসঙ্গ উঠতে হতাশা ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে। '৩১ বছর ধরে সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ ও শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করে ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন করতে পারিনি। এখনও নদীর চরে সরকারি জায়গায় পরিবার নিয়ে বসবাস করা লাগে।'
তারপরও আশায় বুক বাঁধছেন আবু তাহের। এবারও বিভিন্ন এনজিও থেকে ৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে সাগরে গেছেন। মনে করছেন, 'আবহাওয়া যদি ভালো থাকে, তাহলে গেল বছরের মতো এবার আর লোকসানে পড়তে হবে না।'
এক শুক্রবার শ্রীফলতলা দাউদখালী নদীর চর এলাকায় গেলে কথা হয় জেলে আবু তাহেরের স্ত্রী শাহিনা বেগমের সঙ্গেও। তার কাছ থেকে জানা গেল, বিয়ের পর থেকেই তার স্বামী সাগরে মাছ আহরণ করেন। কয়েক বছর ধরে নিজস্ব ট্রলার নিয়ে এলাকার ৪০ জন জেলেকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরছেন তিনি। সেই মাছ শুঁটকি করে তারা দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠান। স্বামী-সন্তানকে নিয়ে এখন প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে শাহিনার।
শাহিনা একা নন, এই গ্রামের শত শত পরিবারের সদস্যদের দিন কাটে দুঃশ্চিন্তা আর হতাশাকে সঙ্গী করে। বছরের অর্ধেক সময় পুরুষশূন্য থাকে চর গ্রামটি। এখানকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পড়ালেখার সুযোগও পায় না খুব একটা।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর শুঁটকি আহরণ হয়েছিল ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। সেখান থেকে আদায়কৃত রাজস্বের পরিমাণ ৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। চলতি বছরও একই পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বন বিভাগ। এবারের শুঁটকি মৌসুমে দুবলার চরে জেলেদের জন্য ৯৮৫টি ঘর ও ৬৬টি ডিপোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শুঁটকি মৌসুম ঘিরে সুন্দরবনের দুবলা চরাঞ্চলে অন্তত ১২ থেকে ১৩ হাজার জেলে-ব্যবসায়ী ও শ্রমিকের সমাগম ঘটবে।
চরাঞ্চলে অস্থায়ী নিবাস স্থাপন করা জেলে-শ্রমিকদের জন্য বনের যাতে কোনো ধরনের ক্ষয়-ক্ষতি না হয়, সেজন্য শুঁটকি আহরণের কাজে নিয়োজিত জেলে-শ্রমিকদের ঘর তৈরির ওপর নানা শর্ত দিয়েছে বন বিভাগ
বাগেরহাট, মোংলা, রামপাল, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশালসহ সুন্দরবন উপকূলের হাজার হাজার জেলে অবস্থান নেন দুবলার চরাঞ্চলে। এছাড়া চট্টগ্রাম, হাতিয়া, সন্দীপ ও রংপুর অঞ্চলের জেলে ও মৎস্যজীবীরাও আসেন এখানে।
যেসব চর এলাকায় শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দুবলার চর, মেহের আলীর চর, আলোরকোল, অফিস কিল্লা, মাঝির কেল্লা, শেলার চর, নারকেল বাড়িয়া, ছোট আম বাড়িয়া, বড় আম বাড়িয়া, মানিক খালী, কবর খালী, চাপড়া খালীর চর, কোকিলমনি ও হলদি খালীর চর।
ইউনুস, শাহ আলম, কামরুলসহ শরণখোলার একাধিক জেলে বলেন, 'বছরের ৫ মাস সমুদ্রে থেকে মাছ আহরণ করি। সেটা বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুঁটকি বানিয়ে বিক্রি করে জীবনযাপন করি। তারপরও মাছ ধরতে গেলে বিভিন্ন সময় দুর্যোগের মুখে পড়তে হয়।'
চরগুলোতে জেলেদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থার দাবি জানান তারা।
মৎস্যজীবী সংগঠন দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আতঙ্ক নিয়েই উপকূলীয় অঞ্চলের মৌসুমী জেলেরা জাল, নৌকা ও মৎস্য আহরণের অন্যান্য উপকরণ নিয়ে সাগরপাড়ের জেলেপল্লিতে ছুটে যান।'
তিনি আরও জানান, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ আহরণ করতে হয় জেলেদের। এই ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার পাশাপাশি সুপেয় পানি ও চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিতের দাবি জানান কামাল উদ্ধিন আহমেদ।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, 'প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সুন্দরবনের বিভিন্ন চরে শুঁটকি মৌসুমে জেলেদের পারমিট (অনুমতি) দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার থেকেই জেলেরা মাছ আহরণে সমুদ্রে যাত্রা শুরু করেছেন। তবে জেলেরা যাতে চরগুলোতে তাদের মাচা তৈরি ও ঘর নির্মাণে অবৈধভাবে সুন্দরবনের কোনো গাছ কর্তন না করে, সে ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।'
এর পাশাপাশি এ মৌসুমে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সব ধরনের অপরাধ ঠেকাতে বনবিভাগের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান বেলায়েত হোসেন।