সমুদ্র জয়ে বাংলার ১৯ নারী
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার মেয়ে লাভলী দাশ। গত ২৮ ডিসেম্বর 'বাংলার অর্জন' নামে জাহাজে ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়। বন্দরে নেমেই ক্যাপ্টেনকে জানিয়ে প্রথমে নিয়েছিলেন একটি সিম। তারপর চট্টগ্রামে থাকা অসুস্থ বাবার সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু দুইদিন পর ৩০ ডিসেম্বর মৃত্যু হয় তার বাবার। বাবার মৃত্যুর সংবাদ যখন পান তখনও তিনি জাকার্তায়।
চট্টগ্রাম থেকে বিএসসি অফিস ও জাহাজে যোগাযোগ করা হলেও জটিলতার কারণে আসা হয়নি লাভলী দাশের। পরবর্তী সময়ে একই জাহাজে করে জাকার্তা থেকে বেলাউন বন্দরে যান তিনি। সেখান থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে ১১ দিন পর দেশে ফেরেন। এভাবেই জীবন যুদ্ধ ও উত্তাল মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা।
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জাহাজের ক্যাপ্টেন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে নারীরা এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশে বিদেশীগামী জাহাজে নারীদের এ জয়যাত্রা শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে। ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) জাহাজে করে নারীরা নামেন সমুদ্র জয়ে। আর দশটা পেশার চেয়ে চ্যালেঞ্জিং এ পেশায়ও এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা। শুধু লাভলী দাশ নয়; তার মতো আরও ১৮ নারী নেমেছেন এ সমুদ্র জয়ে।
তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট লাভলী দাশ। নিজের আগ্রহ এবং পরিবারের সহযোগীতায় উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়াকে বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। প্রথম সমুদ্র যাত্রার অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি জানান, ২০১৯ সালের জুন-জুলাইয়ে উত্তাল ছিল ভারত মহাসাগর। সিঙ্গাপুর থেকে ভারতের মুম্বাই বন্দরে আসতে স্বাভাবিক সময়ে মাত্র চারদিন লাগলেও সাগর উত্তাল থাকায় ক্ষণে ক্ষণে জাহাজের দিক পরিবর্তন এবং অতিমাত্রার রোলিংয়ের কারণে এ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে আট দিনে। জাহাজে সারাক্ষণ রোলিং (ঝাকুনি) থাকায় এবং দুযোগপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে পাঁচ দিন।
এভাবেই ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ সালে চীনের জিয়াংসু শিপ ইয়ার্ড থেকে দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্ডিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, কাতার, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকার মোজাম্বিক, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা ও বেলাউন বন্দর হয়ে গত ৭ জানুয়ারি শেষ হয় সে যাত্রা।
দেশের মেয়েদের এ সমুদ্র জয়ের শুরুতেই ছিল বাঁধা। মেরিন একাডেমিতে ২০১২ সালে ভর্তি হওয়া মেয়েরা যোগ্যতার সঙ্গে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়েছেন। তবে ২০১৪ সালে নারীদের দক্ষতার সনদ সিডিসি (কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট) দিতে টালবাহানা শুরু করে শিপিং অফিস। অনেক বাধা পেরিয়ে এক পর্যায়ে তারা অর্জন করেন সেই সিডিসি। এটি পাওয়ার পর বাধা হয়ে দাঁড়ান জাহাজ মালিকরা। নিরাপত্তার অজুহাতে বেসরকারি কোনো জাহাজ মালিকই নিয়োগ দিতে রাজি হননি তাদের। আবার শুরু হয় তাদের সংগওাম। এক পর্যায়ে বিএসসি নিয়োগ দিতে রাজি হয়। তবে নিয়োগ পেলেও বেতন দিতে রাজি ছিল না তারা। তবুও বেতন ছাড়া তারা চাকরি করেন এক বছর।
এদিকে, চলে যাচ্ছে পদোন্নতির সময়। তাই সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের অধীনে আবার পরীক্ষায় বসতে হয় নারী ক্যাডেটদের। ২০১৬ সালে সার্টিফিকেট অব কম্পিটেন্সি ('সিওসি ক্লাস-থ্রি)' দক্ষতার সঙ্গে শেষ করেন তারা। এরও দুই বছর পর ২০১৮ সালে ৪৮তম ব্যাচ থেকে শুরু হয় নারী ক্যাডেটদের সমুদ্র জয়ের মিশন।
৪৮তম ব্যাচে প্রথম ভর্তি হওয়া ১৬ নারী ক্যাডেট ২০১৪ সালে বিএসসির মালিকানাধীন এমভি বাংলার সৌরভ, বাংলার জ্যোতি, বাংলার শিখা, বাংলার কল্লোল, বাংলার মণি ও বাংলার কাকলি জাহাজে সফলতার সঙ্গে শেষ করে এক বছরের প্রশিক্ষণ।
এ প্রসঙ্গে লাভলী দাশ বলেন, নারী নাবিকদের পেশা আর দশটা পেশার মতো নয়। এখানে মেয়েরা এক বছর জাহাজে থাকার পরও নতুন জাহাজে ওঠা যেমন অনিশ্চিত তেমনি নানা বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের। অন্যান্য দেশের বন্দরগুলোতে আমরা নারী ক্যাপ্টেনকেও দেখেছি। আমাদের দেশে হয়তো সেই দিন আর বেশি দূরে নয়; যখন একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন হবে নারী।
তিনি আরও বলেন, সরকার নারীর ক্ষমতায়নে জোর দেওয়ার কারণে এতটুকু আসছি আমরা। নতুন ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, জেনেশুনে, চ্যালেঞ্জ এবং অনিশ্চিতার মধ্যেও যাদের এগিয়ে যাওয়ার সাহস রয়েছে তাদেরই এ পেশায় আসা উচিত।
চট্টগ্রামের আরেক মেয়ে মৌটুসী তালুকদার। চট্টগ্রামের মেরিন একাডেমি থেকে পাস করে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক বছর কাজ করেছেন বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসির) জাহাজে। এরপর ২০১৮ সালে ডিসেম্বরে ওঠেন বিএসসির নতুন জাহাজে। তিনি বলেন, পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করেছি আমরা। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করতে হয় তা শিখেছি আমরা।
আটলান্টিক মহাসাগরের ইকোয়েডরের অংশে রয়েছে শূন্য ডিগ্রি রেখা। এ ছাড়াও রয়েছে ৩০ ডিগ্রি উত্তর ও ৩০ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশের হর্স লেটিচুডে উত্তাল থাকে মহাসাগর। এ রেখা অতিক্রম করা অনেক চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু বাংলাদেশের পাঁচ নারী ক্যাডেট 'বাংলার জয়যাত্রা' জাহাজে এটি অতিক্রম করেছেন তিনবার।
আঞ্জুমান আরা ও ৫ নারী ক্যাডেট প্রথমবারের মতো ক্যাডেট হিসেবে বাংলার জয়যাত্রা জাহাজে উঠেই পান এ অভিজ্ঞতা।
তিনি জানান, শূন্য রেখা থেকে ৫ ডিগ্রি উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশে সাগর থাকে খুবই শান্ত। কিন্তু ৫ ডিগ্রী উত্তর কিংবা দক্ষিণে উত্তাল হয়ে উঠে সাগর। তখন জাহাজ রোলিং হয় বেশি। এজন্য আমাদের আগে থেকেই নিতে হতো প্রস্তুতি।
বিএসসির জেনারেল ম্যানেজার (শিপিং) ক্যাপ্টেন জামাল হোসেন তালুকদার বলেন, চ্যালেঞ্জিং হলেও বিএসসির নারী ক্যাডেটরা পুরুষ ক্যাডেটদের পাশাপাশি ভালো করছেন। বিএসসির পাঁচটি জাহাজে নারী ক্যাডেট ও অফিসাররা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি থেকে যেসব নারী ক্যাডেট বের হচ্ছে তারা বিএসসির বিভিন্ন জাহাজে প্রশিক্ষণেরও সুযোগ পাচ্ছে। ক্যাডেট হিসেবে সাফল্যের সাথে উর্ত্তীণের পর তাদের অফিসার হিসেবে নিয়োগও দেওয়া হচ্ছে।