সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনার প্রোফাইল থেকে হ্যাকার কী নেয়?
ইনস্টাগ্রামে হয়তো আপনার তুলতুলে পোষা প্রিয় কুকুরটির ছবি আছে। লকডাউনের দীর্ঘ সময় পর অফিসে সহকর্মীরা মিলে টিকটক ভিডিও বানিয়েছেন। লিংকড-ইনে আপনার আলমা ম্যাটার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম দেওয়া আছে।
উন্মুক্ত এসব তথ্য ব্যবহার করে মুহূর্তেই হ্যাকাররা উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে আপনার হ্যাকিং প্রোফাইল তৈরি করে ফেলতে পারবে। পরবর্তীতে এসব তথ্য দিয়ে শুধু আপনার ব্যক্তিগত ক্ষতিসাধনই নয়, বরং কর্মক্ষেত্রের প্রাতিষ্ঠানিক নেটওয়ার্কেও সহজেই হানা দেওয়া সম্ভব।
যেমন, আপনার পছন্দের বিষয় অনুযায়ী হ্যাকাররা ই-মেইল তৈরি করে পাঠাতে পারে। ধরুন, আপনি যদি প্রাণীপ্রেমী হন, তাহলে হয়তো আপনাকে কোনো প্রাণীসেবা সংগঠনের যোগদানের আহ্বান জানিয়ে হ্যাকাররা লিংক পাঠাবে। সেই লিংকে প্রবেশ করা মাত্রই ম্যাল সফটওয়্যার আপনার পুরো কম্পিউটার সিস্টেম ব্লক করে দিয়ে ক্ষতিপূরণ দাবি করবে। দাবিকৃত অর্থ না দেওয়া অবধি আপনার মুক্তি নেই।
কিংবা, আপনার পরিচয় ধারণ করে ফেক আইডি দিয়ে আপনার পরিচিত মানুষদের ফাঁদে ফেলার মতো হ্যাকারেরও অভাব নেই।
"ভালো একটি টোপ তৈরি করার মতো প্রায় ৬০ শতাংশ তথ্যই আমি শুধু ব্যবহারকারীর ইন্সটাগ্রাম ঘেটেই পাওয়া সম্ভব," বলেন র্যাচেল টোবাক। র্যাচেল নিজে একজন হ্যাকার হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং সচেতনতা সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠান সোশ্যালপ্রুফ সিকিউরিটির উদ্যোক্তা এবং সিইও। তিনি বলেন, "আমি মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে সহজেই হ্যাকিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য বের করতে পারি।"
বিষয়টি শুধু আপনি কী পোস্ট করছেন, তা নিয়ে নয়। বরং আপনি কোন পোস্টগুলোতে লাইক বা রিয়েকশন প্রদান করছেন সেখান থেকেও আপনি কে এবং কোন বিষয়ে আগ্রহী এ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া সম্ভব বলে জানান সাইবার সিকিউরিটি প্রকৌশলী ক্যারি গার্ডনার।
আর তাই হ্যাকিং থেকে বাঁচতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কী ধরনের নিরাপত্তা অবলম্বন করা যেতে পারে এ সম্পর্কে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ তুলে ধরা হল।
কোনো কিছু পোস্ট করার আগে দুবার ভাবুন, পোস্ট করার পরেও ভাবুন
অনলাইনে নিরাপত্তা জোরদার করতে বিশেষজ্ঞরা সবসময় এই পরামর্শটি দিয়ে থাকেন। কিন্তু, তারপরও ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার বিষয়ে মানুষ খুব একটা সচেতন নয়।
আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনা, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, পরিবারের সদস্যদের খুঁটিনাটি তথ্য কিংবা আপনার কাজের বিশদ তথ্য পাবলিক প্ল্যাটফর্মে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন। এসব তথ্য দিয়ে সহজেই আপনাকে কিংবা আপনার পরিচিত মানুষ ও সহকর্মীদের বিভ্রান্ত করে বিপদে ফেলা সম্ভব।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক আইডির ছবিও পোস্ট করবেন না, তা থেকে আপনার হ্যাকিং প্রফাইল নির্মাণ করা বা ছদ্মবেশ ধারণ আরও সহজতর হয়ে ওঠে। এছাড়া ছবির অবস্থান ট্যাগ করা থেকেও বিরত থাকুন।
পাশাপাশি, কাজের বিষয়গুলো গোপনীয় রাখুন। আপনার প্রাতিষ্ঠানিক কাজে ব্যবহৃত সফটওয়্যারের বিষয়ে জানতে পারলে হ্যাকাররা অনুরূপ ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড ডিজাইন করে আপনাকে ও আপনার সহকর্মীদের ধোঁকা দিতে পারে বলে সতর্ক করেন র্যাচেল।
কর্মক্ষেত্রে ব্যবহৃত ই-মেইল পৃথক ও গোপনীয় রাখুন
ব্যক্তিগত যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহৃত ই-মেইল এবং কর্মক্ষেত্রে ব্যবহৃত ই-মেইল পৃথক রাখুন।
ফেসবুক বা লিকড ইনের মতো সাইটগুলোতে ব্যবহারকারীরা অন্যদের থেকে ই-মেইল ঠিকানা গোপন রাখতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এই তথ্যগুলো উন্মুক্ত রাখে। ফলে, তারা বিভিন্ন দুষ্টচক্রের সহজ শিকারে পরিণত হয়।
বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন প্রোফাইল ছবি ব্যবহার করুন
প্রফাইল ছবি, ইউজার নেম ও অন্যান্য একই ধরনের বিষয়বস্তু (যেমন, আগ্রহের বিষয়, বন্ধুতালিকা) ইত্যাদি মিলিয়ে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং শক্তিশালী সফটওয়্যার ব্যবহার করে সহজেই অন্যান্য মাধ্যমের সন্ধান পাওয়া সম্ভব।
যেমন, আপনার ইন্সটাগ্রাম এবং পিন্টারেস্টে নাম ভিন্ন হলেও একই ছবি ব্যবহার করলে আপনাকে শনাক্ত করা কোনো কঠিন বিষয় নয়। এভাবে, আপনার নকল প্রফাইল তৈরি করাও হ্যাকারের জন্য আরও বেশি সহজ হবে। তাই, প্রতিটি মাধ্যমে ভিন্ন ছবি ব্যবহার করুন।
ডেটিং সাইটেও সতর্কতা অবলম্বন
ডেটিং সাইটগুলোতে সাধারণত মানুষ কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য প্রদান করে থাকে।
আপনাকে কারা অনুসরণ করতে পারছে তা সীমিত রাখুন। কেননা, আজ আপনি যা পোস্ট করছেন কাল তা আপনার বিরুদ্ধেই হ্যাকাররা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। আর তাই সংবেদনশীল সকল ধরনের তথ্য শেয়ারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করুন।
আপনার অনলাইন সিভি পরিচ্ছন্ন রাখুন
চাকরি অনুসন্ধানের সাইটগুলোতে যেসকল তথ্য জমা দিচ্ছেন তা হ্যাকারদের জন্য অমূল্য সম্পদে পরিণত হতে পারে। শুধু আপনার বিরুদ্ধেই নয়, এসব তথ্য আপনার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা সম্ভব।
পুরনো কর্মক্ষেত্র বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করা সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বনের র্পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। একই সাথে ফোন এবং ইমেইল নাম্বারও গোপনীয় রাখা জরুরি বলে মনে করেন তারা।
ফোন ও ইমেইলের মতো তথ্যের পরিবর্তে আপনার দক্ষতা এবং কাজের ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত প্রকাশ করুন।
এছাড়া, সাময়িক ভাবে চাকরির সন্ধানে তথ্যবহুল সিভি প্রকাশ করলেও চাকরি পাওয়ার পর তা সংশোধন করে সংক্ষিপ্ত করুন।
বন্ধুত্বের অনুরোধ গ্রহণ করার পূর্বে ভালোমতো যাচাই করুন
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা আপনার বন্ধু হতে চায় তাদের সবাই কিন্তু সত্যবাদী নন। অনেকেই হয়তো আছেন যারা বন্ধুত্বের আড়ালে আপনাকে ফাঁদে ফেলার সুযোগ সন্ধান করছেন। আপনার পরিচয় চুরি করা থেকে শুরু করে এই ছদ্মবেশীরা জনসম্মুখে আপনার সুনাম পর্যন্ত খর্ব করার ক্ষমতা রাখে।
কিন্তু, এতসব সতর্কতা অবলম্বন সত্ত্বেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আপনার জন্য হুমকির সৃষ্টি হতে পারে বলে মন্তব্য করেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বার। "সোশ্যাল মিডিয়া এখন পর্যন্ত মগের মুল্লুক হয়েই রয়ে গেছে," মন্তব্য করেন তিনি।
- ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল অবলম্বনে