হুমায়ূন আহমেদের অলৌকিক, আধ্যাত্মিক বা আধিভৌতিক ব্যাপারস্যাপার
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিকদের একজন হুমায়ূন আহমেদ। লেখালেখিকে প্রধান পেশা হিসেবে গ্রহণ করার আগে তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর বিজ্ঞানের মানুষ। রসায়নে পিএইচডি করে হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। লিখেছেন কোয়ান্টাম রসায়ন নিয়ে বই। এছাড়া বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির পথিকৃতের কৃতিত্বও অনেকে দেন তাকে।
কিন্তু সেই হুমায়ূন আহমেদেরই সাহিত্যকর্মের একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে অলৌকিক, আধ্যাত্মিক বা আধিভৌতিক ব্যাপারস্যাপার। মিসির আলির কাহিনিতে যুক্তি দিয়ে তিনি ভেদ করার চেষ্টা করেছেন অনেক আধিভৌতিক রহস্য। তবু অমীমাংসিত রয়ে গেছে অনেক কিছু। আরেক জনপ্রিয় চরিত্র হিমুর কাহিনিতে অব্যাখ্যাত বিষয়ের পরিমাণ আরো বেশি। এছাড়াও তার অন্য অনেক উপন্যাস ও ছোটগল্পেই প্রাধান্য পেয়েছে এমন অনেক বিষয়-আশয়, বস্তুজগতের যুক্তি, বুদ্ধি ও চিন্তা দিয়ে যেগুলোর তল পাওয়া অসম্ভব।
তাই পাঠকদের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ব্যক্তিজীবনে অলৌকিকতা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল। এ প্রশ্নের উত্তর মিলেছে তার জীবনের শেষ দিককার কিছু সাক্ষাৎকারে। আলীম আজিজের সঙ্গে তৈমুর রেজা ও ইকবাল হোসাইন চৌধুরীকে দেওয়া একেবারেই ভিন্ন স্বাদের সেসব সাক্ষাৎকারে নন্দিত কথাসাহিত্যিক অকপটে মেলে ধরেছেন তার ভাবনা-বিশ্বাস। স্রষ্টার অস্তিত্ব, মৃত্যু পরবর্তী জগৎ, অমরত্ব নিয়ে ভাবনা ছাড়াও দিয়েছেন কিছু অলৌকিক ঘটনার বয়ান।
সাক্ষাৎকারে বলা হুমায়ূন আহমেদের কথার আলোকেই আজ ১৩ নভেম্বর তার ৭৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিশেষ এই লেখা।
স্রষ্টার অস্তিত্ব
হুমায়ূন ছিলেন ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রমাণ করার জন্য একটি যুক্তি ছিল তার খুবই পছন্দের। একাধিক জায়গায় যুক্তিটি ব্যবহার করেছিলেন তিনি। যুক্তিটি এরকম:
'ধরা যাক, তুমি একটা গ্রহে গেছ। গ্রহটা দেখে তোমার মনে হতে পারে, চিরকাল ধরে গ্রহটা একই রকম আছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তুমি যদি একটা নাইকন ক্যামেরা দেখ, তোমাকে সেটা হাতে নিয়ে বলতেই হবে, এটার একজন কারিগর বা মেকার আছে।
'সামান্য একটা প্লাস্টিকের ক্যামেরা দেখে তুমি বলছো এর একটা মেকার আছে। ক্যামেরার কিন্তু অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তোমার পেছনে একটা মানুষ আছে। ক্যামেরায় পেছনের মানুষটাকে ফোকাস করার সঙ্গে সঙ্গে তুমি হয়ে যাবে আউট অব ফোকাস। আবার তোমাকে ফোকাস করার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের জন হবে আউট অব ফোকাস।
'মানুষের চোখের কিন্তু এই অসুবিধে নেই। চোখ ক্যামেরার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী। আমাদের শরীরে একটা যন্ত্র আছে, যার কাজ শরীরের সুগার-লেভেল ঠিক রাখা। মানুষের পুরো শরীর এমন বিচিত্র আর জটিল যন্ত্রপাতিতে ভরপুর। এসব জটিল ব্যাপার এক দিনে এমনি এমনি হয়ে গেছে, এটা আমার মনে হয় না। "ডারউইন থিওরি" কী বলে? বলে, সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। বলে, পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে মানুষের সামনে নানা রকম বিপত্তি আসবে, সেগুলো জয় করতে গিয়ে আমরা এ রকম হয়ে গেছি। পশুর চোখ কিন্তু হলুদ। আর আমাদের চোখ সাদা। এটা হয়েছে, যাতে মানুষ অন্ধকারের মধ্যে নিজেরা নিজেদের চিনতে পারে। আমাদের টিকে থাকার জন্য এইটুকু জ্ঞানই তো যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মানুষের মাথায় এই জ্ঞান কীভাবে এল যে সে রীতিমতো "বিগ ব্যাং থিওরি" আবিষ্কার করে ফেলল? এই এক্সট্রা-অর্ডিনারি জ্ঞানটা মানুষকে কে দিল? খেয়াল করলে দেখা যাবে, মানুষ সবার আগে যে বাড়িটা বানায়, সেটা একটা প্রার্থনাকক্ষ। সব জাতির মানুষের ক্ষেত্রেই তা-ই। তার মানে, সেই একদম শুরু থেকেই মানুষ আসলে একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তিত—হু ইজ গাইডিং মি?'
আরেক জায়গায় তিনি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন:
'বিজ্ঞান কোনো বিষয় সম্পর্কে হুট করেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না। তার একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে। কিন্তু এই পদ্ধতি তো শুরু থেকে ছিল না। যেমন–অ্যারিস্টটল বলছিলেন, মানুষের মস্তিষ্কের কাজ হলো শরীরে রক্ত সঞ্চালন করা। কথাটা অ্যারিস্টটল বলেছিলেন বলেই আমরা এক হাজার বছর পিছিয়ে গেছি। এখন বিজ্ঞান অনেক অদ্ভুত কথা বলছে। যেমন–মানুষের শরীরের মধ্যে যে ডিএনএ থাকে, তার মৃত্যু নেই।
'তাই আমি মনে করি, আমরা এখনো খুব অল্প বিষয়ই জানতে পেরেছি। একজন পদার্থবিজ্ঞানীর পক্ষে রসায়ন সম্পর্কে বেশি কিছু জানা সম্ভব না। জ্ঞানের পরিধি অনেক অনেক বড়। যুগে যুগে যেসব ধর্মপ্রচারক এসেছেন–তাঁরা কিন্তু একটা সামগ্রিক ধারণা রাখতেন জগৎ বিষয়ে। আল্লাহ তাঁদের কাছে সব সময় সরাসরি জ্ঞান দেন নাই। তাঁরা সব সময় যে সরাসরি ওহি পেয়েছেন তা তো না? জিবরাইল কি সব সময় সশরীরে এসে ওহি পৌঁছে দিয়েছেন? না। অনেক সময় শব্দের মাধ্যমে, অনেক সময় আলোর মাধ্যমেও ওহি পাঠানোর ব্যপারটা ঘটেছে। এ কারণে আমার মনে হয়, মানুষের ক্ষুদ্র জ্ঞানে সৃষ্টিকর্তাকে পুরোপুরি কখনো জানা সম্ভব না।
'সৃষ্টিকর্তা মানুষের মতো এটা ধরে নিয়ে কিন্তু আমি চিন্তা করছি না। আমি চিন্তা করছি এমন একটা অস্তিত্ব নিয়ে, যে সর্বব্যাপী। তাকে আমরা আমাদের ক্ষুদ্র কল্পনাশক্তি দিয়ে কল্পনা করতে পারছি না। তিনি আমাদের কল্পনাসীমার বাইরে। অনেক সূরায় নানাভাবে এসেছে এ প্রসঙ্গ। সূরা এখলাসও এ বিষয়েই।'
মৃত্যু পরবর্তী জগৎ
মৃত্যু পরবর্তী জগৎ নিয়েও হুমায়ূনের সবসময় একটা প্রবল আগ্রহ ছিল। একবার তিনি চেষ্টা করলেন প্রার্থনা করার। প্রতিদিন একটা সময়ে বসতেন। চেষ্টা করতেন জানার যে পৃথিবী থেকে বিদায় মুহূর্তটা কেমন হবে। দিনের পর দিন এই কাজ চলল। এরপর একদিন তিনি একটি স্বপ্ন দেখলেন। কিংবা হুমায়ূনের ভাষ্যে, স্বপ্নটি তাকে দেখানো হলো। অথবা দিনের পর দিন একই ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করার ফলে তার মস্তিষ্ক সেটি তৈরি করল।
হুমায়ূনের দেখা স্বপ্নটি ছিল এমন–বিশাল একটা হাওর। হাওরের মধ্যে পানি, পানি আর পানি। কলাগাছের মতো একটা জিনিস ধরে তিনি ভাসছেন। পানি অল্প ঠান্ডা। কলাগাছের মতো জিনিসটাকে তার মনে হচ্ছে একটা যান, যেটা তাকে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু দূর গিয়ে তার মনে হলো, 'মাই গড! এতো আনন্দের পৃথিবী ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি!' সঙ্গে সঙ্গে তার যাত্রার ইতি ঘটল। আবার ফিরে এলেন তিনি। ফিরে এসে দেখলেন, তার বাড়িঘর সবকিছু আগের মতোই আছে। তখন ফের তার মনে হলো, এবার যাওয়া যাক। তিনি আবার যাত্রা শুরু করলেন। অনেক দূর গিয়ে আবার মনে হলো, 'ও মাই গড! সব ফেলে আমি কোথায় যাচ্ছি!' আবার তিনি ফিরে এলেন। তারপর আবার মনে হলো, 'এই তো সব। আর কী?' এরপর যানটা একটা অকল্পনীয় গতিতে ছুটতে শুরু করল। কোন দিকে যাচ্ছেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন তিনি। দূরে দেখতে পেলেন ছোট্ট একটা আলো।
অমরত্ব
অমরত্বের ব্যাপারেও আগ্রহ ছিল হুমায়ূনের। জীবনের শেষ দিকের কিছু রচনায় ঘুরেফিরে এসেছিল এ প্রসঙ্গ। এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন, ২০৪৫ সালের মধ্যে অমরত্ব প্রাপ্তির উপায় আবিষ্কৃত হবে।
এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এই কথাটা তার নিজের নয়। এটা বিজ্ঞানীদের কথা, যা তিনিও বিশ্বাস করেন। তিনি মনে করেন, মানবজাতি ক্রমশ সিঙ্গুলারিটির দিকে এগোচ্ছে। সব ক্ষেত্রে মানুষের জ্ঞান বাড়ছে। মানুষ এখন অমরত্বের কাছাকাছি চলে এসেছে। ২০২১ সাল নাগাদ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটা বিস্ফোরণ হবে। এই বিস্ফোরণটাই তার মতে সিঙ্গুলারিটি।
অলৌকিক ঘটনা ১
নুহাশপল্লীতে একটা অংশ আছে যেখানে প্রচুর গাছগাছালি। তাই সেদিকটায় কেউ যায় না। একবার এক দুপুরবেলা হুমায়ূন একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। কিছুই ভালো লাগছিল না তার। এমন সময় তার প্রস্রাবের বেগ পেয়ে গেল। তিনি ভাবলেন, কী দরকার ওখান থেকে হেঁটে ফিরে গিয়ে পেশাব করার, গাছের নিচে দাঁড়িয়েই তো পেশাব করা যায়। তা-ই করতে লাগলেন তিনি। অর্ধেকের মতো পেশাব করা হয়েছে, তখন তিনি খুব মিষ্টি একটা মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন, 'এখানে এই কাজ করছেন? আমরা এখানে বেড়াই!'
হুমায়ূনের প্রথমে মনে হলো, নুহাশপল্লীতে ঘুরতে আসে যেসব লোকজন, তাদের কেউ হবে হয়তো। কিন্তু তড়িঘড়ি করে পেশাব শেষ করে ঘুরে তাকাতে তিনি দেখতে পেলেন, কোথাও কেউ নেই। দৌড়ে গাছপালার জঙ্গল থেকে বের হয়ে এসেও তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না।
এরপর তিনি ম্যানেজারকে ডাক দিয়ে অর্ডার দিলেন, এখন থেকে গাছগাছালির মধ্যে কেউ যেন বাথরুম না করে। দ্রুত কাছেই একটা টয়লেট তৈরি করার ব্যবস্থা করতেও বলে দিলেন তিনি।
এই ঘটনার কিছু নিজস্ব ব্যাখ্যা ছিল হুমায়ূনের। তিনি বলেন, 'এর প্রথম ব্যাখ্যা হলো : ওটা কোনো একটা এনটিটি, যাদের আমরা চোখে দেখি না। ওদের কেউ। এটা একটা ইজি ব্যাখ্যা। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটা বলি : আমার সাবকনসাস লেবেল এই কাজটা পছন্দ করে নাই। সাবকনসাস লেবেল হয়তো চায় নাই আমি এই কাজটা করি, তাই নিজে নিজে একটা এনটিটি তৈরি করে তাকে দিয়ে আমাকে বলিয়েছে। শেষটাই আমার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য।'
অলৌকিক ঘটনা ২
তখন হুমায়ূন থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে। তার বড় মামার পড়াশোনা ম্যাট্রিক পর্যন্ত। নানা যখন দেখলেন মামাকে দিয়ে কিছুই করানো যাচ্ছে না, তখন তাকে একটা ফার্মেসি করে দিলেন। গ্রামে যারা ফার্মেসি চালায় তারাই হাতুড়ে ডাক্তার হয়ে যান। ওই মামাও হলেন। এবং তার এমনই যশ হলো যে, তার কাছে ছাড়া আশপাশের অন্য কোনো এমবিবিএস ডাক্তাদের কাছেও কেউ যায় না। মামা একাই গ্রামের সব রোগী দেখতে থাকেন। কোনো রোগী বাঁচে, কোনো রোগী মারা যায়। এদিকে পয়সা হতে থাকা মামার।
গ্রামের কাছেই ছিল একটা জঙ্গলের মতো। একবার জঙ্গলের কাছ দিয়ে রোগী দেখে বাড়ি ফিরছেন মামা। বর্ষাকাল যেতে যেতে মামা এক সাপের গায়ে পা দিয়ে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে ফনা তুলে ফেলল সাপ। ভয়ংকর সাপ। মামা শুধু বলার সুযোগ পেল, আল্লাহ আমাকে বাঁচাও আমি বাকি জীবন তোমার সেবা করব। সাপ ধীরে ধীরে ফনা নামিয়ে নিল। মামা পা তুলল, সাপটা চলে গেল। ফিরে আসার পর, তার ডাক্তারি বিদ্যা শেষ, মামা সারা দিন শুধু আল্লাহকে ডাকেন।
হুমায়ূন বড় মামাকে বললেন, 'বড় মামা, এই যে শুধু আল্লাহকে ডাকেন–এভাবে ডেকে কিছু কি পাইছেন?' জবাবে মামা বললেন, 'পাইছি।' লেখক আবার জিজ্ঞেস করলেন, 'কী পাইছেন?' মামার উত্তর, 'আমি আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে একটা পর্যায়ে নিজেকে দেখতে পাই। দেখি আমি নিজের সামনে বসে আছি।'
হুমায়ূন হেসে বললেন, 'এটা এমন আর কী! আয়না ধরলেই তো আমরা নিজেকে দেখতে পাই। মামা বললেন, এটা সে দেখা না–আমি দেখতে পাই আমি আমার সামনে বসে জিকির করছি।'
মামার এই শেষ কথাগুলো বড় ধরনের প্রভাব ফেলল হুমায়ূনের মনে। তিনিও ঠিক করলেন এমন কিছু চেষ্টা করে দেখবেন। মামাকে সে কথা বললে মামা বললেন, 'আল্লাহর একটা ডাকনাম তোমাকে শিখিয়ে দিই। এইটাই তুমি সব সময় জপ করবে, শুরুতে অল্প অল্প পারবে পরে দেখবে অভ্যস্ত হয়ে গেছো।'
কী নাম ছিল সেটি? খুবই সহজ–আল্লাহু। ঢাকায় ফিরে এলেন লেখক। মুহসীন হলে থাকেন। শুরুতে কখনো হয় আবার হয় না, প্রায়ই ভুলে থাকেন। কিন্তু হঠাৎ করে যদি কোনো মাওলানা দেখেন, কোনো দাড়ি-টুপির সৌম্য চেহারার লোক দেখেন, সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহু আল্লাহু করতে থাকেন। এভাবে ব্যাপারটা তার অভ্যাসে পরিণত হলো। সারাদিনই একই কাজ করতে থাকেন তিনি, থামাতে পারেন না।
এই অবস্থায় একদিন পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়তে গেলেন তিনি। পাবলিক লাইব্রেরিতে তখন খুব ভালো ভালো গল্পের বই ছিল। একদিন বই নিয়ে পড়ছেন, পাশের টেবিল থেকে একজন এসে কাঁধে হাত রেখে বললেন, 'কী, আপনার সমস্যা কী?' আসলে হুমায়ূন যে সারাক্ষণই আল্লাহু আল্লাহু করছেন, সেটা তিনি নিজে আর বুঝতে পারছিলেন না। বুঝতে পারছিলেন না যে তার আল্লাহু আল্লাহু ডাকের শব্দ বাইরেও চলে যাচ্ছে।
এরপর থেকে ক্লাসে গিয়েও তিনি একলা, দূরে গিয়ে বসেন, যেন কেউ শুনতে না পায়। একদিন শিক্ষক এসে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'কী ব্যাপার, তুমি একলা পেছনে বসে আছ কেন? আসো সামনে এসে বসো।' হুমায়ূন তখন কঠিনভাবে চেষ্টা করলেন যাতে অন্য কেউ শুনতে না পায়।
এদিকে রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন–একটা বিশাল ঘর, বহু লোকজন বসে আছে এবং প্রত্যেকেই আল্লাহু আল্লাহু করছে। চারদিকে শুধু একটা সাউন্ড হচ্ছে। এক লয়ের সাউন্ড হচ্ছে, চারদিকে। একসময় ঘুম ভেঙে যায়। দেখতে পান নিজেই আল্লাহু আল্লাহু করছি।
এরপর থেকে প্রতি রাতেই এই ঘটনা। আল্লাহু আল্লাহু শব্দে ঘুম ভাঙে, দেখেন তিনি সিজদার ওপরে। ঘুম ভাঙে আবার ঘুম ধরে। এক রাতে চোখ খুলে দেখেন, ঠিক তার মুখের সামনে এক বিঘত দূরে একটা মুখ। মাথার সামনে চুল নেই, পেছনেও চুল নাই। কঠিন চেহারা, দাঁত নেই। হাঁ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার একবার মনে হলো, চোখে চশমা নেই বলে ভুলভাল দেখছেন। চোখে চশমা দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু চশমা পরার পরও দেখলেন, মুখটা আছে, যেন খানিকটা ভেসে আছে।
প্রচণ্ড ভয় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল হুমায়ূনকে। তিনি ভাবলেন, এই বুঝি তার জীবনের শেষ। মারা যাচ্ছেন তিনি। তার সমস্ত শরীর দিয়ে পানির মতো ঘাম ঝরছে। তখন হঠাৎ করে একটা চিন্তা খেলা করে গেল তার মাথায়–এই মুহূর্তে কেউ যদি আশপাশের কোথাও থেকে আজান দেয়, তাহলে জিনিসটা চলে যাবে। কিন্তু কে দেবে আজান? তিনি নিজে তো আজান জানেন না। তাই একমনে শুধু বলতে থাকলেন, আজান-আজান।
এভাবে বলতে বলতে ইউনিভার্সিটি মসজিদ থেকে আজান শুরু হয়ে গেল। আজান চলল। তারপর চোখ মেলে দেখলেন, মুখটা চলে গেছে। বহু কষ্টে দরজা খুলে পাশের রুমে গেলেন। পাশের রুমমেট মাওলানা মোহাদ্দেস পাস করে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছেন। অজু করে এসেছেন। তাকে হুমায়ূন বললেন, 'ভাই, আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি। আপনি কি আপনার নামাজটা আমার ঘরে পড়বেন?' মাওলানা কোনো প্রশ্ন করলেন না। শুধু বললেন, 'অবশ্যই অবশ্যই হুমায়ূন।'
হুমায়ূন আর সেদিন ক্লাসে গেলেন। তার সমস্ত শরীর ফুলে গেল, আর সারাক্ষণ হাতের তালু ও পা চুলকাতে লাগল। তার বাবাকে খবর দেওয়া হলো। বাবা এসে তাকে হল থেকে নিয়ে গেলেন। এক মাস বগুড়ায় থাকার পর কিছুটা সুস্থ হলে তিনি ফিরে এলেন। ফের শুরু করলেন স্বাভাবিক জীবনযাপন।
পরে অবশ্য তিনি মামাকে এই ঘটনার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন। মামা বলেছিলেন, তিনি ভুল করেছেন। কাজটা বিরতি দিয়ে দিয়ে করতে হয়। তিনি তা করেননি বলেই এমন হয়েছে। মামার কথাকে আগে গুরুত্ব না দেওয়ায় হুমায়ূন নিজেই নিজের উপর খুব বিরক্ত হয়ে পড়েন।
অলৌকিক ঘটনা ৩
হুমায়ূন বিশ্বাস করতেন, কিছু কঠিন ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ থাকতে পারেন, যারা মানুষের মনের কথা বুঝতে পারেন। যদি তিনি দূর থেকে তাকে মনে মনে বলেন, আসসালামুয়ালাইকুম, তাহলে ওই মানুষের টের পাওয়া উচিত এবং সালামের জবাব দেওয়া উচিত। এই ব্যাপারটাকে এক ধরনের খেলা বলে মনে করতেন তিনি। তাই একটা সময় এমন হলো যে তিনি যাকেই দেখেন, মনে মনে বলেন আসসালামুয়ালাইকুম।
এক শীতের রাতে তিনি শহীদ মিনার চত্বরে চা খেয়ে রওনা দিয়েছেন। রোকেয়া হলের সামনে বড় রাস্তা ক্রস করতে হবে। তার সঙ্গে ড. আতিকুর রহমান, বর্তমানে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। দুই বন্ধু কথা বলতে বলতে, গল্প করতে করতে পার হচ্ছেন। পাশ দিয়ে প্রবীণ লুঙ্গি পরা খালি গায়ে এক লোক যাচ্ছেন। যথারীতি অভ্যাসবশত সালাম দিয়ে বসলেন হুমায়ূন। এরপর রাস্তা ক্রস করে অন্য পাশে চলে এসেছেন। কিন্তু ওই খালি গায়ে লোকটা দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন, 'এই শুনে যা!' এ কথায় বন্ধু আতিক খুব রেগে গেল। এত বড় স্পর্ধা! তুই করে বলছে! কিন্তু তাকে থামালেন হুমায়ূন। লোকটা কাছে এগিয়ে এসে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'ওয়ালাইকুম সালাম। এবার যা!'
এই ঘটনায় পুরোপুরি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন তিনি। এই তো সেই লোক, যাকে এতদিন ধরে খুঁজে আসছিলেন তিনি! এমন ভয় পেলেন যে আতিককে টানতে টানতে হাঁটা দিলেন। অনেকটা দূরে গিয়ে পেছন ফিরে দেখলেন, ওই লোকটি তখনো তাকিয়ে আছেন, একদৃষ্টে।