শাহেদ চৌধুরী: বিশেষ দিনে শুভকামনা জানানো যার নেশা!
'আপনার নাম কী?... জন্ম তারিখ কত?... আপনি কি বিয়ে করেছেন?... আপনার ফোন নাম্বারটা বলুন…' — এক নাগাড়ে প্রশ্ন করে গেলেন শাহেদ চৌধুরী। উত্তর শুনে কম্পিউটারে খটখট করে কী যেন টাইপ করে ফেললেন। ঘাড় কিঞ্চিৎ এগিয়ে নিয়ে দেখলাম, কম্পিউটারের স্ক্রিনে ভাসছে জন্মতারিখের তালিকা। সেই তালিকায় নাম, ফোন নাম্বারসহ কিছু তথ্য যুক্ত করে ফেলেছেন শাহেদ। সেখানে শুধু একজনের নাম নয়, প্রতিটি তারিখের তালিকায় রয়েছে শত শত মানুষের নাম, জন্ম তারিখ, বিয়ের তারিখ এবং ফোন নাম্বার। যাদেরকে নিয়ম করে বিশেষদিনে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান শাহেদ চৌধুরী।
শাহেদ চৌধুরী পেশায় সাংবাদিক। পেশাগত জীবনের বাইরে মানুষের জন্মদিন কিংবা বিবাহবার্ষিকী সংগ্রহ করে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠানোই তার নেশা। আর নেশাকে সঙ্গী করেই গত ৩২ বছরের বেশি সময় ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
কিন্তু কেন জন্মদিন কিংবা বিয়ের তারিখ?
'বঙ্গবন্ধুর একটা অভ্যাস ছিল, মানুষকে মনে রাখা। তার স্মরণশক্তি ছিল অনেক বেশি। বাবার কাছ থেকে যখন ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধুর গল্প শুনতাম, তখন আমিও চাইতাম মানুষকে মনে রাখতে। কিন্তু আমার তো অত মেধা ছিল না। আমি মানুষকে মনে রাখতে পারতাম না, নাম ভুলে যেতাম। বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন প্রতিদিন ডায়েরি লেখা। তখন মানুষকে স্মরণ রাখার জন্য ঠিক করলাম মানুষের জন্মদিন সংগ্রহ করব', বলছিলেন শাহেদ চৌধুরী।
জন্মদিন কিংবা বিবাহবার্ষিকী মানুষের জীবনে বিশেষ দিনগুলোর মধ্যে একটি। এমন একটি বিশেষ দিনে আচমকা শুভেচ্ছাবার্তা পাওয়া যেকোনো মানুষের জন্যই আনন্দের বিষয়। আর এই আনন্দ ছড়িয়ে দিতেই কাজ করেন শাহেদ চৌধুরী। ভালোবাসেন মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে। তারই উপলক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন বিশেষদিনে মানুষকে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠানোর বিষয়টিকে। ফোন করে কিংবা খুদে বার্তায় শুভকামনা জানিয়ে মানুষকে চমকে দেওয়াই তার আনন্দের উৎস।
শুরুটা হয়েছিল আশির দশকের শেষের দিকে। সে সময় শাহেদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। যোগাযোগের শিক্ষার্থী হওয়ায় মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার জন্য সবসময় নিজের সঙ্গে বহন করতেন পকেট ডায়েরি কিংবা ছোট নোটবুক। কারো সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর লিখে রাখতেন জন্মদিন। পরবর্তীসময়ে জন্মদিনের দিন যখন সাক্ষাৎ হতো, তখন জানাতেন শুভেচ্ছা।
পত্রমিতালী থেকে হোয়াটসঅ্যাপ!
'আপনি পত্রমিতালীর কথা জানেন? এখন এটা নেই। আমাদের সময়ে পত্রমিতালী ছিল। বিভিন্ন সাপ্তাহিক পত্রিকায় পত্রমিতালী ছাপা হতো। আমি পত্রমিতালীতে প্রচুর চিঠি পাঠাতাম,' হেসে বলেন শাহেদ।
পত্রমিতালী ছিল চিঠির মাধ্যমে বন্ধুত্ব করার একটি মাধ্যম। আশি এবং নব্বইয়ের দশকে সাপ্তাহিক পত্রিকা কিংবা ম্যাগাজিনগুলোতে বন্ধুত্বের প্রত্যাশায় বা শুভকামনা জানিয়ে চিঠি লেখা হতো। সেসব চিঠির মাধ্যমে শাহেদ চেষ্টা করতেন তার বন্ধুদের জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর।
এখন সেসব দিন পেরিয়ে গেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে পত্রমিতালীর পাটও চুকে গেছে বহুকাল হলো। তবে থামেনি শাহেদের শুভেচ্ছাবার্তা পাঠানো।
বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশের পর শাহেদ শুভেচ্ছাবার্তা পাঠানোর মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন টেলিফোনকে। 'তখন অফিসের টিঅ্যান্ডটি ফোন দিয়ে যোগাযোগ করতাম। যার সঙ্গে যোগাযোগ করতাম, তার তো নিজের টিঅ্যান্ডটি ফোন ছিল না। তারও অফিসের টিঅ্যান্ডটি ফোনে যোগাযোগ করে কথা বলতাম,' বলেন শাহেদ।
এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এলো। কাজও অপেক্ষাকৃত সহজ হলো। ফেসবুকের জালে নিজেকে আবদ্ধ না করলেও শাহেদ হোয়াটসঅ্যাপকে এড়িয়ে যাননি। হোয়াটসঅ্যাপে অব্যাহত রেখেছেন যোগাযোগ। বর্তমানে মোবাইলে ফোন করে, এসএমএস করে কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়ে চলমান রেখেছেন শুভেচ্ছা জানানো।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই পাঠান শুভেচ্ছাবার্তা
প্রথমদিকে ডায়েরিতে বা নোটবুকে জন্মদিনের তালিকা লিখে রাখলেও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে নোটবুকের জায়গায় স্থান পেয়েছে কম্পিউটার। সেখানে তারিখের সঙ্গে থরে থরে সাজানো থাকে পরিচিত ব্যক্তিদের তথ্য। সেসব তথ্য থেকেই বিশেষ দিনে চালিয়ে যান শুভকামনা জানানোর কাজ।
শাহেদ চৌধুরীর ভান্ডারে বর্তমানে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ মানুষের তথ্য রয়েছে। প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠান তিনি। তবে কিছু বিশেষ তারিখে চাপটাও একটু বেশি পড়ে। শাহেদ বলেন, 'আমাদের সময় মেট্রিক পরীক্ষায় যখন রেজিস্ট্রেশন হতো, তখন কেরানি স্যার একটা জন্ম তারিখ লিখে দিতেন। এখন তো আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্মের দিনেই বার্থ সার্টিফিকেট করে ফেলা হয়। আগে তো এমন ছিল না। এজন্য ১ জানুয়ারি, ১ মার্চ, ৩০ জুন, ১ জুলাই, ৩০ ডিসেম্বর, ৩১ ডিসেম্বর তারিখগুলোতে মানুষকে ফোন করতে করতে আমার ২দিন লেগে যায়। শয়ে শয়ে মানুষ থাকে তখন। সেসময় আমি অবশ্য একটা কাজ করি। তালিকা ছোট করে এনে শুধু সাংবাদিকদের শুভেচ্ছা জানাই।'
প্রতিদিন অফিস থেকে বের হওয়ার সময় পরেরদিনের তালিকা সঙ্গে করে নিয়ে রাখেন শাহেদ। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শুরু হয় শুভেচ্ছাবার্তা পাঠানোর কর্মযজ্ঞ। দেশের বাইরে বা ঢাকার বাইরে গেলে যতদিন বাইরে থাকবেন ততদিনের তালিকার প্রিন্ট সঙ্গে করে নিয়ে যান তিনি।
তবে কি গত তিন দশকে শুভেচ্ছা জানাতে কখনো বিলম্ব হয়নি? উত্তর আসে, 'আমি যখন বড় বড় অসুখে আক্রান্ত ছিলাম — যেমন, আমার করোনা হয়েছিল — তখন পারিনি। তারপর ধরুন, আমার মা-বাবা মারা গিয়েছিল বা আমার বোনেদের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল; তখন করতে পারিনি। সময়মতো শুভকামনা না জানাতে পারলে ঐ দিনগুলোর জন্য আমি বিলম্বিত শুভেচ্ছা জানাই।'
বয়স হয়ে গেলে মানুষের একাকীত্ব বেড়ে যায়; এই মর্মে বিশ্বাসী হয়ে বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখেন শাহেদ। তাছাড়া তার বাবাও বলতেন, মানুষের পাশে থাকার জন্য, মানুষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার জন্য। বাবার উপদেশ তাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলছেন এখনো। শাহেদ বলেন, 'বয়স্ক মানুষের সঙ্গে নিয়মিত কথা বললে তারা খুশি হন। দোয়া পাওয়া যায়।'
পড়তে হয়েছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও
জন্মদিনে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠানো নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে না হলেও বিবাহবার্ষিকীতে শুভকামনা জানাতে গিয়ে একাধিকবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে শাহেদকে। বেশিরভাগ সময়েই দেখা গেছে, বিবাহবার্ষিকীর তথ্য জানলেও বিচ্ছেদের তথ্য সম্পর্কে অবগত থাকেন না তিনি। ফলাফল? বিচ্ছেদ হওয়ার পরেও বিবাহবার্ষিকীর তারিখে শুভকামনা জানিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ার ঘটনাও কম ঘটেনি।
'অনেকে আমাকে এসে বলেন তাদের ম্যারেজ ডে'র তারিখ চেঞ্জ হয়েছে। অমুক তারিখ লিখে রাখো। পরে যখন আমি তারিখ লেখার জন্য কম্পিউটারের সামনে বসি, তখন দেখি তারিখ অন্য। তখনই বুঝে নিই, আগের ম্যারেজ ডে বাতিল', বলেন শাহেদ।
তবে মজার ঘটনাও ঘটেছে। সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করার পর থেকে বিশেষ দিনে শুভকামনা পাঠানো নিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। এমনই এক ঘটনার কথা বলতে গিয়ে শাহেদ বলেন, "আমি তখন [গণমাধ্যমের] বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতাম। তখন আমার অফিসের টিঅ্যান্ডটি ফোন দিয়ে এমন অনেকের সাথে কথা বলতাম, যাদের বাসায় টিঅ্যান্ডটি ফোন ছিল। একবার একজন বয়স্ক সাংবাদিককে ফোন করেছি, ফোন রিসিভ করেছেন একজন ভদ্রমহিলা। তারপর সালাম দিলাম, পরিচয় দিলাম, জানতে চাইলাম — এটা কি অমুকের বাসা? যার কাছে ফোন করেছি, তিনি আসলে টেলিফোনের কাছে তখন ছিলেন না। যিনি ফোন ধরেছেন, তার পরিচয় জানতে চাইলাম। উনি বললেন যে মিসেস অমুক বলছেন। তো আমি ভদ্রমহিলাকে বললাম, 'আপনাকে অভিনন্দন, হ্যাপি ম্যারেজ ডে টু ইউ।' এটা শুনে ভদ্রমহিলা আমাকে বেশ গালমন্দ করলেন। আমার তো শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। কোনো কথাই বলতে পারছিলাম না। চুপচাপ শুনে গেলাম। আরও কিছু গালাগালি করে ভদ্রমহিলা ফোন কেটে দিলেন।
"ঐ ঘটনার পরে একদিন প্রেসক্লাবের ক্যান্টিনে সেই বয়স্ক সাংবাদিক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়। সেসময় আমি প্রেসক্লাবের কনিষ্ঠ সাংবাদিকদের মধ্যে একজন ছিলাম। ক্যান্টিনে দেখি ভদ্রলোকের সঙ্গে একজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন। আমি ভদ্রমহিলাকে চিনি না। আমাকে নাম ধরে ডাকার পর আমি কাছে গেলাম। সালাম দিলাম। ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে বললেন, 'দেখো ভাই, তুমি অমুক দিন ফোন করেছিলে; আমি কথা বলেছিলাম তোমার সাথে। সেদিন আমি খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। আমি সাধারণত মানুষকে গালিগালাজ করি না। তুমি মনে কিছু নিও না। আসলে তুমি যেদিন ফোন করেছিলে, সেই দিনটা ছিল তোমার ভাইয়ের দ্বিতীয় পক্ষের বিয়ের তারিখ। আমি প্রথম পক্ষ। এ কারণে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।' কী একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল সেদিন! ভুল বোঝাবুঝি হলে এমন ঘটনা ঘটে আরকি!"
বর্তমানে সমকাল পত্রিকায় উপসম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন শাহেদ চৌধুরী। পাশাপাশি জাতীয় প্রেসক্লাবের কোষাধ্যক্ষ হিসেবেও নিয়োজিত আছেন তিনি। তাছাড়া তিনি ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি'র সাবেক সভাপতি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দুনিয়ায় বিশেষ করে ফেসবুকের যুগে মানুষের জন্মদিনের সন্ধান পাওয়া তুলনামূলক সহজ। তাই নিজেকে সবার থেকে আলাদা করতে শাহেদ নিয়েছেন নতুন এক পন্থা। শাহেদ বলেন, 'আমি এখন একদিন আগে উইশ করি। যারা ফেসবুক ফলো করে তারা তো জন্মদিনের দিনই উইশ করে। আর আমি করি আগাম!'