৩০০ বছর আগে সিল করা চিঠির অর্থোদ্ধার
গোপনীয়তা রক্ষা করতে এখন আমরা কতই না কৌশল অবলম্বন করি। নিজের কোন ছবি বা বার্তা যেন অন্য কেউ দেখতে না পারে সেজন্য আমাদের মোবাইল, কম্পিউটার, লকার সব কিছুতে আজকের দিনে পাসওয়ার্ড এবং সিকিউরিটি কোডের ছড়াছড়ি। কিন্তু আজ থেকে তিনশ বছর আগের কথা ভাবুন!
যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তখন চিঠি। নিজের ভাবনা এবং স্বপ্নের কথাগুলো একান্ত মানুষকে জানানোর উপায়ও তাই। ফলে চিঠির ভেতরে শব্দ বন্দী করতেই তখন নেয়া হতো যত উদ্যোগ।
পুরনো এসব চিঠির আবেদন যেন নষ্ট না হয় গবেষকেরাও তাই নানান পদ্ধতি ঝালিয়ে দেখছিলেন।
খাম না খুলেই চিঠির অর্থ উদ্ধারের জন্য যে কৌশল বা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়-তার নাম 'লেটার লকিং'। খুব সূক্ষ্ণভাবে একটি সমতলবিশিষ্ট কাগজের টুকরাকে এখানে খামে পরিণত করা হয়।
সম্প্রতি একটি পুরনো ট্রাঙ্কের ভেতরে ১৬৮৯ থেকে ১৭০৬ সালের মধ্যে নেদারল্যান্ডের হেগে প্রেরিত ৫৭৭টি চিঠি উদ্ধারের পর গবেষকেরা এই প্রযুক্তি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বসেন।
সে চিঠিগুলো কোনদিন তাদের প্রত্যাশিত প্রাপকের কাছে পৌছায়নি; ষোড়শ শতকের রক্ষণশীল মানুষেরাও সেসব খুলে মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করে নি।
এবার এক দল গবেষক চিঠির সিল বা লক অক্ষত রেখেই অর্থাৎ চিঠির ভাঁজ না খুলেই এসব চিঠি পড়ার উপায় খুঁজে বের করেছে। অত্যন্ত সংবেদনশীল এক্স-রে স্ক্যানার এবং কম্পিউটার অ্যালগরিদম ব্যবহার করে গবেষকরা ভার্চুয়ালি চিঠিগুলোর অর্থ বের করেছেন।
এক বিবৃতিতে গবেষকদল দলটি জানায়, "এই অ্যালগরিদমটি আমাদের লক করা বর্ণগুলোর একেবারে কেন্দ্রে নিয়ে যায়"।
"আমরা চাইলেই কিন্তু চিঠিগুলো কেটে খুলে নিতে পারতাম কিন্তু তা না করে আমরা সময় নিয়েছি। আমরা এসব গোপন, লুকোনো এবং প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত লেখাগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি।"
গবেষণায় ব্যবহৃত এক্স-রে স্ক্যানারটি মূলত এখন পর্যন্ত দাঁতের গবেষণায় অবদান রেখেছে।
লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির গবেষক ডেভিড মিলস এক বিবৃতিতে জানান, স্ক্যানিং প্রযুক্তিটি মেডিকেলে ব্যবহৃত সিটি স্ক্যানারের মতোই, তবে এখানে অনেক তীব্র এক্স-রে ব্যবহার করা হয় যা আমাদের এই অক্ষরগুলি লেখার জন্য ব্যবহৃত কালির চিহ্ন বুঝতে সহায়তা করেছে।
স্ক্যানের পর এখান থেকে নেয়া ছবিগুলো দেখে সেগুলোকে অক্ষরে রূপান্তরিত করা হয় এবং ৩০০ বছরে প্রথমবারের মত অবশেষে ভার্চুয়ালি পড়তে পারা যায়।
নতুন এই কৌশলের মাধ্যমে এখন থেকে ঐতিহাসিক অনেক 'লকড' দলিল, নথি ও চিঠিপত্রের অর্থ উদ্ধার সম্ভব হবে গবেষকরা আশা প্রকাশ করেছেন।
জানা যায়, একটি চিঠি লেখা হয়েছিল ১৬৯৭ সালের ৩১ জুলাই। দ্য হেগে অবস্থানকারী ফরাসী বণিক পিয়েরে লা পার্সের উদ্দেশ্যে চিঠিটি লিখেছিলেন তারই কাজিন জ্যাক সেনাকিউজ। ড্যানিয়েল লা পার্সের মৃত্যু নোটিশের একটি প্রত্যয়িত (সার্টিফায়েড) কপির জন্য সে চিঠিতে বলা হয়।
এই গবেষণার অংশ হিসাবে ফরাসি ভাষায় লেখা চিঠিটি ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছিল। তবু পোকায় কাটার জন্য কিছু বাক্যের অর্থ অস্পষ্টই রয়ে যায়।
চিঠিগুলো ঘাঁটাঘাটির পর গতানুগতিকতার বাইরে কিছু মেলেনি; মেলেনি গোপন কোন সূত্র।
কিন্তু গবেষকেরা বলেন এই চিঠি সে সময়ের সাধারণ মানুষের জীবনের ছাপ তুলে ধরে- সে সময়ের মানুষ কীভাবে বাণিজ্য পরিচালনা করত তার একঝলক আবহ চিঠি থেকেই জানা যায়।
চিঠিপত্রের আলোচিত ট্রাঙ্কটি সিমোন ডি ব্রায়েন নামক একজন পোস্টমাস্টার এবং তার স্ত্রী পোস্টমিস্ট্রেস মেরি জার্মেইনের মালিকানাভুক্ত ছিল। ১৯২৬ সালে হেগের একটি জাদুঘর এর অধিকার গ্রহণ করে।
শুধু অনুদ্ঘাটিত চিঠিই নয়, ট্রাঙ্কের ভেতরে ২,৫৭১টি খোলা চিঠিও ছিল, সাথে মেলে বিভিন্ন কাগজের খন্ড খন্ড অংশ। কোন এক কারণে এগুলো কখনো গন্তব্যে পৌছায়নি!
আসলে সে সময় ডাকটিকিটের মত কিছু ছিল না; এবং প্রেরক নন, বরং প্রাপক চিঠি সরবরাহের ব্যয় বহন করতেন। ফলে কোন কারণে প্রাপক যদি মৃত হন বা চিঠি প্রত্যাখ্যান করে বসেন তাহলে সে চিঠি আর তার দোরগোড়ায় পৌঁছাত না।
- সূত্র: সিএনএন