‘ঘরই নেই, ঘরে থাকব কিভাবে!’
ঝুপড়ির সামনে শিশুকোলে দাঁড়িয়ে আছে এক কিশোরী মা। পাশেই বিছানার কোণে বসে হাসছেন বৃদ্ধ নারী তাছনুর। এরা সবাই ঝুপড়ির বাসিন্দা।
এ ঝুপড়িতে রোদ বৃষ্টি কোনোটাই আটকানো সম্ভব হয় না। তবুও কালবৈশাখীর সময়ে ৪৭ দিন বয়সী এক শিশুসহ পরিবারের সাত সদস্য রাতে এখানে ঘুমায়। পরিবারের সবার সঙ্গে ঝড়-বৃষ্টিতে প্রতিনিয়ত শিশুটিও ভিজে।
পল্লী কবি জসিমউদ্দিনের 'আসমানী' কবিতার বর্ণনা সদৃশ এরকম পরিবারের বসবাস লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার সাহেবেরহাট ইউনিয়নের চর জগবন্ধু গ্রামে।
এপ্রিলের শেষ মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মেঘনা নদীর কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এ গ্রামে যে পরিবারগুলো রয়েছে, তাদের সবার বাড়ি বা ঘর বলতে কেবলমাত্র এক একটি ঝুপড়ি। যেখানে শুধু রাতে কোনোমতে ঘুমানো যায়।
ঝুপড়ির বাসিন্দা তাছনুরের অভিযোগ, 'করোনা সংক্রমণ এড়াতে ঘরেই থাকুন' সরকারের এমন বার্তা আমাদের জন্য না। কারণ আমরা ঘরে থাকব কিভাবে? আমাদের তো ঘরই নেই। আমাদের কেউ অসুস্থ হলে পৃথক থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই।
একই ইউনিয়নের ৮নং ওর্য়াডের সালেহাদের নিজস্ব বাড়ি ঘর নেই। যা ছিল সব নদীতে চলে গেছে। এখন পাথর কারখানার পাশের ছোট একটি কুঁড়েঘরে বছরে ৫ হাজার টাকা ভাড়া চুক্তিতে পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে রাতে ঘুমায়। আর দিনের বেলায় এদিক ওদিক থাকে।
উত্তর দিকের গ্রামের সফিক ১০ বছর আগে নদী বসত ভিটা হারিয়েছেন। ছেলে-মেয়ে, নাতী-নাতনীসহ অন্তত ২০ জনের পরিবারে নিজস্ব কোনো ঘরবাড়ি নেই। বিভিন্ন মানুষের আড়া-বেড়ায় কোনো রকম ঝুপড়ি তৈরি করে থাকছেন।
স্থানীয়সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, কমলনগর, রায়পুর এবং লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় এমন হাজার হাজার পরিবার রয়েছে, যাদের থাকার মতো ভালো ঘর নেই।
এদের মধ্যে সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়ক এলাকা এবং একই সড়কের চর লরে, করুনানগর এলাকায় রয়েছে প্রায় ২ হাজার পরিবার।
রামগতি উপজেলার বালুচর এবং আজাদনগর-তোরাবগঞ্জ বেড়িবাঁধ এলাকা, রায়পুর উপজেলার চরবংশী, চর আবাবিল এবং চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের বেড়িবাঁধ এলাকায় রয়েছে কয়েক হাজার পরিবার।
সদর উপজেলার মজু চৌধুরীর হাট থেকে কমলনগর উপজেলার মতিরহাট পর্যন্ত বেড়িবাঁধের দু'পাশে, রামগঞ্জ উপজেলার শিশুপার্ক এবং সোনাপুর এলাকার বাঁশঘর এলাকায়ও রয়েছে বহু পরিবার।
লক্ষ্মীপুর জেলার গৃহহীনদের বেশিরভাগই পেশায় জেলে, দিনমজুর এবং শ্রমিক। লক্ষ্মীপুর মজুচৌধুরীহাট এলাকার গৃহহীন সফিক মাঝি জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে বাহিরে গিয়ে কাজ করতে পারছি না। তাই উপার্জন নেই। আমাদের জীবন চলছে অর্ধহার আর অনাহারে। রাস্তায় বের হলে প্রশাসনের লোক ঘরে থাকতে বলে। আমরা কিভাবে ঘরে থাকব? আমাদের তো ঘর নেই। এরপরও সরকারি কোনো সহায়তা নেই।
তাদের খবরও কেউ নেয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
২০১১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলায় মোট বাসগৃহের সংখ্যা ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৩৩৯টি। যার মধ্যে শতকরা ৩.৩ ভাগ ঝুপড়ি ঘর। সংখ্যার হিসেবে যার পরিমাণ ১২ হাজার ৫৬টি।
কিন্ত স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা জেন্ডার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সোসাইটি-জেমস'র নির্বাহী পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী জানান, অব্যাহত নদীভাঙনের ফলে প্রায় ১০ বছর পর বর্তমানে ঝুপড়ি ঘর বা গৃহহীন পরিবারের সংখ্যা হবে আগের সংখ্যার চারগুণ বেশি। জেলাজুড়ে ঝুপড়ি ঘরের প্রায় দুই লক্ষাধিক বাসিন্দা করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে রয়েছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোঃ মাহফুজুর রহমান জানান, বেড়িবাঁধের ওপর যারা অস্থায়ীভাবে বসবাস করছে, তাদের বেশির ভাগই নদীভাঙনের শিকার; ঘর হারিয়েছে তাদের নদীতে। সরকারিভাবে তাদেরকে পুনর্বাসন করা হবে। তবে করোনা পরিস্থিতিতে এরকম সকল মানুষকে অবশ্যই খাদ্য সহায়তা প্রদান করার লক্ষ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, গৃহহীন ও ভাসমান মানুষ যাদের ঘর নেই, তাদের হাতে ত্রাণ পৌঁছে দিতে তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজ বাসা থেকে এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনার কথা জানান।