‘পেনশনের টাকায় ডাক্তারি পড়িয়েছি, সেই ছেলে আমাকে রেখে চলে গেল’
ডা. এস এম জাফর হোসাইন রুমি তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী, একমাত্র সন্তান ও ছোট দুই ভাইকে নিয়ে চলছিল সুখের সংসার। পরিবারটির যাবতীয় খরচ চলতো রুমির আয়ের টাকায়।
কিন্তু সবকিছু শেষ হয়ে গেল গত ২৫ মে। ওইদিন ভোরে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. জাফর হোসাইন রুমি। কোভিড-১৯ এর উপসর্গ জ্বর, গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্টে ভুগে মারা যান তিনি। তবে দুই দফা নমুনা পরীক্ষা করা হলেও তার শরীরে করোনা শনাক্ত হয়নি।
মাত্র ৩৫ বছরের বয়সে মারা যাওয়া ডা. রুমি রেখে গেছেন তার দুই বছরের অবুঝ কন্যা সন্তান, অসহায় বাবা-মা, স্ত্রী এবং ছোট দুইভাই। অকালে হারিয়ে যাওয়া রুমির খোঁজ নিতে গেলেই ডুকরে কাঁদছেন সন্তানহারা, বাবা-মা, স্বামীহারা, স্ত্রী বা প্রিয়জনহারা স্বজনরা। আনোয়ার আলী ছেলে কবরের পাশে এখনও খুঁজে বেড়ান বুকের ধনকে, একমাত্র অবলম্বনকে।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা রুমির পরিবার। আর্থিক সহায়তায় আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছে পরিবারটি। ইতোমধ্যে রুমির কর্মস্থল চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সহায়তা চেয়ে আবেদন করেছেন তার বাবা সৈয়দ আনোয়ার আলী।
ডা. জাফর হোসাইন রুমি চট্টগ্রামের বেসরকারি বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজের ৩য় ব্যাচের শিক্ষার্থী। ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে যোগদান করেন তিনি। ২০১৭ সালের আগস্টে জাফর হোসাইন রুমি ও কাউছার সুলতানার বিয়ে হয়।
রুমির বাবা সৈয়দ আনোয়ার আলী স্বাস্থ্য বিভাগের পরির্দশক হিসেবে ২০১১ সালে কর্মজীবন শেষ করেন। চাকরির মেয়াদ ৩ বছর বাকি থাকলেও পেনশনের টাকার জন্য অবসর নেন আনোয়ার আলী। পেনশনের টাকায় তিনি ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগান। ছেলে ডাক্তার হলে টানাটানি সংসার শেষে স্বচ্ছল হবেন সেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন আনোয়ার আলী।
২০১৫ সালে রুমি চাকরি পান। এরপর স্বচ্ছলতা শুরু হয়, ছেলের আয়ের টাকায় দিব্যি সংসার চলে যাচ্ছিল আনোয়ার আলীর। কিন্তু হঠাৎ ছেলেকে হারিয়ে তছনছ আনোয়ার আলীর সব স্বপ্ন। দিশেহারা আনোয়ার আলী পড়েছেন অর্থের অভাবে। তাই আগস্ট মাসে ছাড়বেন ভাড়া বাসা। পরবর্তী ঠিকানা কোথায় হবে সেটিও জানেন না তিনি।
আনোয়ার আলী বলেন, ১০ মে ডিউটি শেষে রাতে বাসায় ফেরে রুমি। সেদিন তার জ্বর ছিল। এরপর থেকে বাসায় ছিল সে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়াতে ১৬ মে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আমার ছেলে আর ঘরে ফিরে আসেনি।
কথাগুলোর সঙ্গে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল অপরপ্রান্ত থেকে। এক পর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন আনোয়ার আলী। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর তিনি বলেন, আগ্রাবাদে ভাড়া বাসায় থাকতাম। সেখানে আমার হাঁটা-চলাসহ নানা সমস্যা হচ্ছিল। তাই রুমিকে বলে গত ডিসেম্বরে বহদ্দারহাটে বাসা নেই।
'পেনশনের টাকায় ছেলেকে ডাক্তারি পড়িয়েছি, সেই ছেলে আমাকে রেখে চলে গেল। বুড়ো বয়সে আমার টাকা আয়ের সুযোগ নেই। মেজো ছেলে সবে চাকরিতে যোগ দিল। ছোট ছেলে পড়াশোনা করছে। তাই ২৫ হাজার টাকা বাসা ভাড়া কোথা থেকে দিব? এজন্য বাড়ির মালিককে জানিয়ে দিয়েছি, আগস্ট থেকে বাসা ছেড়ে দিব।
জাফর হোসাইন রুমির ছোট এক ভাই সম্প্রতি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। অন্যজন এখনো পড়াশোনা করছেন। চট্টগ্রামের রাউজানের সুলতানপুরে রুমিদের গ্রামের বাড়ি।
এদিকে, রুমির বাবার আবেদনের প্রেক্ষিতে মা ও শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১৪ জুন একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের মেডিকেল অফিসার প্রয়াত ডা. এসএম জাফর হোসাইন রুমির পিতা সৈয়দ আনোয়ার আলী নিতান্তই অসহায় এবং নিরূপায় হয়ে আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য আবেদন করেছেন। মানবিক এবং তার আর্থিক অসহায়ত্বের কথাটি সার্বিকভাবে বিবেচনা করে সবাইকে আর্থিকভাবে সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানানো যাচ্ছে।
মা ও শিশু হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, রুমির বাবা এসেছিলেন। তিনি অসহায়ত্বের কথা আমাদের জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে বিয়ষটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সবাইকে আর্থিকভাবে সহায়তার জন্য বলা হয়েছে।