শতবর্ষী বাড়িতে ২০০ বছরের পুরোনো ধাতব শিল্প!
দোতলা সাদা বাড়ি; উপর তলার চারপাশ ঘেরা টানা খোলা বারান্দা, রেলিংজুড়ে টেরাকোটার নকশা। নিচে উঠোনজুড়ে বৃষ্টিভেজা সবুজ ঘাষের চাদর বিছানো। বাগানবিলাসে ছেয়ে থাকা সদর দরজায় সাঁটানো সাইনবোর্ডে লেখা "Sukanta's Dhamrai Metal Crafts- Workshop & Showroom"। পাঁচ পুরুষ ধরে চলে আসা কাঁসা-পিতলের ব্যবসা এই বাড়িতে। বাইরের দিকের একটা ঘরের দরজা খোলা, রাস্তা থেকেই এক বয়স্কার দেখা মিলল ঘরে। নাম জানালেন তারা রাণী বনিক, সুকান্ত বনিকের মা। ছেলে আর মা মিলেই বসেন নিচতলার শো-রুমে। খবর পেয়ে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন সুকান্ত বনিক।
আজন্ম ধাতব ঝনঝনানির মাঝে বেড়ে ওঠা সুকান্তের স্বপ্ন ছিল পূর্বপুরুষদের বাণিজ্যকে বিশ্ব ঐতিহ্যের সাথে একাকার করে দাঁড় করানোর। ৩০ বছর ধরে সরাসরি এই শিল্পের সাথে যুক্ত থেকে সুকান্ত বাবুর পাওয়া না পাওয়ার গল্প জানালেন টিবিএসকে।
ঘর জুড়ে শিল্পকর্মের ভিড়
বাইরের ঘরটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা কাঁসা আর পিতলের নানা তৈজসপত্র। দেয়ালে ঝুলছে হাতে আঁকা কয়েকটি ছবি। যার মধ্যে একটি সুকান্ত বনিকের। ছবিটি এঁকেছেন তার স্ত্রী মানসী। বাকিগুলো তার পূর্বসুরীদের। ভেতরের আরও চারটি ঘরজুড়ে পিতলের তৈরি নানান মূর্তি। সূক্ষ্ম কারুকার্যে গড়া মূর্তিগুলোর মধ্যে আছে নানা আকৃতির হাতি, ঘোড়া, লক্ষ্মী প্যাঁচা, বুদ্ধ, রাধা-কৃষ্ণ, বিষ্ণু, নটরাজসহ বৈচিত্র্যময় বিপুল সৃষ্টি সম্ভার। শত-শত বছর পুরোনো বেশ কিছু ধাতব কয়েনও আছে এক ঝুড়িতে। পিতলের দাবার সেট, নকশি থালা, জামবাটি, আরও কত কী!
বড় বড় বেশ কিছু মূর্তির গায়ে লেখা আছে "বিক্রয়ের জন্য নয়"। সুকান্ত জানালেন বিশেষ এই মূর্তিগুলো আর বানানো হবেনা নতুন করে, তাই নিজেদের সংগ্রহে রেখে দিতে চান শেষ নিদর্শন হিসেবে। এসব শিল্পকর্মের বেশিরভাগই বনিক বাড়ির নিজস্ব কারিগরদের তৈরি। কিছু আছে দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে সুকান্তের সংগৃহীত।
নিচতলার পাঁচটি ঘর জুড়েই সুকান্তের মেটাল ক্রাফটসের শোরুম। দেশ-বিদেশ থেকে শিল্পের সমঝদার নানান ক্রেতা এই শোরুমে এসে নিজেদের পছন্দের শিল্পকর্মটি কিনে নিয়ে যান প্রায়ই। অনলাইনে একই নামে একটি পেইজ থাকলেও সেখানে মূলত প্রদর্শনীর কাজই করেন সুকান্ত। কুরিয়ারে পাঠালে সূক্ষ্ম কারুকার্যের বহু মূল্যবান জিনিস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, তাই সেই ঝক্কি নিতে চান না তিনি।
শুরু করেছিলেন বাবার দাদার দাদা!
প্রত্নতত্ত্ব আর ঐতিহ্য সংরক্ষণের ব্যাপারে বেশ আগ্রহ সুকান্তের। দুই শতকের পুরানো তাদের এই কাঁসা-পিতলের ব্যবসা। গল্পচ্ছলে সুকান্ত বললেন, "আমার বাবার নাম- ফণীভূষণ বণিক, তার বাবার নাম সর্ব্ব মোহন বণিক, তার বাবা ছিলেন শরৎচন্দ্র বণিক, তার বাবা লালমোহন বণিক, আর তার বাবা কৃষ্ণ চৈতন্য বণিক। তো আমার বাবার দাদার দাদা কৃষ্ণ চৈতন্য বনিকের সময় থেকে আমাদের বাড়িতে এই কাজ শুরু হয়েছে বলে ধারণা আমাদের। সে হিসেবে প্রায় ২০০ বছর ধরে বংশানুক্রমে চলছে কাঁসা-পিতল শিল্পের কাজ। এই বাড়িটার বয়সই প্রায় ১২০ বছর।"
কয়েক শতাব্দী ধরেই কাঁসা-পিতল শিল্পের রাজধানী হিসেবে খ্যাত ধামরাই-শিমুলিয়া অঞ্চল। "আমার পূর্বপুরুষেরা আগে আশেপাশের বিভিন্ন কারিগরের কারখানা থেকে অর্ডার দিয়ে জিনিসপত্র আনতো। এখান থেকে ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, মায়ানমার, এই সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে যেত নানা জিনিস। দেশভাগের আগে এই অঞ্চলের কাঁসা-পিতল শিল্পের কদর ছিল খুব। আমরা সরাসরি এই কারিগরি কাজের সাথে যুক্ত হই লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতিতে মূর্তি বানানো শুরু করা থেকে," বলেন সুকান্ত।
শুরুতে দোকানের নাম ছিল "ধামরাই মেটাল ক্রাফটস"। কিন্তু আশেপাশে সবাই ধামরাই মেটাল ক্রাফটস, ধামরাই মেটাল হ্যান্ডিক্রাফটস, ধামরাই মেটাল আর্ট এন্ড ক্রাফটস নামে দোকান নতুন দোকান শুরু করেছিল। তাই নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে নাম বদলে রাখেন "সুকান্ত বনিকের ধামরাই মেটাল ক্রাফটস"।
শতবর্ষী বাড়ি "সর্ব্ব সৌহার্দ্য"
ঢাকা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ধামরাইয়ের রথখোলায় অবস্থিত সুকান্ত বনিকদের শতবর্ষী বাড়িটি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, বাংলা বছরের হিসেবে ১৩০৭ সনে এই বনিক বাড়িটি তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল বলে জানান সুকান্ত। আশেপাশের অনেক বাড়ির মতোই কাঁসা-পিতলের ব্যবসার টাকায় পূর্বপুরুষেরা গড়েছিলেন এই বিশাল ভবন। দুই তলায় মোট ২৭টি ঘর নিয়ে তৈরি বাড়িটি। নিচতলায় এখন শোরুমের পাশাপাশি আছে পুজোর ঘর, অশৌচ ঘর, ব্যায়ামাগার আর কারিগরদের থাকার ঘর। উপর তলায় থাকেন পরিবারের সদস্যরা।
সুকান্তের ভাষ্যে, "ঠাকুরদার বাবা শরৎ চন্দ্র বনিক শুরু করেছিলেন বাড়ি বানানো। এরপর ঠাকুরদা সর্ব্ব মোহন ও তার অন্যান্য ভাইরা মিলে শেষ করেছিলেন বাড়ি বানানো। তখন যৌথ পরিবারের সবাই মিলে থাকতেন এই বাড়িতে।"
বাড়ি বানানোর জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে সুদক্ষ কারিগর এনেছিল বনিক পরিবার। এমনকি বাড়ির জন্য ইটের জোগান দিতে নিজস্ব ইটের ভাটাও তৈরি করেছিলেন সেসময়ে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল বাড়িটির। সুকান্ত বলেন, "আমার জন্ম ১৯৭৩ সালে। বাবাদের মুখে শুনেছি আমার পরিবারের সবাই সাত-আট মাস পায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে ইন্ডিয়ায় চলে গিয়েছিল শরণার্থী হিসেবে। যখন ওখানে গিয়ে পৌঁছায় তার কিছুদিন পরই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। এরপর দেশে চলে আসেন তারা। একাত্তরে আমাদের যা ছিল সবই চলে গিয়েছিল। খাট-পালঙ্ক, কাঁসা-পিতল, এমনকি ঘরের দরজা-জানালা পর্যন্ত সব খুলে নিয়ে গিয়েছিল। সে সময়টায় পরিবারের মানুষকে কলাপাতায়ও ভাত খেতে হয়েছে। জ্যাঠা সাক্ষ্মী গোপাল বনিক আর আমার বাবা মিলে আবার ব্যবসা শুরু করে ধীরে ধীরে আবার সব ঠিক করার চেষ্টা করেছিলেন।"
২০১৭-১৮ সালে সুকান্ত বনিক নিজের চেষ্টার আবার পুনরুদ্ধার করেন বাড়ির রূপ। নতুন করে মেরামত করার পর বাড়ির নাম দেন ঠাকুরদা সর্ব্ব মোহন আর নিজের হারানো ছেলে সৌহার্দ্যের নামে। বাড়ির আনাচে কানাচে নানান অলংকরণ, সাজসজ্জা আর গাছপালায় জড়িয়ে আছে সুকান্ত আর তার পরিবারের সদস্যদের পরম যত্নের ছাপ।
পাঁচ হাজার বছর পুরোনো মোমের শিল্প
দুইশো বছর আগে বংশে কাঁসা-পিতলের কাজ শুরু হলেও সুকান্তের মতে এই শিল্পে তাদের উল্লেখযোগ্য কাজগুলো করেছেন লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতিতে। "লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতি পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো একটা শিল্প। তবে এই এলাকায় পদ্ধতিটা খুব বেশি পুরানো না। এই মোমের কাজটা এখানে অনেক পরে শুরু হয়। যুদ্ধের পর মোশারফ হোসেন নামের এক লোক এখানে আনন্দ পাল নামের একজন কারিগর নিয়ে শুরু করেন লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতি। ১৯৭৪-৭৫ সালের দিকে কাজ শুরু করেন তিনি। আইডিয়াটা ছিল মোশারফ হোসেনের, মডেলের কাজটা করত আনন্দ পাল। আরেকজন ছিলেন শাহা মিয়া নাম, উনিও এই পদ্ধতিতে কাজ করতেন। মূলত ফোক স্টাইলের কাজ করতেন তিনি। উনার দেখাদেখি আরও কেউ কেউ টুকটাক কাজ শুরু করে," স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলছিলেন সুকান্ত বাবু।
রাষ্টবিজ্ঞানে পড়ালেখা শেষ করে পারিবারিক ব্যবসায় যখন নজর দেন সুকান্ত তখন থেকেই চেষ্টা ছিলো নতুন কিছু করার। তার ভাষ্যে, "আমার জ্যাঠা যখন মারা যায় ১৯৯২ সালে তারপর থেকেই আমি পুরো সময় জুড়ে এই কাজের সাথে যুক্ত হই। তখন কিছু ইয়াং ছেলেদের দিয়ে নতুন কিছু করার উদ্যোগ নেই। মেইন কাজটা তারা করে কিন্তু নকশা, আকৃতি ইত্যাদি কীভাবে কী করা উচিত সেই আইডিয়াটা থাকে আমার। তারা খুব স্কিলফুল লোক, যেকোনো জিনিস বুঝিয়ে বললে করতে পারে। এটা একটা টিম ওয়ার্ক, কারণ একজন মানুষ তো এই কাজটা করতে পারেন না। কেউ মোম দিয়ে বানায়, কেউ মাটি দেয়, কেউ ঢালাই করে, কেউ ঘষামাজা করে। তো ওই সময় থেকে আমরা যে কাজগুলো করছি এগুলো বেশ প্রমিনেন্ট, ভালো ডিজাইনের ভালো কাজ। যেটা দেশ বিদেশের বিভিন্ন মানুষজন যথেষ্ট পছন্দ করে, ভালোবাসে, মূল্যায়ন করে।"
কারিগরের শৈলী
বাড়ির পেছনের দিকে কারিগরদের ঘরে নিয়ে সুকান্ত দেখালেন কীভাবে তার সংগ্রহের অপরূপ মূর্তিগুলো গড়ে তোলা হয় এখানে। একসময় এখানে একসাথে ২২ জন কারিগর কাজ করলেও এখন কালের পরিক্রমায় সব মিলিয়ে চার-পাঁচ জন কারিগর কাজ করেন সুকান্তের অধীনে। ক্রমেই দেশে এই শিল্পের বাজারদর কমে যাওয়ায় কমেছে কারিগরদের আগ্রহও।
ছায়া ঘেরা ঘরের সামনের খোলা বারান্দায় বসে একজন কারিগর শিরিষ কাগজে ঘষছিলেন সদ্য বানানো পিতলের ঘোড়া। ঘরের ভেতর আরেকজন একটা বড় মোমের পাত কেটে তৈরি করছিলেন নানা আকৃতি। একটা টেবিলের উপর চট দিয়ে ঘেরা জায়গায় ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বালানো। তার নিচেই মোমের টুকরো রাখা। মোম নরম রাখতেই এই ব্যবস্থা। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিলো এই মোমে গড়া নানা মূর্তির খণ্ডিত অংশ। সুকান্ত বাবু সবিস্তারে বর্ণনা করলেন কয়েক হাজার বছরের পুরোনো এই পদ্ধতির আদ্যোপান্ত।
"শুরুতেই এই প্রক্রিয়ার জন্য আমাদের একটা বিশেষ ধরনের মোম বানাতে হয়। মৌচাকের মোম আর প্যারাফিন দিয়ে তৈরি করা হয় সেই মোম। মৌচাকের মোম বেশিরভাগ সময় সুন্দরবন থেকে আনা হয়। প্যারাফিন ইম্পোর্টেড। দুইটা মিলিয়ে বিশেষ ধরনের মোম এখানেই বানিয়ে নেওয়া হয়। মোম বানিয়ে ওই বক্সের ভেতর রাখা হয় নরম থাকতে।
"তারপর সেই মোম দিয়ে সম্পূর্ণ ফ্রি হ্যান্ডে মডেল বানাতে হয়। একটা মূর্তি বানাতে গেলে প্রথমে পা দুইটা বানায়, তারপর বডি, হাত, মাথা সব আলাদা আলাদা বানিয়ে গ্যাসের যে কুপিটা আছে ওইটার হিট দিয়ে মোমগুলি সব লাগানো হয়। এটা করার পর এর উপর যে অর্নামেন্টাল ডিজাইন আছে তার জন্য মোমের তারের মতো বানিয়ে ফিগারের উপর দিয়ে বাঁশের কাঠি দিয়ে নকশাগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়। মোমের কাজটা যখন হয়ে গেল, তারপরে আমরা এটার উপর তিন রকমের মাটি দেই। এটেল আর দোআঁশ মাটির পেস্ট দিয়ে মোল্ড বানানো হয়। প্রথমে মাটি গুলে একটা পেইন্ট ব্রাশ দিয়ে পেইন্ট করার মতো আস্তরণ দিতে হয়। রুম টেম্পারেচারে এটা শুকাতে হয়। বাইরে রোদে দিলে তাপে গলে যাবে মোম। তারপর আমরা সেকেন্ড লেয়ারটা দেই, যেটায় থাকে মাটি, বালি আর পাটের আঁশ। এরপর আমরা থার্ড লেয়ারে থাকে মাটি, বালি, একটু পাটের আঁশ আর ধানের তুষ। সবগুলো লেয়ারে মাটি পড়ে গেলে তখন মোল্ড তৈরি হয়।
"মোল্ডটাকে আমরা মাটির ওভেনে দেই। মোল্ডের নিচে দুইটা মোমের পাইপের মতো লাগানো হয় যেন ভেতরের মোম গলে বের হওয়ার আর তরল পিতল ঢুকানোর রাস্তা থাকে। ওভেনে দিলে আগুনের গরমে মাটিটা গরম হয় আর ভেতর থেকে মোমটা গলে বের হয়ে আসে। কিন্তু মোমের ডিজাইনটা মাটির মধ্যে থেকে যায়। পিতলটা গলিয়ে একদম পানির মতো করে ওই মোল্ডের ভেতর ঢেলে দিতে হয়। সেই পিতল ভেতরে গিয়ে মোল্ডের শেপটা নিয়ে নেয়। তিন থেকে পাঁচ ঘন্টা পরে যখন মাটিটা ঠাণ্ডা হয় তখন মাটি ভেঙ্গে ভেতর থেকে আসল জিনিস বের করতে হয়। এরপরে ঘষা মাজার কাজ থাকে।"
আগুনে পুড়ানোর সময় মোমের ছাঁচটি হারিয়ে যায় বলে পদ্ধতিটির নাম লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে বানানো ছাঁচ কেবল একবারই ব্যবহার করা যায়। প্রতিবার নতুন করে হাতে নকশা করে বানাতে হয় বলে প্রত্যেকটা নকশা হয় অনন্য। সঙ্গত কারণেই তাই এই পদ্ধতিতে বানানো শিল্পকর্মের দাম হয় অনেক বেশি। এখানে বানানো সর্বনিম্ন মূল্যের ধাতব মূর্তি ১৫০০ টাকার। কয়েকবছর আগে পাবনার এক মন্দিরের জন্য বানানো হয়েছিল ৫৫০ কেজি ওজনের ৬ ফুট আকৃতির এক সাধু মূর্তি। যার দাম ছিল ১২ লাখ টাকা।
সুকান্ত বনিকের শোরুমে থাকা সব সৃষ্টিকর্মই বানানো লস্ট ওয়াক্স পদ্ধতিতে। এভাবে একটা মূর্তি তৈরি করতে সময় লাগে দুই থেকে তিন মাসের মতো। কখনো কখনো ঢালাই করতে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায় পুরো কাজ। তখন আবার নতুন করে শুরু করতে হয় সব কিছু। চাইলেও খুব বেশি কাজ করা যায় না এই কারণে।
সুকান্তের মতে বাংলাদেশে আর কোথাও এই পদ্ধতিতে কাজ করা হয়। এই এলাকাতেই আর দুই-তিনটা পরিবারে চলছে এই কারিগরি শিল্প। তিনি বলেন, "ইন্ডিয়াতে কাঁসা-পিতলের প্রচুর কাজ হলেও বেশিরভাগই হয় ডাইস দিয়ে, হাতের কাজ খুব কমই হয় সেখানে।"
এই বনিক বাড়িতে এখন লস্ট ওয়াক্সের কাজ করেন দুইজন কারিগর। আগে থেকে কাজ করা প্রবীণ কারিগরদের কাছ থেকেই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারা।
অষ্টধাতুর দূর্গামূর্তি
২০১৭ সালে নিজস্ব উদ্যোগে সুকান্ত বনিক পারিবারিক পূজার জন্য বানিয়েছেন অষ্টধাতুর দূর্গামূর্তি। ৫০০ কেজির বেশি ওজনের প্রায় সাড়ে আট ফুট দৈর্ঘ্যের মূর্তিটি। তার মতে বাংলাদেশে আর কোথাও এত বড় অষ্টধাতুর মূর্তি নেই। প্রতিবছর শারদীয় উৎসবে এই অষ্টধাতুর প্রতিমাতেই দূর্গাপুজো হয় বনিক বাড়িতে।
ধাতব শিল্পের অগ্রগতিতে সুকান্তের প্রচেষ্টা
পারিবারিক পরম্পরার হাল ধরেছেন তিন দশক ধরে। এই পুরো সময় ধরে সুকান্ত বনিক চেষ্টা করে গেছেন কাঁসা-পিতল শিল্পের দেশীয় কদর বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করে তুলতে। কাজের শুরুতেই চেয়েছিলেন তরুণদের এই শিল্পে আগ্রহী করে তুলতে। তার মতে, প্রবীণদের অভিজ্ঞতা আর তরুণদের সাহস মিলেই নতুন মাত্রা পাওয়া সম্ভব শিল্পে।
বাংলাদেশের আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তা, কাঁসা-পিতল শিল্পের বিশেষজ্ঞ ম্যাথিও এস ফ্রিডম্যানের অনুপ্রেরণায় সুকান্ত বুঝতে পেরেছিলেন এই ধাতব শিল্পের ঐতিহ্যগত গুরুত্ব। তারই সহায়তায় ২০০২ সালে এম্বাসি থেকে ১৪ হাজার ৩০০ ডলারের আর্থিক সহায়তাও পেয়েছিলেন কাঁসা-পিতল শিল্পের উন্নয়নের স্বার্থে। সেই টাকায় কারিগরদের প্রশিক্ষণ, স্কুলের শিক্ষার্থীদের ওয়ার্কশপ করানোসহ ধাতব শিল্পের স্বার্থে নানা ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছিলেন সুকান্ত। সেমময়ই আমেরিকান সরকারের আমন্ত্রণে আমেরিকায় ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটরস প্রোগ্রামে গিয়েছিলেন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রক্রিয়া দেখতে। ২০০৬ সালে গিয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডে ওয়ার্কশপে। সে বছরের শেষের দিকে নেপালেও করেছিলেন ওয়ার্কশপ। ভারতের সাথেও কাজ করেছেন ২০১২-১৩ সালে। পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী গোষ্ঠী ডোকরা শিল্পীদের সাথেও কাজ করেছেন তিনি। দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করেছেন অমূল্য বহু কাজের নকশা।
ড্যানিশ দূতাবাসের সহায়তায় রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের নিয়েও ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছিলেন সুকান্ত বনিক। একটি এনজিওর মাধ্যমে সেই নারীদের তৈরি কাজগুলো দিয়ে তাদের সহায়তার জন্য তহবিল সংগ্রহের চেষ্টাও করেছিলেন।
করোনার সময় সরকারিভাবে কাঁসা-পিতল শিল্পের কারিগরদের জন্য কোনো সহায়তা না পাওয়াও সুকান্ত নিজেই তার বিদেশি বন্ধু আর এনজিওর সহায়তায় ধামরাই-শিমুলিয়া এলাকায় ত্রাণ বিতরণের উদ্যোগ নেন।
কেমন আছে কাঁসা-পিতল শিল্প
বহু বছর ধরে চেষ্টার পরও দেশে কাঁসা-পিতল শিল্পের অবস্থার উন্নতি হয়নি। দিনদিন কমছে এই শিল্পের কারিগর। সুকান্তের মতে, এই শিল্পের সবচেয়ে ভালো কদর ছিলো অবিভক্ত ভারতে। দেশভাগের পর ভারতের একটা বড় বাজার বন্ধ হয়ে যায়। অনেক ভালো কারিগর সেসময় বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যায়। ফলে দেশে কারিগর শূন্যতাও তৈরি হয়।
এখনো কাঁসা-পিতল শিল্পের সবচেয়ে বেশি চাহিদা ভারতে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে এধরনের পণ্য রপ্তানীতে সীমাবদ্ধতা অনেক। তাই চাইলেও আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যবসা বাড়ানোর উপায় নেই।
সূক্ষ্ম কারুকার্যের মূল্যবান ধাতব মূর্তির ক্রেতাদের একটা বড় অংশ বিদেশি পর্যটক। আগে নিয়মিতই সুকান্ত বনিকের বাড়িতে যাতায়াত ছিল বিদেশিদের। কিন্তু হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর পর্যটক আসাও কমে যায়। করোনার আড়াই বছরে তা আরো সীমিত হয়ে আসে।
হস্ত শিল্পের প্রান্তিক কারিগরদের প্রতি সরকারে সহায়তামূলক মনোভাব না থাকাকে এই শিল্পের উন্নতিতে বড় বাঁধা হিসেবে দেখেন সুকান্ত বনিক।
গড়তে চান জাদুঘর
ধাতব শিল্পের সূক্ষ্ম কারুকার্যের মাঝে লুকিয়ে আছে আমাদের ঐতিহ্য, পরম্পরা আর সৃষ্টিশীলতার পরিচয়। বছরের পর বছর অবিকৃত থাকে এসব সৃষ্টি। এসবের মাধ্যমেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে বেড়ায় সভ্যতার নিদর্শন। তাই সুকান্ত বনিক নিজেদের নানা সৃষ্টিকর্মসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে সংগৃহীত ধাতব শিল্পের নিদর্শন নিয়ে গড়তে চান কাঁসা-পিতল শিল্পের জাদুঘর।
সুকান্ত বনিক বলেন, "আট-নয় বছর ধরে দেশের নানা প্রান্ত ঘুরে কাঁসা-পিতলের নানা জিনিস সংগ্রহ করছি জাদুঘর করার জন্য। এ পর্যন্ত সংগ্রহে আছে থালা-বাটি, গ্লাস, জামবাটি, কালির দোয়াত, সিগারেটের পাত, হুক্কা, চামচ, দুধের ক্যানসহ বিভিন্ন রকমের আইটেম, যেগুলা এখন আর তৈরি হয়না। মানুষ আর দেখতে পায়না যেগুলো সেগুলো সংগ্রহ করে জাদুঘরে রাখতে চাই। পরবর্তী প্রজন্ম যেন এসব নকশা আর গুণগত মান দেখে ইন্সপায়ার্ড হতে পারে। ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন সোর্স থেকে নানা সময়ের নানা বিখ্যাত ডিজাইন সংগ্রহ করে সেগুলোর আদলে কাজ করিয়েছি সেজন্য। আমরা যে এত বছর ধরে কাঁসা-পিতলের কাজে সম্পৃক্ত আছি তবুও আগের ডিজাইন দেখে অবাক হয়ে যাই, যে মানুষ এত ভালো কাজ পারত।"
হাজার বছরের পুরোনো পাল আমলের নানা সৃষ্টির নকশা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কয়েক বছর ধরেই সুকান্ত বানাচ্ছেন বিষ্ণু, গণেশসহ নানা দেব-দেবীর মূর্তির সিরিজ। তার মতে, এই শিল্পের সবচেয়ে ভালো কাজগুলো হয়েছিল পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। সুকান্তের ভাষ্যে, "এই কাজগুলোর ৬০ শতাংশও যদি আমরা আবার বানাতে পারি সেটাও অনেক বড় অর্জন হবে। আমরা যদি এইটার ফোকাস ঠিক রেখে কাজ শেষ করে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে পারি তাহলে মানুষ বুঝতে পারবে এদেশের ঐতিহ্য কতটা সমৃদ্ধ।"