নিউ রাসমোহন বাসনালয়: শতবছরের পুরনো দোকানে মিলবে কারুকার্যখচিত কাঁসা-পিতলের বাসন কোসন
পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের বইয়ের দোকানগুলোর অলিগলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম বাজারের মধ্যে। সারাক্ষণ মানুষে গিজগিজ করা এই বাজারের দু'পাশের সারি সারি দোকানগুলো আকারে ছোট হলেও এগুলোতে গাদাগাদি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে হরেক রকম পণ্য। মুদি দোকান, পানের দোকান, বই, গয়না, বাসন কোসনের দোকান থেকে শুরু করে কতশত পুরোনো জিনিসের পসরা এই বাজারে!
হাঁটার মতো জায়গা না থাকলেও যানবাহনের ভিড় ঠেলে দিব্যি লোকজন হেঁটে চলেছে। এই রাস্তায় নিয়মিত যাদের যাতায়াত তাদের কাছে বোধহয় এটাই স্বাভাবিক। এই রাস্তায় প্রথমবার এসে লোকের ভিড়ে হাঁটতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই খেই হারিয়ে ফেলছিলাম।
গন্তব্যে ঠিকঠাক যাচ্ছিলাম কিনা তা নিশ্চিত হতে আশেপাশের দোকানিদের জিজ্ঞাসা করে করে এগোচ্ছিলাম। রাস্তার উল্টো পাশ থেকে কয়েকটি কাঁসা-পিতলের দোকান চোখে পড়তেই আশ্বস্ত হলাম রাস্তা ভুল হয়নি। এরপর একটি দোকানের সাইনবোর্ডে '৪৯, বাংলাবাজার' লেখা দেখে এগিয়ে গেলাম। শতবছরের পুরনো এই দোকানের বাইরের দিকে জায়গা সংকুলান না হওয়ায়-দোকানের ভেতরের দেয়ালে 'নিউ রাসমোহন বাসনালয়' সাইনবোর্ডটি টানিয়ে রাখা হয়েছে।
এই বাজারের বেশিরভাগ দোকানই বহু পুরোনো। 'নিউ রাসমোহন বাসনালয়' নামের কাঁসা-পিতলের বাসন কোসনের এই দোকানটির বয়স স্বাধীন বাংলাদেশের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা ঘটনার সাক্ষী ছোট্ট এই দোকানটি। বিক্রিবাট্টা কমে যাওয়ায় আগেরকার জৌলুস হারালেও এতো বছর পরেও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দোকানটি।
সময়ের পরিবর্তনে টিকে থাকার লড়াই
দোকানের সামনে যেতেই এক ক্রেতার আগমন। দোকানের কর্মীরাও ব্যস্ত ক্রেতাদের চাহিদামতো মালামাল বের করে দেখানো, দরদাম করা নিয়ে। ৪০ বয়সোর্ধ্ব এক নারী এসেছেন নাতনীর অন্নপ্রাশনে উপহারের জন্যে কাঁসার থালা, বাটি, মগ ও চামচ কিনতে। উপহারের জিনিস বলে দোকানীদের সুন্দর ও ভালো মানের বাসন দেখাতে বললেন। ওজন মেপে এগুলোর দাম দাঁড়ালো ৩ হাজারের কাছাকাছি। টাকার অঙ্কটা ক্রেতার জন্য বেশী হলেও-বাসনগুলো কেনার পর তার চোখেমুখে আনন্দ ভেসে উঠেছিল। সোনারঙা এই বাসনগুলো উপহার পাঠাবেন তার ছোট্ট নাতনীর মুখে ভাত অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে।
এককালে বনেদী পরিবারগুলো কাঁসার, পিতলের বাসন ব্যবহার করতো। এগুলোর মূল্যমান অন্যান্য ধাতুর চেয়ে বেশী হওয়ায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকেরা আভিজাত্য প্রকাশ করতে এসব ধাতুর বাসন কোসন নিজেরা ব্যবহারের পাশাপাশি মেহমানদারিতেও ব্যবহার করতো। তাই চোর ডাকাতরা বনেদী বাড়িতে চুরি করার সময় বস্তা ভরে হাড়ি, বাসনসহ নিয়ে যেত। কালক্রমে পিতল, কাঁসা ব্যবহারের প্রচলন হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু এখনো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ থেকে পূজা পার্বণের অনুষ্ঠানে পিতল-কাঁসার ব্যবহার চোখে পড়ে। যদিও তা আগের তুলনায় যৎসামান্য।
দোকানের মূল বিক্রেতার আসনে বসে ছিলেন সঞ্জয় সাহা। দোকানের বর্তমান মালিক জগন্নাথ সাহার বড় ছেলে তিনি। কর্পোরেট চাকরির ফাঁকে যখনই সময় মিলে পারিবারিক ব্যবসায় সময় দিতে চলে আসেন দোকানে। তার ছোট ভাই শুভ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি দোকানে এসে সময় দেন। জগন্নাথ সাহার বয়স হওয়ায় প্রায় সময় অসুস্থ থাকেন। ৫ কর্মচারীর পাশাপাশি দুই ছেলে মিলে বাবার দাঁড় করানো ব্যবসায় সহযোগিতা করে এখনো টিকিয়ে রেখেছেন।
শুধু তাই নয়, আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে তারা এতো বছরের এই ব্যবসাকে অনলাইন মাধ্যমেও নিয়ে গেছেন। অনলাইন হওয়ার পর সেখান থেকে ভালো পরিমাণ অর্ডার আসে, যা বিক্রিবাট্টা কিছুটা সচল রেখেছে। প্রতিদিন তাদের ২০-২৫ হাজার টাকার বেচাকেনা হয়। বিয়ে আর পূজা পার্বণের মৌসুমে তা কিছুটা বেড়ে যায়।
পৈতৃক ব্যবসার দীর্ঘ ইতিহাস নিয়ে সঞ্জয় সাহা বলেন, 'তিন পুরুষ ধরে আমাদের এই ব্যবসা। তাই আমি ও আমার ছোট ভাই মিলে এই ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে চাই। পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে আমার বাবা এই দোকানটি পেয়েছিলেন যুদ্ধের আগে। যুদ্ধের সময় দোকান বন্ধ রেখে পরিবার নিয়ে বাবা বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেরিয়েছেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ঢাকায় ফিরে আসেন। আবার নতুন করে এই দোকানটি খোলা হয়। তখন অবশ্য এখানে দোকান ছিল না। এই বাজারে রাস্তার আরেক পাশে আমাদের দোকানটি ছিল।'
দোকানের বাইরে সাজিয়ে রাখা বড় পিতলের সোনালী হাড়িগুলোয় আলো পড়ে চকচক করছিল। রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যে কারো নজর পড়বে এগুলোতে। দোকানের মেঝে থেকে দেয়াল সবখানে দ্যুতি ছড়াচ্ছে সোনালীরঙা পিতল কাঁসার বাসনগুলো। বাটি, থালা, মগ, প্রদীপ, স্কুল বেল, ছিপকোষ, কাঁসি, কাজলদানি, হামানদিস্তা, তরবারি, চা দানি থেকে ঘরে সাজানোর শোপিস সহ বাহারি ডিজাইনের শ'খানেক জিনিস পাওয়া যায় 'নিউ রাসমোহন বাসনালয়ে'।
তামা, পিতল, কাঁসার পাশাপাশি এই দোকানে দুর্লভ পাথরের তৈরি থালা ও মূর্তি পাওয়া যায়। এমনকি পূজার কাজে ব্যবহৃত চন্দনকাঠ, তিলক ও সিঁদুরও রাখা হয়েছে ভিন্নভিন্ন বাক্সের ওপর কাগজে নাম লিখে। কিনে নেওয়ার পাশাপাশি এইসব হাড়ি পাতিল ভাড়া দেওয়া হয় বলে জানালেন দোকানিদের একজন। যে কেউ চাইলেই ভাড়া নিতে পারবেন এমন নয়। কেবলমাত্র শুটিংয়ে ব্যবহার করার জন্য মাঝেমধ্যে এগুলো ভাড়া দেওয়া হয় বিক্রিত মূল্যের ৩০ শতাংশ দামে। বিয়েবাড়ি ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে ভাড়া না দেওয়ার কারণ হচ্ছে, রান্নার কালি লেগে হাড়ি পাতিল নষ্ট হয়ে যাওয়া। যদি ভাড়া নেওয়ার পর কোনো বাসনে দাগ লেগে ও অন্যান্য কারণে নষ্ট হয়ে যা-তখন ভাড়ায় চেয়ে বাড়তি মূল্য রাখা হয়।
কম দামে দিতে মানের সাথে আপোষ
সময়ের সাথে অন্যান্য জিনিসের মতো কাঁসা-পিতলের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ হারে। এগুলো অনেকের সাধ্যের বাইরে থাকায় কমে গেছে এই শিল্পের উৎপাদন ও বিক্রি। তাও কিছু লোক নিজেদের শখ পূরণ করতে কম দামের মধ্যে মনের মতো করে পিতল কাঁসার বাসন কোসন কাস্টোমাইজ করে বানিয়ে নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে মানের তুলনায় দামকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
সঞ্জয় সাহা বলেন, 'আগে কাঁসার ভাঙারি পাওয়া যেতো ২০০-৩০০ টাকার মধ্যে। আর এখন এই ভাঙারির দাম ১৫০০ টাকা। তাও কাঁচামাল খুঁজে পাওয়া যায় না খুব সহজে। তাই পুরোনো কাঁসা ভেঙ্গে পুনরায় নতুন করে বাসন কোসন ও অন্যান্য জিনিস বানানো হয়। পুরনো কাঁসার ভাঙারি পাওয়া যায় নয়াবাজার ব্রিজের পাশের বাজারে। ওখান থেকেই আমরা কিনে এনে সেগুলো গলিয়ে বাসন কোসন তৈরি করি।'
'এখন সবকিছুর দাম বাড়তি হলেও ক্রেতারা বেশি দাম দিয়ে কিনতে চান না। তাদের অভিযোগ এতো দাম বাড়লে কিনবেন কী করে? দামাদামিতে বনিবনা না হলে অনেকেই না কিনে চলে যান। তাই তাদের চাহিদা মাথায় রেখে কম দামে জিনিস দেওয়ার চেষ্টা করি। তখন ক্রেতাদের কথামতো ৪ কেজি ওজনের একটি বাসন ২ কেজির মধ্যে বানিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে কম ওজনের মধ্যে কাস্টোমাইজ করে বাসন বানানোর ফলে এটি দুর্বল মানের হয় ঠিকই, তবে একদিকে ক্রেতাদের প্রয়োজন মিটলো আবার অন্যদিকে দামটাও সাধ্যের মধ্যে থাকলো। কেনার সময় আমরা বাসনের ওজন, মান, ধাতুসহ সবকিছুই ক্রেতাদের আগে থেকে জানিয়ে দেই। দামের সাথে মানানসই না হলে অনেকেই কিনতে পারেন না বলে এমনভাবে কাস্টোমাইজ করে নিয়ে যান।'
কেজি দরে হিসেব করে বিক্রি করা হয় কাঁসা পিতলের বাসন। ক্রেতাদের সামনে প্রতিটি বাসন ধরে ধরে ওজন মাপার মেশিনে বসিয়ে তারপর দাম নির্ণয় করা হয়। কারুকাজ ও বানানোর প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে দামের হেরফের হয়ে থাকে। কিছু বাসনের শৈল্পিক কারুকাজের সম্পূর্ণটা কারিগররা হাতে করে থাকেন।
বিশাল এক থালা দেখিয়ে সঞ্জয় সাহা বললেন, এটার দাম ১০ হাজার টাকা। পাশের আরেকটি থালা দেখিয়ে বললেন ৮ হাজার টাকা দাম পড়বে এটির। এতো বেশি দাম কেন তা জানতে চাইলে তিনি থালাগুলোর পুরোটা জুড়ে করা কারুকার্য দেখিয়ে বললেন, এগুলোর নকশা সম্পূর্ণ ভিন্ন আর কারিগরদের হাতে করা। মেশিনে এইসব সূক্ষ্ম নকশা করা সম্ভব নয়। কারিগরদের পরিশ্রম আর খাটুনি বেশি হয়েছে বলে-দামটাও অন্যগুলোর তুলনায় কিছুটা বেশি।
নানা নকশা আর ভিন্নভিন্ন আকারের এইসব বাসন কোসন কীভাবে মেপে বিক্রি করা হয় তা খুব ভালোভাবে সঞ্জয় সাহা বুঝিয়ে বললেন। তার আগে তিনি দুটো পাত্র বের করে দিলেন হাতে নিয়ে ওজন পরীক্ষা করে দেখার জন্যে। সম আকারের দু'টি পাত্রের একটি ওজনে ভারী হলেও-অন্যটির তুলনায় কম ঝকঝকে ছিলো। এখানেই কাঁসা আর পিতলের পার্থক্য বলে জানালেন এই ব্যবসায়ী। কাঁসা দেখতে পিতলের চেয়ে কম উজ্জ্বল হলেও মানে ও গুণে সবদিক থেকে এটি পিতলের চেয়ে কয়েকগুণ টেকসই হয়। এখানেও যেন সেই প্রবাদ খাটে, 'চকচক করলেই সোনা হয় না'। কাঁসার বাসন স্বাস্থ্যের জন্যে যেমন উপকারী, তেমনি এটি কয়েক দশক পরেও উজ্জ্বলতা হারিয়ে নষ্ট হয়ে যায় না।
দামের ব্যাপারে জানাতে সঞ্জয় সাহা অঙ্ক কষার মতো হিসেব দিয়ে বোঝাতে গিয়ে বলেন, 'পিতলের কেজি ১৫০০ টাকা হলে একটি বাসনের ওজন যদি ১০০ গ্রাম হয়, তখন এটির দাম পড়বে ১৫০ টাকা। যেখানে ৪ হাজার টাকা কেজি দরের কাঁসার একটি বাসনের ওজন ১০০ গ্রাম হলে দাম রাখা হবে ৪০০ টাকা। এভাবেই বাসনের ওজন বাড়লে প্রতি গ্রামের জন্যে ৪০০ টাকা করে বাড়তে থাকবে। যদি বাসনে কারুকাজ করা থাকে-তবে কারিগরদের মজুরি হিসেব করে দাম কেজি দরের থেকে বেশি পড়বে।
শিল্পীর সাথে হারিয়ে যাচ্ছে শিল্প
দাম বাড়ায় চাহিদা কমে গেছে পিতল-কাঁসার বাসন কোসনের। যুগ যুগ ধরে এই শিল্পের সাথে জড়িত কারিগররা তাই জীবিকার তাগিদে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। তবু কয়েকজন কারিগর এখনো নিরলস পরিশ্রম দিয়ে এই শিল্পের প্রাণ টিকিয়ে রেখেছেন।
ভবিষ্যতে এই শিল্প টিকে থাকবে কিনা সে শঙ্কা থেকে সঞ্জয় সাহা বলেন, 'আগে আমাদের অনেক কারিগর ছিলো। কিন্তু চাহিদা আর বিক্রি বাট্টা কমে যাওয়ায় এখন কয়েকজন কারিগর রয়েছে। ধামরাই, জামালপুর, রাজশাহী, টাঙ্গাইল ও শিমুলিয়া ঘাটের ওপারে বাস করা কারিগরদের থেকে আমরা মালামাল এনে থাকি। আমাদের কয়েকজন কারিগর আছেন যাদের নকশা অন্যরা চাইলে করতে পারবে না। কারণ সবার হাতে সব কারুকাজ হয় না। এগুলো অনেকটা বংশ পরম্পরায় পাওয়া গুণ বলা যায়।'
সঞ্জয় সাহা ও তার ভাইয়ের ইচ্ছে নিজেদের সবটুকু চেষ্টা দিয়ে তিন পুরুষের এই ব্যবসা কে ভবিষ্যতে এগিয়ে নেওয়ার। অনলাইনে প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি আরও কয়েকটি স্থানে দোকান ব্যবসার সম্প্রসারণ করতে চান তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাই বাসন কোসনের ছবি তুলে প্রতিনিয়ত পোস্ট করে যাচ্ছেন তাদের 'নিউ রাসমোহন বাসনালয়' পেজ থেকে। আগ্রহী ক্রেতাদের অনেকেই পেজ থেকে অর্ডার করে থাকেন।
সঞ্জয় সাহা বলছিলেন, 'সরকারি সহযোগিতার অভাবে এই শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। যথাযথ মজুরি না পেয়ে কারিগররা নিজেদের সন্তানদের অন্য পেশায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। কীভাবে সরকারি প্রণোদনা পাওয়া যেতে পারে, সে ব্যাপারেও বেশিরভাগ লোকের ধারণা না থাকায় কেউই উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসেনি। বাঙালির এতো বছরের ঐতিহ্যের সাথে কাঁসা পিতলের যে সম্পর্ক তা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে। সামনের দিনে হয়তো কারিগর, ক্রেতা, বিক্রেতা আরো কমে যাবে। শখে দু একজন এগুলো কিনলে তো আর তা দিয়ে এই শিল্প টিকে থাকবে না।'