বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের অন্তিম রেলস্টেশন, ব্রিটিশ আমলের পর বদলায়নি
জায়গাটিতে পা রাখলে মনে হতে পারে হুট করে ঘড়ির কাঁটা প্রায় পৌনে একশো বছর পিছিয়ে চলে এসেছেন ব্রিটিশ আমলে। বাংলাদেশের সীমান্ত পেরিয়ে কয়েক কিলোমিটার পাড়ি দিলেই জায়গাটির দেখা পেয়ে যাবেন। জায়গাটির নাম সিঙ্গাবাদ রেলস্টেশন। এখানে সবকিছুতেই এখনও সেই ব্রিটিশ আমলের ছোঁয়া।
ভারতে রেলস্টেশনের সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। তার মাঝে কয়েকটি স্টেশন যুগের পর যুগ দাঁড়িয়ে আছে নিজস্ব সব গল্প নিয়ে। তেমনই এক স্টেশন সিঙ্গাবাদ।
বহু পুরোনো এই সিঙ্গাবাদ স্টেশন আকারে বেশি বড় নয়, তবু অনন্য। কেননা এটি ভারতের শেষ রেলস্টেশন।
সিঙ্গাবাদ স্টেশন নির্মিত হয়েছিল সেই ব্রিটিশ আমলে। তাপর ব্রিটিশরা স্টেশনটিকে যেভাবে রেখে গিয়েছিল, আজও ঠিক সেরকমই আছে। প্রায় পৌনে এক শতক পেরিয়ে গেলেও এই স্টেশনে এখনও কিছুই বদলানো হয়নি। সময় এখানে থমকে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের অন্তিম রেলস্টেশন সিঙ্গাবাদ অবস্থিত বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদা জেলার হাবিবপুর এলাকায়। এই স্টেশনটি ব্যবহৃত হয় পণ্যবাহী ট্রেন চলাচলের জন্য।
সিঙ্গাবাদ থেকে কয়েক কিমি পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে যায় মানুষ। আর এর পরে ভারতে আর কোনো রেলস্টেশন নেই। সীমান্তের এপারেই বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা।
জনবিরল স্টেশন
ট্রেন স্টেশন মানেই চারপাশে যাত্রীদের কোলাহল, হইচই। কিন্তু সিঙ্গাবাদ স্টেশনে পা পড়ে না কোনো যাত্রীর। স্টেশনটি সর্বক্ষণ বলতে গেলে জনশূন্যই থাকে। কারণ এখানে কোনো প্যাসেঞ্জার ট্রেন থাকে না।
বহুদিন এ স্টেশন কোনো কাজে লাগানো হতো না। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সিঙ্গাবাদ স্টেশন জনশূন্য হয়ে পড়ে। এরপর ১৯৭৮ সালে এই রুটে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
পণ্যবাহী ট্রেনগুলো ভারত থেকে বাংলাদেশে যাতায়াত করত। ২০১১ সালের নভেম্বরে পুরোনো চুক্তি সংশোধন করে নেপালকে চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন নেপালগামী ট্রেনও সিঙ্গাবাদ স্টেশন থেকে যাতায়াত শুরু করেছে।
বাংলাদেশ থেকে নেপালে খাদ্য রপ্তানি হয়। এসব খাদ্যবাহী ট্রেনের চালান রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ ট্রানজিট পয়েন্ট থেকে আসে। আর বাংলাদেশের প্রথম স্টেশন রোহনপুর।
ভারতীয় পত্রিকা উত্তরবঙ্গ সংবাদের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, '২০১৫ সাল থেকে সিঙ্গাবাদ-ওল্ড মালদা প্যাসেঞ্জার ট্রেনটির চলাচল বন্ধ রয়েছে। …রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, এনএফ রেলের অধীনস্থ এই ট্রেনটি ভারত-বাংলাদেশের শেষ সীমানা থেকে ওল্ড মালদা পর্যন্ত চলাচল করত। বন্ধ হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে দুই জায়গার মধ্যে এই ট্রেনের ভাড়া ছিল মাত্র পাঁচ টাকা। প্রতিদিন সিঙ্গাবাদ থেকে সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে ছাড়ত ট্রেনটি। যা সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে ওল্ড মালদা স্টেশনে পৌঁছোত। আর মালদা থেকে এই ট্রেনটি ছাড়ত সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে। সকাল ৭টা ২০ মিনিটে সিঙ্গাবাদ স্টেশনে পৌঁছোত।'
উত্তরবঙ্গ সংবাদের ওই প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে একটি কামরা নিয়ে চলাচল করত সিঙ্গাবাদ-ওল্ড মালদা প্যাসেঞ্জার ট্রেনটি। কিন্তু পরে যাত্রী কমে যাওয়ায় এই প্যাসেঞ্জার ট্রেনটির চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৪ সালে ট্রেনটি প্রতিদিনের বদলে সপ্তাহে একদিন করে চলাচল করতে শুরু করে। অবশেষে ২০১৫ সালে ট্রেনটিকে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই সিঙ্গাবাদ স্টেশন হয়ে পড়েছে জনশূন্য।
এ পথে যাতায়াত করতেন গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু
সিঙ্গাবাদ স্টেশন ব্যবহৃত হতো কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে ট্রেন সংযোগের জন্য।
ব্রিটিশ আমলের স্টেশন হওয়ায় মহাত্মা গান্ধী ও সুভাষচন্দ্র বসুও ঢাকায় যাওয়ার জন্য সিঙ্গাবাদ রুট ব্যবহার করতেন।
একসময় ছিল যখন দার্জিলিং মেইলের মতো ট্রেনও সিঙ্গাবাদ রুটে যাতায়াত করত, কিন্তু এখন এখান দিয়ে যায় কেবল পণ্যবাহী ট্রেন।
পুরোটাই ব্রিটিশ আমলের
প্রথম সিঙ্গাবাদ স্টেশন দেখে খানিকটা অদ্ভুত, বেখাপ্পা লাগতে পারে। কারণ স্টেশনটির প্রায় শতবর্ষী স্টেশনটির চেহারা সেই দেশভাগের পর আর বদলায়নি।
সিঙ্গাবাদ স্টেশনের সবকিছুই ব্রিটিশ আমলের। এখনও এখানে রাখা আছে কার্ডবোর্ডের টিকিট; এই টিকিট এখন আর কোথাও দেখা পাওয়া যায় না।
সিঙ্গাবাদ স্টেশনে রাখা টেলিফোনটিও সেই ব্রিটিশ আমলেরই। এছাড়া এ স্টেশনে সিগন্যাল দেয়ার জন্যও কেবল হ্যান্ড গিয়ার ব্যবহার করা হয়। এখানে কর্মচারীর সংখ্যাও খুব কম।
এখানে সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করে বাংলাদেশগামী ট্রেন
আগেই বলা হয়েছে, সিঙ্গাবাদ স্টেশনে আর কোনো প্যাসেঞ্জার ট্রেন থামে না। তাই এখানকার টিকিট কাউন্টার বন্ধ আছে।
তবে যেসব পণ্যবাহী ট্রেনকে রোহনপুর হয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে হয়, সেগুলো সিঙ্গাবাদে থামে। এই স্টেশনে থেমে পণ্যবাহী ট্রেনগুলো সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করে।
হেরিটেজ ঘোষণার দাবি
স্থানীয় মানুষের এখনও আশা, একদিন আবার তারা সিঙ্গাবাদ ট্রেনে চড়ার সুযোগ পাবে। দীর্ঘদিন ধরে তারা সিঙ্গাবাদ-ওল্ড মালদা রুটে আবারও প্যাসেঞ্জার ট্রেন চালু করার দাবি জানিয়ে আসছে। এছাড়া এই স্টেশনটিকে হেরিটেজ হিসেবেও ঘোষণার দাবি করছে স্থানীয়রা।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একবার সিঙ্গাবাদ স্টেশনকে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছিলেনও। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়ায় তার সে উদ্যোগ এখনও আলোর মুখ দেখেনি।