নারায়ণগঞ্জ: ডান্ডি, পাটকল, প্যাডেল স্টিমার, বেল প্রেস, গোয়ালন্দ-কলকাতা—সব কোথায় গেল!
তেঁতুল চা, পুদিনা চা, জিরা চা, আদা চা, ধনিয়া চাসহ ৩৫ রকম চায়ের নাম লেখা জসিম স্টলে, গেন্ডারিয়া রেল স্টেশনের সবচেয়ে জমজমাট দোকান। আর অবশ্য বেশি দোকানও নেই।
সকাল সোয়া ১১টা তখন। নারায়ণগঞ্জগামী একটি ট্রেন সামনে এগুনোর অনুমতি চাইছিল। কিন্তু উল্টোদিক থেকে আরেকটি ট্রেন না পৌঁছানো পর্যন্ত তার অনুমতি মিলবে না। গাড়িতে বসার জায়গা পেয়ে অবাক হলাম। আশপাশেও আরো কিছু সিট খালি দেখলাম।
মিনিট পাঁচেক পরে ট্রেন ছেড়ে গিয়ে শ্যামপুরে যখন পৌঁছাল তখন অনেক যাত্রী উঠল, আর আসন খালি থাকল না। আমার পাশে বসলেন নূরুল হক কোতোয়াল। পাঞ্জাবীর ওপর জ্যাকেট চাপিয়েছেন, মুখে লম্বা দাড়ি, মাথায় টুপি। আলাপে বললেন, 'বয়স বায়ান্ন। আগে গেন্ডারিয়াতে থাকতাম, সদরঘাটে গাইট (আমেরিকা বা জাপান থেকে আসত কাপড়ের বস্তা) ভাঙতাম, এখন নারায়ণগঞ্জে দোকান করি, এক্সপোর্টের রিজেক্ট কাপড়চোপড় বিক্রি করি।' নূরুল হকের কাছে জানলাম, যাত্রীদের অধিকাংশই টিকিট কাটে না।
'একসময় তো শুনছিলাম লাইনটা উঠায়া দিবে, তবে এখন পদ্মা সেতুর কল্যাণে লাইনটা আবার চাঙা হইতেছে। এই যে শ্যামপুরে নতুন স্টেশন হইছে। আগে তো ছিল না।'
নূরুল হক আজ চারটা টিকিট কেটেছেন। কারণ জানতে চাইলে বললেন,'আগে বিনা টিকিটে অনেক রেল চড়ছি। এখন সেগুলার কাফফারা দিতেছি।'
কমলাপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ মোট ১৪ কিলোমিটার, মাঝখানে পাঁচটি স্টেশন—গেন্ডারিয়ার পর শ্যামপুর, তারপর পাগলা, তারপর ফতুল্লা ও চাষাড়া।
ইতিহাসের পাতা থেকে
পূর্বাঞ্চলের প্রথম রেলপথ নারায়ণগঞ্জ-ফুলবাড়িয়া। ১৮৮৩ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরের বছরের শুরুতেই হয় ট্রায়াল রান। প্রথম ট্রেনে যাত্রী সংখ্যা ছিল ২ হাজার ১৭০ জন। যদিও ট্রেনের আসনসংখ্যা ছিল এর অর্ধেকেরও কম, কিন্তু মানুষের উৎসাহ ছিল ব্যাপক।
যাহোক, আনুষ্ঠানিক চলাচল শুরু হয় ১৯৮৫ সালের জানুয়ারির ৫ তারিখে। এই লাইনটিই পরে সম্প্রসারিত হয় বাহাদুরাবাদ ও জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত।
পাটের কারণে নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের গুরুত্ব বাড়ছিল দিন দিন। স্টিমার সার্ভিস চালু হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত। আর কলকাতা থেকে রাজবাড়ির গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত রেলপথ তৈরি হয়ে গিয়েছিল সেই ১৮৭১ সালে।
পথটা একরকম চক্রাকার হয়ে গিয়েছিল। ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে কাঁচা পাট এসে জড়ো হতো নারায়ণগঞ্জে আর নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টিমার করে তা গোয়ালন্দ হয়ে চলে যেত কলকাতা।
নারায়ণগঞ্জে বেল প্রেস বসেছিল একাধিক, যেখানে চাপ দিয়ে পাটের গাইট বাঁধা হতো। উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জ-গোয়ালন্দ-কলকাতা—এক টিকিটেই সবটা পেরুনো যেত।
সেসময় স্টিমার কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতা করে বিভিন্ন উৎসবের সময় রেল কোম্পানিগুলো স্বল্পমূল্যে ভাড়া নির্ধারণ করত। এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল ১৯২৭ সালের ১ অক্টোবর। পূজা উপলক্ষে গোয়ালন্দ থেকে কলকাতা পর্যন্ত একটি তৃতীয় শ্রেণীর ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। ২০৬ কিলোমিটার রাস্তায় নামমাত্র মাথাপিছু ৪ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করা হয়।
'পূর্ববাংলার রেলওয়ের ইতিহাস ১৮৬২-১৯৪৭' গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, ওই বিশেষ ট্রেনটির মাত্র চারটি স্টেশনে থামার ব্যবস্থা করা হয়। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে ট্রেনের যাত্রীদের জন্য কলকাতা পর্যন্ত তীর্থযাত্রীদের যাতায়াত ভাড়া, প্রধান দর্শনীয় স্থানের জন্য গেইট ভাড়া, কালীঘাটের জন্য পূজার ফি, রেলওয়ে নির্মিত নিজস্ব সিনেমা হলের একটি টিকিট ছাড়াও তিনবেলা বিনামূল্যে খাওয়ার ব্যবস্থা করে।
নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের ইতিহাসও এই বন্দর নগরীর সমৃদ্ধির নজির হাজির করে। নারায়ণগঞ্জ ক্লাব প্রতিষ্ঠা হয় ইউরোপীয়ান ক্লাব হিসাবে ১৮৮৩ সালে। শুরুর দিকে গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের লোকেরাই এর সদস্য হতে পারত। ভারতবর্ষীয়রা তো নয়ই এমনকি অন্য ইউরোপীয়রাও সদস্য হতে পারত না। ১৯০৫ সালে ক্লাবটি সম্প্রসারিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে কিছু অস্ট্রেলীয় আর আমেরিকানকে সদস্য হিসাবে গ্রহণ করা হয়। তারপর দেশ ভাগ হলে ভারতীয়রা সদস্য হওয়ার সুযোগ পায়।
এসএন মিত্র তাঁর 'আ কালেক্টরস পিস' নামের জীবনীগ্রন্থে লিখেছেন, ঢাকা ক্লাবের চেয়েও জমজমাট ছিল নারায়ণগঞ্জ ক্লাব। তিনি আরো জানাচ্ছেন, স্কটরা এখানে পাটের ব্যবসা করত, সেন্ট অ্যান্ড্রুজ ডে'তে তারা নাচত, গাইত আর স্কচ হুইস্কি পান করত।
সেকালেই নারায়ণগঞ্জ তকমা পেয়েছিল প্রচ্যের ডান্ডি হিসেবে। স্কটল্যান্ডের ডান্ডিতে শিল্পবিপ্লবের পর পাটজাত দ্রব্য ও সুতার অনেক কলকারখানা গড়ে ওঠে। ডান্ডির মতো নারায়ণগঞ্জও বিশ শতকে পাট ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। তাই ডান্ডির মুকুট মাথায় উঠেছিল এ বন্দর নগরীর।
চাষাড়া চলে এলো
হুড়মুড় করে লোক নামছে। নূরুল হক কোতোয়ালও দেখি আসন ছাড়লেন। জানলাম, চাষাড়া এসে পড়েছে ট্রেন। বারোটা বাজে তখন। অর্ধেক ট্রেন খালি হয়ে গেল এখানে এসে। কোতোয়াল বললেন, 'আপনার আর ৫ মিনিট লাগবে।'
আমি তারপর বসে বসে বগির আসন গুনলাম—ডবল সিটের ষাটটি আসন মানে ১২০ জন লোকের বসার ব্যবস্থা। তারপর চোখ গেল ওপরে। সিলিং থেকে ঝুলছে লোহার খাঁচায় বন্দি গোল গোল ১২টি পাখা, সাদা কাচের ঢাকনা দেওয়া ১০টি বাতিও দেখলাম। দেয়ালে নয়ন স্যারের কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন সাঁটানো।
যাত্রীদের মধ্যে মধ্যবয়স্কই বেশি। যুবক যারা তারা হাতল ধরে ঝুলছিল এতক্ষণ, নারী ও শিশু কম নেই বগিতে। শিউলি যেমন মায়ের সঙ্গে যাচ্ছিল সদাই কিনতে নিতাইগঞ্জ। ৩০০ বছর পুরোনো নারায়ণগঞ্জের এ পাইকারি বাজার। এখানে সারি সারি তেল, আদা-ময়দা আর ডালের কারখানা। বাতাসে তেল, খৈল আর ভুসির ঘ্রাণ। ওই বাজারে চাউলের আড়তই আছে ১০০টির বেশি, ময়দার কারখানা ৬৮টি, লবণের ৫০টি। প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক এ বাজারে কাজ করে।
শিউলিদের এবার উঠতেই হয়। নারায়ণগঞ্জ স্টেশনে ভিড়েছে ট্রেন। ফেরিঘাট থেকে কিছু মাছ কিনবে আগে শিউলিরা, তারপর যাবে নিতাইগঞ্জ, জানায় শিউলি।
এর মধ্যে মাইকের আওয়াজ শুনলাম—বাইরে ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের রেলের জমি ছাড়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে এবং উচ্ছেদের তারিখও ঘোষণা করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা রেল লাইনে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে সম্প্রতি।
'এই যে প্লাটফর্মে নামলেন এটিও ভেঙ্গে নতুন লাইন বসানো হবে, নতুন স্টেশন হচ্ছে খালের ধারে আরো উত্তরে,' বলছিলেন, সাইদুল ইসলাম সাইদ (ছদ্মনাম)। তার বাবা ছিলেন রেলের সিগনালম্যান। দেশভাগের আগেই যোগ দিয়েছিলেন কলকাতায়, দেশভাগের পর চলে আসেন নারায়ণগঞ্জ।
সাইদ বলছিলেন, 'তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কোয়ার্টার ছিল ওই খালি জায়গায়। ১১১টি পরিবার ছিল। আমরাও থাকতাম একটা ঘরে। রেলের কোলে-পিঠে চড়েই মানুষ হয়েছি আমরা। এ স্টেশন এত জমজমাট ছিল যে হাজার কয়েক লেবার ছিল। সুতার, পাটের, গেঞ্জির, চটের গাইট দুই নম্বর প্লাটফর্মে সারি ধরে রাখা হতো। তারপর গমের, ধানের, সুপারির, নারকেলের, সরিষার বস্তা একটির পিঠে আরেকটি চেপে দুই মানুষ সমান উঁচু হয়ে যেত।
'নারায়ণগঞ্জ গ্রেড-১ স্টেশন। এখানে দুইটি নিরাপত্তা বাহিনী ছিল, ওই যে ওইটা ছিল থানা, ষাটের দশকে এখানে দাঁড়ানোর জায়গা পেতেও কষ্ট হতো মানুষের। আমার বাবা শেষ দিকে স্টেশনের খারাপ অবস্থা দেখে কষ্ট পেতেন। একবার তো শুনছিলাম লাইনই উঠায়া দিবে। খালি লস দেয় রেল।'
সাইদ তার বয়স জানালেন ৬১ বছর। আরো জানালেন, শীতলক্ষ্যা, প্যাডেল স্টিমার আর রেলস্টেশন সব একসূত্রে বাঁধা ছিল এখানে। শীতলক্ষ্যা খুব স্রোতস্বিনী ছিল। রেল কর্তৃপক্ষই জাহাজঘাট নিয়ন্ত্রণ করত। হাঁটতে হাঁটতে দেখালেন—ওই যে ওইটা ছিল জাহাজের টিকিট কাউন্টার, আর গাছঘেরা ওই পশ্চিম ধারের জায়গায় মালপত্র এক্সামিনেশন ঘর ছিল, রেল বিদ্যুতের সুইঘর ছিল ওখানে, দুই নম্বর প্লাটফর্মের শেডে যে টিন ছিল একেকটার ওজন ছিল আড়াইমণ। কী ছিল না এই স্টেশনে? সব শেষ। অপচয়, দুর্নীতিতে রেল শেষ।'
অন্ধ গায়ক
অনেকের কাছে গল্প শুনেছি বিদেশে ট্রেনগুলোয় বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গান শুনিয়ে সুবেশী নারী কি পুরুষ সাহায্য প্রর্থনা করে। আমাদের বগিতে একজনই উঠলেন, যাত্রী নয়, তিনি একজন গায়ক। গান ধরলেন: সুরেলা গলা কিন্তু জন্ম থেকে অন্ধ। বাড়ি ছিল গাইবান্ধায়। নাম তসলিমউদ্দিন আকন্দ। বাবা ছিলেন ধনী লোক, ৩০ বিঘা জমির মালিক। ভাইদের মধ্যে বাঁটোয়ারা হয়ে যা পেয়েছিলেন, তসলিমউদ্দিন তা বসে বসে খেয়েছেন অনেকদিন।
পনেরো বছর হয় নারায়ণগঞ্জ এসেছেন। বড় দুই ছেলে নারায়ণগঞ্জে গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করে। বিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু তারা বাবা-মায়ের কোনো খবর নেয় না। নিতাইগঞ্জের কাছে এক জায়গায় থাকেন তসলিমউদ্দিন। স্ত্রীকে বাড়িতেই রেখে এসেছেন। গান গেয়ে যা ইনকাম, তা দিয়ে দুজনে ভাগ করে খেয়ে-পরে বাঁচেন।
সাইদের সঙ্গে হাঁটার একপর্যায়ে লেবার সর্দার মন্তাজ উদ্দিনের সঙ্গে দেখা। বয়স তার ৮৮। তার অধীনে এখন লেবার আছে মাত্রই একজন। এটা বিস্ময়কর। সাইদ তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, কেমন ছিল আগের দিনগুলো?
মন্তাজ উদ্দিন বললেন, 'এখন তো কিছুই নেই। সরকারিভাবে (নথিবদ্ধ) সাড়ে চারশ লেবার ছিল পার্মানেন্ট, তারপর আলগা (নথিবদ্ধ নয়) ছিল দুই হাজার। সর্দারই ছিল ৫০ জন। অনেকদিন এখান থেকে দুইটা জাহাজও ছাড়ত। আর চিটাগাং মেইল, সিলেট মেইল সব এখান থেকে ছাড়ত।
'ষাটের দশকে খাওয়ার হোটেলই ছিল এখানে ডজনখানেক। মিষ্টির দোকান ছিল ওই মাথায়। মাউরার (মারোয়ারি) হোটেলে বসার জায়গা পাওয়া যেত না। তখন দুই আনা চাইর আনা (ট্রেনে গাইট তোলার) রেট ছিল, তারপরও কামাইতাম এক দেড়শ টাকা। এখন সারা সপ্তাহে দুই চাইরশ টাকা হয় কি না সন্দেহ।'
মন্তাজ উদ্দিনের বাড়ি ছিল লক্ষীপুর। মা মারা গেলে জ্বালা-যন্ত্রণা সইতে না পেরে নারায়ণগঞ্জ চলে এসেছিলেন উনিশশো সাতচল্লিশ সালে।
জুতা সারাইকারী বিক্রম দাস
একষট্টি বছর বয়স বিক্রম দাসের। বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই নারায়ণগঞ্জে। এক নম্বর প্লাটফর্মে জুতা সারাইয়ের কাজ করছেন ত্রিশ বছর ধরে। তার বাবা পাট ও চামড়ার ব্যাপারী ছিলেন।
বিক্রম দাস বাবার ব্যবসা ধরতে পারেননি—বাবা মারা যাওয়ার আগেই ব্যবসা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আদমজী জুট মিল বন্ধ হওয়ার পর তো সবই শেষ হয়ে গেল।
বিক্রম দুঃখিত গলায় বলেন, 'আগে কাজ করতাম স্টেডিয়াম, বায়তুল মোকারমে ঘুইরা ঘুইরা (স্টেডিয়াম এলাকাতেই নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা বাস ভেড়ে)। আগে আমার এই কাজে ইনকাম খারাপ ছিল না। হাজার টাকাও কামাইছি দিনে। এখন দুইশ টাকা কামাইতেই জান বারাইয়া যায়। আগে (নব্বই দশকে) আধঘণ্টা পরপর ট্রেন আছিল। এই যে বারোটার পর আবার আড়াইটায় ডেমু ঢুকবে। মাঝখানে আর গাড়ি নাই।'
বিক্রমের ছেলেমেয়ে চারজন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকেন জিমখানা এলাকায়। এক মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা হোসিয়ারিতে কাজ করে। তবে সংসারের মূল চালক বিক্রমই এখনো।
প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটায় বিক্রম স্টেশনে আসেন। ফেরেন শেষ ট্রেন ছেড়ে গেলে রাত নয়টার পরে। আদমজী বন্ধ করার ঘোষণা এলে শ্রমিকরা স্টেশন বন্ধ করে দিয়েছিল, দেখেছেন বিক্রম।
বলছিলেন, 'শ্রমিকরা কাইন্দা গেছে, খুব কানছে। লাখো শ্রমিক ছিল এখানে। পুরা নারায়ণগঞ্জ বন্ধ হয়া গেছিল তখন।'
বিক্রম শুনেছেন পাকিস্তানের রানিও এসেছিলেন স্টেশনে। বলছিলেন, 'ইয়াহিয়া খান, আইয়ুব খান, টিক্কা খান তো শেষের দিকের পাকিস্তানি। পাকিস্তানের রানি যখন আসছিল, তখন তো পাকিস্তানীদের ভরাপুরা সময়। (১৯৬১ সালে রানি এলিজাবেথ আসেন নারায়ণগঞ্জে এবং আদমজী জুট মিল পরিদর্শন করেন।) আসার পর তাকে দেখার জন্য এত বেশি লোক ভিড় করছিল যে জাহাজঘাট ভেঙে পড়ছিল।
'ওই সময় নারায়ণগঞ্জের যা ব্যবসা ছিল সব এখন ছিট্টাভিট্টা (ছড়িয়ে) গেছে। কোনোটা গেছে মুন্সিগঞ্জে, কোনোটা পাবনায়, কোনোটা গেছে ঢাকায়। নাই, সেই নারায়ণগঞ্জ আর নাই।' বিক্রমের বুক চিড়ে বেরোল হাহাকার।
চাষাড়া গেলাম
তিনটার ডেমু ধরে গিয়ে নামলাম চাষাড়া স্টেশনে। নারায়ণগঞ্জ শহরে ঢোকার মুখ এটা। স্টেশনের দুই পাশে লাল লাল রেলঘর। কোনোটা টিকিট কাউন্টার কোনোটা স্টেশন মাস্টারের ঘর। যাত্রীদের বিশ্রামাগারও ছিল বুঝি এককালে। এখন লোকজন শেডের নিচেই বসে।
স্টেশনে কয়েকজন তরিকাপন্থি লোক দেখলাম। তাদের গায়ে সাদা বা গেরুয়া পাঞ্জাবি। স্টেশনেই তাদের দিন কাটে, রাতও। একজন বেশ উঁচুস্বরে গাইছিলেন,
আমি আছি তাই তুমি আছ
আমি না থাকলে তুমি নাই
আমি বিনে মালিক তোমার কিসের বড়াই।
লাইনের ধারে একজন ক্ষৌরকার দেখলাম। ভাঙা এক দেয়ালে বড় একটা আয়না ঠ্যাকা দিয়ে রেখেছেন। টেবিলে দুটি কেঁচি, তিনটি চিরুনি। হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার একটাই। পাশে ঠেস দিয়ে রাখা তার সব গাট্টি-বোঁচকা, মানে বিছানাপত্র, জামাকাপড় ইত্যাদি।
জানলাম স্টেশনেই থাকেন তিনি। নাম জীবন শীল। বাউল ধরনের মানুষ। দাড়ি গোঁফ কামিয়ে যা দেয় লোকে, তা-ই নেন। আমিও কামালাম। পঞ্চাশ টাকা দিলে খুশি হয়ে গেলেন।
তারপর স্টেশন ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলাম। স্টেশনে চায়ের দোকান ছাড়াও, মোবাইল ফোন সারানোর দোকান আছে, শরবতওয়ালা বসেছে, ঝালমুড়িওয়ালাও আছে।
একটা বইয়ের দোকান দেখলাম, কিন্তু বন্ধ সেটা। এই দোকানের গায়েই অনেকগুলো ছোট ছোট পোস্টার সাঁটানো। রতন বৈদ্যের পোস্টার। একদম ওপরে তিনটি ফোন নম্বর দেওয়া, তারপর লেখা আসাম থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। আরো লেখা—মন্ত্রশক্তি ও গাছের দ্বারা চিকিৎসা করা হয়। এরপর সমস্যাগুলোর ফিরিস্তি: স্বামী-স্ত্রীর অমিল, প্রেমের বাধা, বিয়ে বন্ধ, পাওনা টাকা আদায়, শত্রু দুশমনী, জিনের ও পরীর আছর, বান, জাদুটোনা, কুফরী, জমি বিবাদ ইত্যাদি।
তারপর লেখা—৭২ ঘণ্টার মধ্যে সমস্যার সমাধান, যাওয়া-আসা লাগে না, নাম ও বয়সের মাধ্যমে কাজ করা হয়। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ওষুধ ও তাবিজ পাঠানো হয়।
সবশেষে বড় অক্ষরে লেখা—মাটিরাঙ্গা, শুভলং।
ফিরলাম গেন্ডারিয়া
ঠিক সময়ের মাত্র তিন মিনিট পরেই ট্রেন এলো ৪টা পঞ্চান্ন মিনিটে। এ রুটের টিকিট হয় ছোট্ট লম্বা। শক্ত বোর্ডে অনেকটা টোকেনের মতো। আপ আর ডাউন টিকিট হয় আলাদা আলাদা রঙের। টাইপরাইটের টাইপে গায়ে লেখা—চাষাড়া হইতে ঢাকা। আসার সময়ের টিকিটে লেখা ছিল গেণ্ডারিয়া হইতে নারায়ণগঞ্জ। টিকিটের দাম ওই একই—১৫ টাকা।
গেন্ডারিয়া নামলাম সাড়ে পাঁচটায়। এখন দেখি স্টেশন জমজমাট। প্রতিদিনের মতো আজও এসেছেন ইলিয়াস মোল্লা। শক্তপোক্ত শরীরের বুড়ো মানুষ। জানলাম, ঠান্ডা কাশির সমস্যায় ভুগছেন বলে কাজকর্ম করতে পারেন না। থাকেন কাছের ১০০ কাঠা নামের এক জায়গায়। প্রতিদিন বিকালেই আসেন। সময়টা কাটিয়ে যান।
এখনকার যাত্রীদের অধিকাংশই অফিসফেরতা। এখানে টিকিট কাউন্টারটা তালাবদ্ধই থাকে। টিকিটঘরের ছাদে কার ত্বত্তাবধানে যেন বানানো একটা কবুতর ঘর! কয়েকটা কবুতরও চঞ্চল নড়াচড়ায়, দেখলাম।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। মাগরিবের আযান পড়বে। শীতও লাগছিল। ফিরতেই হবে এবার। স্টেশনের শেষ কেচি গেটের মুখে দেখলাম কয়লায় পুড়িয়ে মুরগির গোশত বিক্রি করছে। খেতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু মাথায় যেন কী একটা জ্যাম লেগে গেছে! নারায়ণগঞ্জ, আদমজী, প্যাডেল স্টিমার, বেল প্রেস, শীতলক্ষ্যা, নিতাইগঞ্জ, চাষাড়া, গোয়ালন্দ, কলকাতা, ডান্ডি—সব জট পাকিয়ে আছে মাথায়, ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত ঘুরতেই থাকবে।