যে বর্ষায় ভিজে গিয়েছিল লাইফ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ
সত্যজিৎ রায় যখন সমাপ্তির শুটিং করছিলেন তখন নিউজিল্যান্ডের আলোকচিত্রী ব্রায়ান ব্রেক ভারতে এলেন। তিনি এসেছেন বিশ্বজোড়া নামী ফটোসাময়িকী লাইফের জন্য ছবি তুলতে। ছবির বিষয় বর্ষা বা বৃষ্টি।
রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষ ছিল ১৯৬১ সালে। সত্যজিৎ রায় সে উপলক্ষেই নির্মাণ করেছিলেন 'তিন কন্যা'। ছবিটি আসলে তিনটি ছোটগল্প থেকে নির্মিত তিনটি চলচ্চিত্রের সংকলন। তার একটি হলো 'সমাপ্তি' আর তাতে অভিনয় করেছিলেন অপর্ণা সেন (যিনি নিজে পরে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা হবেন। ৩৬ চৌরঙ্গী লেন, পরমা, মি. অ্যান্ড মিসেস আয়ারের মতো ছবি বানাবেন)। অপর্ণার বয়স তখন পনেরোর শেষ।
অপর্ণার পিতা চিদানন্দ দাশগুপ্তও বিখ্যাত মানুষ ছিলেন। তিনি একইসঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র সমালোচক ও ইতিহাসবিদ। দেশভাগের বছর মানে ১৯৪৭ সালেই তিনি কালীসাধন দাশগুপ্ত, সত্যজিৎ রায় প্রমুখের সঙ্গে মিলে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরের বছরই বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক জাঁ রেনোয়া আসেন কলকাতায় 'রিভার' ছবি বানাতে। কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির সদস্যদের সঙ্গেই তিনি তখন সময় কাটান বেশি। চিদানন্দের বাড়িতে রেনোয়া গেলে ছোট্ট অপর্ণা নাকি তার কোলের ওপর বসে বলেছিল, তোমার মুখ এতো লাল কেন?
রেনোয়া উত্তর দিয়েছিলেন, বেশি মরিচ খাওয়া হয়ে গেছে তাই।
কলকাতায় এসে লাইফ ম্যাগাজিনের অলোকচিত্রী ব্রায়ানকে বেশি খোঁজ করতে হয়নি। তিনি চাইছিলেন বৃষ্টিকে ধরতে কোনো একটা সদ্য ফোটা মুখের ওপর। অপর্ণা তখন কৈশোর অতিক্রম করেছে, চেহারাটা দারুণ মায়াবী আর তাতে যেন লাবণ্য ঝরে অবিরত।
তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে গেলেন ব্রায়ান। পরালেন লাল শাড়ি, নাকে দিলেন সবুজ নথ। অপর্ণার নাক ফোঁড়ানো ছিল না বলে আঠা দিয়ে নথ লাগাতে হয়েছিল। অপর্ণা অবশ্য নথের রং নিয়ে আপত্তি তুলেছিল। বলেছিল, লাল শাড়ির সঙ্গে লাল নথই ভালো মানাবে। কিন্তু ব্রায়ান ছিল কর্তৃত্ববান মানুষ। ভাবটা এমন-যা বলেছি তাই করো। আসলে গ্রাম বাংলার রূপ তার চোখে আটকে ছিল। তিনি অপর্ণাকে বলেছিলেন, 'ধরে নাও মৌসুমের প্রথম বৃষ্টি হচ্ছে আজ, তুমি খুশিতে আটখানা। প্রথম বৃষ্টিকে তো বাংলার লোক কল্যাণকর বলেই ভাবে। সকলেই সে বৃষ্টি গায়ে মাখতে চায়। দূর করতে চায় সব ক্লান্তি। তুমিও সে অনুভব আনো মনে। তাহলে মুখে তা ভেসে উঠবে।'
দুটি বড় বড় পাত্রে পানি রাখা হয়েছিল, তা থেকে পানি ঢালছিল একজন। মোটমাট আধাঘণ্টা সময় লেগেছিল ছবিটি তুলতে। অপর্ণা পরে বলছিলেন, 'আমি জানতাম না ব্রায়ান কত বড় আলোকচিত্রী। ভেবেছিলাম বর্ষা-বাংলার রূপ সে ধরতে চায়। আমি রাজি হয়েছিলাম সাত-পাঁচ না ভেবেই। পরে সেটা যখন ছাপা হলো লাইফ ম্যাগাজিনে, বাবা আমাকে দেখালেন আমি তো অবাক না হয়ে পারিনি। ওই এক ছবির বদৌলতে আমি ছড়িয়ে গেলাম বিশ্বে।'
অপর্ণা সেদিন যেন ব্রায়ানের হাতের পুতুল বনে গিয়েছিলেন। ব্রায়ান তাকে যা বলেছিল সে তা-ই করেছে। ব্র্রায়ান যেন সত্যজিতের মতোই। ক্লোজ শটের মাস্টার ছিলেন সত্যজিৎ। এক ক্লোজ শটেই তিনি সময়- সমাজ, দুঃখ-সুখ, অর্থ-অনর্থ সব ধরে ফেলতেন। ব্রায়ানও এই ছবি দিয়ে একটা বাংলার মানুষের বর্ষা নিয়ে যে আবেগ-অনুভূতি তাই যেন অপর্ণার মুখচ্ছবিতে ধরে ফেলেছিলেন। পানির ফোঁটা, ত্বকের বুনট, মুখের অভিব্যক্তি সব ঠিক ঠিক ধরেছিলেন ব্রায়ান। তিনি অপর্ণাকে বলেছিলেন, 'অনুভব করো বৃষ্টিকে, গ্রহণ করো এর সব। রোদে পোড়া মাটির কাছে বৃষ্টির মতো আকাঙ্ক্ষিত কিছু হয় না। অনুভব করো সে সোঁদা গন্ধ। প্রথম বৃষ্টি মাটিতে প্রাণের সঞ্চার করে। তুমি সে প্রাণ স্পর্শ করো।'
ছাপা হওয়ার পর ছবিটি দেখে অপর্ণার মনে হয়েছিল, ছবিটি থেকে মাটির সোঁদা গন্ধ বের হচ্ছে। ব্রায়ান জানত, বাংলার বৃষ্টি রোম্যান্টিক। এখানকার সাহিত্যে, সংগীতে, চিত্রকলা, নৃত্যে বৃষ্টির অবিরল বন্দনা। এখানে বৃষ্টিতে প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন ঘটে। এখানকার বৃষ্টি বিরহ ব্যথা ভোলায়। শুধু রবী ঠাকুরের বৃষ্টির গানের সংখ্যা গুনতে গেলেই তো হিমশিম খেতে হয়।
ছবিটি ছাপা হওয়ার ৩৮ বছর পর ১৯৯৮ সালে ব্রুস কোনেউ নামের আরেক আলোকচিত্রী কলকাতা গিয়েছিলেন অপর্ণা সেনের সঙ্গে দেখা করতে। আসলে অপর্ণাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ১৯৬১ সালের ওই সেপ্টেম্বরে যখন ছাপা হয়ে বেড়িয়েছিল মনসুন সিরিজের ছবিগুলো, আর যার পুরোভাগে ছিল অপর্ণার ছবিটি।
আটানব্বইতে খুব বন্যা হয়েছিল বাংলায়। অপর্ণা ফ্যাক্স করে ব্রুসকে বলেছিল, এখনই এসো না, সারা দেশ পানিতে ভাসছে। কিছুদিন বিরতি নিয়েছিল তাই ব্রুস। তারপর কলকাতায় এসে যে হোটেলে উঠেছিল ব্রুসকে সেখানকার এক কর্মী বলেছিল, অপর্ণা সেন কিন্তু খুব বড় মাপের মানুষ, তুমি ভেবে চিন্তে কথা বলো।
ব্রুস তখন হেসেছিল, যেন বলতে চাইছল, আমাকে বলতে হবে না, এই মেয়ের মুখ আমি ভালো করেই চিনি। তবে হোটেল কর্মীও ভুল বলেননি, এখানে বয়স পঁচিশ হওয়ার আগেই অপর্ণার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল, সারা দেশে। সে তো বড় মানুষই। সত্তরটি ছবিতে অভিনয় করেছেন অপর্ণা, ১৬টি ছবি পরিচালনা করেছেন।
ব্রুসের অবশ্য মন জুড়ে আছে পনেরো-ষোলর অপর্ণা ও তার ওই ভুবনমোহিনী রূপ। অপর্ণা তাকে বলেছিল, 'জানো ছাপা হওয়া ছবিটি আমি প্রথমে মোটেও পছন্দ করিনি। কেমন বুড়ি বুড়ি লাগছিল দেখতে। দাঁতগুলো সব দেখা যাচ্ছিল। নিজেকে আমার ভালোই লাগছিল না। তার ওপর আবার সত্যজিৎ রায়ের শিল্প নির্দেশক বংশীবাবু বলে বসলেন, তুই তো এমনই দেখতে। এর চেয়ে ভালো তো নোস। রাগ যা হয়েছিল না, কী আর বলব, কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তবে ছবিটি এখন এই এতো বছর পরেও আমার প্রিয় ছবিগুলির একটি।'
লাইফ ম্যাগাজিনে মনসুন সিরিজ ছাপা হয়েছিল ১৯৬১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। লাইফে তখন অভিনব সব ছবি ছাপা হতো। তবে রঙিন ছবি তখনো ততটা বিস্তৃতি লাভ করেনি। ব্রায়ানের মনসুনকেই বিশ্বের প্রথম ফটো এসে (Photo essay) ধরেন অনেকে। ওই বছরই ছবিগুলো প্যারিস-ম্যাচ, কুইন, ইপোকা নামের সামিয়কীতেও ছাপা হয়েছিল। জওহরলাল নেহেরু দেখে নাকি বলেছিলেন, ব্রায়ান এতো ভালো করে ভারতকে বুঝলো কিভাবে?
এবার আসা যাক ছবির সঙ্গে যুক্ত লেখা বিষয়ে। মূলত মধ্যযুগের কবি কালিদাস, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পল্লীকবির বর্ষার কবিতা ছাপানো হয়েছিল ব্রায়ানের মনসুন সিরিজের সঙ্গে। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন জসীম উদ্দিন সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি (জসীম উদ্দিন) নতুন ধারার কাব্য রচনার সূচনা করেছেন। তার আগে আর কোনো কবি মেঘের রূপ ও রংবৈচিত্র্য নিয়ে এতো বিশদ করে লেখেনি।
তিনি লিখেছেন:
কালো মেঘা নামো নামো, ফুল-তোলা মেঘ নামো,
ধূলট মেঘা, তুলট মেঘা, তোমরা সবে ঘামো!
কানা মেঘা, টলমল বারো মেঘার ভাই,
আরও ফুটিক ডলক দিলে চিনার ভাত খাই।
অথবা,
আজিকার রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাটে মেঘের আঁড়ে
কেয়া-বন-পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।
বর্ষা মঙ্গল বয়ে এনেছিল ব্রায়ানের জন্যও। মনসুন সিরিজের জন্য তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছেন। তার ওই সিরিজের ২৩টি ছবি অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল গ্যালারি যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে। এখনো বিশ্বের কোথাও যদি ব্রায়ানের ছবির প্রদর্শনী হয় তাতে মনসুন সিরিজের ছবি থাকেই। ভুলতে পারেন না অপর্ণাও, ওই একটা আটপৌরে দিনের কথা, অজান্তেই তা কেমন করে বিশেষ হয়ে গেল।