দক্ষিণের বিলে বিলে জলাবদ্ধতা: চরম দুর্দশায় ৪ জেলার কয়েক লাখ মানুষ
সেপ্টেম্বরজুড়ে টানা বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চার জেলার কয়েকটি বিলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ওইসব এলাকার মানুষেরা এখন সীমাহীন দুর্দশায় দিন পার করছেন।
বিশেষ করে- যশোরের ভবদহ অঞ্চল, খুলনার বিল ডাকাতিয়া, বাগেরহাটের বাদোখালী বিল ও সাতক্ষীরার পৌরসভা ও সদর উপজেলার হাজার হাজার একর জমি এখনও নিমোজ্জিত রয়েছে পানিতে।
খুলনা
জলাবদ্ধাতার কারণে খুলনার বিল ডাকাতিয়া এলাকার মানুষেরা মারাত্মভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ অঞ্চলটি খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত।
সেখানে জলাবদ্ধতার ফলে ২০টি গ্রামের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যানুযায়ী, বিল ডাকাতিয়ার পানি নিষ্কাশন হয় ডুমুরিয়া উপজেলার ১১টি নদ-নদী দিয়ে।
এই নদীগুলোর উপরে পাউবো ৭৫টি স্লুইচগেট তৈরি করেছিল ১৯৬০ সালে। বর্তমানে যার মধ্যে ৫৪টি স্লুইচগেট অকোজ অবস্থায় আছে।
পাউবো খুলনা -১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহমান তাজকিয়া বলেন, "স্লুইচগেট দিয়ে পানি সরতে না পারায় এমন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। যেসব স্লুইচগেট পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে, সেগুলো সচল করার কাজ হচ্ছে।"
বাগেরহাট
বৃষ্টি পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার বাদোখালী বিলেও।
স্থানীয়রা জানান— সদর উপজেলার যাত্রাপুর, কাড়াপাড়া ও ষাটগম্বুজ ইউনিয়ের প্রায় ৭,০০০ একর জমি নিয়ে বাদোখালী বিলের বিস্তৃতি। সেপ্টেম্বরের বর্ষার পানি জমা হয়ে ওই এলাকার ১৩টি গ্রামের প্রায় ৫০,০০০ মানুষ জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছেন।
পাউবো বাগেরহাটের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মাদ আল বিরুনী বলেন, "বিলের পানি নামার জন্য বিভিন্ন খালের মুখে থাকা ৪টি স্লুইজ গেট নষ্ট থাকায় ঠিকমতো পানি নামতে পারছে না। এগুলো সংস্কারের জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্লুইজগেটগুলো মেরামত করা হবে।"
সাতক্ষীরা
বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত না হওয়ায় এখনো জলাবদ্ধ রয়েছে সাতক্ষীরার প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রাম। এতে বিপাকে পড়েচেন কমপক্ষে ৫০,০০০ মানুষ।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সাতক্ষীরা পৌরসভা ও সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র পথ হচ্ছে বেতনা নদী।
পাউবো সাতক্ষীরা-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, "বেতনা নদীর অনেক স্থানে পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে পানি অনেক এলাকায় নিষ্কাশন হচ্ছে না।"
তবে যেসব স্থানে পলি জমেছে, সেসব স্থানে দ্রুত খনন করে পানি সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে, সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, "বেতনা নদী খননের জন্য ৪৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২১ সালের জুনে কাজ শুরু হয়। এর কাজ শুরুর আগেই জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্টদের আমরা বলেছিলাম, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা সংকট একটুও কমবে না, বরং বাড়বে— তা-ই হয়েছে। এখন সাতক্ষীরা পৌরসভাসহ সদর উপজেলায় জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।"
যশোর
এলাকাগুলো পরিদর্শন করে দেখা গেছে, জলাবদ্ধতা নিয়ে সব থেকে বেশি কষ্টে আছে যশোরের ভবদহ অঞ্চলের মানুষেরা।
ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালী জানান, গত ৪৪ বছরে ভবদহ এলাকার মানুষের দুঃখের সীমা নেই। বছরের অন্তত ৬ মাস তাদের বাড়ি-ঘর পানিতে নিমজ্জিত থাকে।
তিনি বলেন, "২ মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পাঠদানের উপযোগী থাকে না। চলাচলের রাস্তার উপরে কোমর সমান পানি থাকে। এ বছরে বৃষ্টি বেশি হওয়ায় প্রায় তিন লাখ মানুষের কষ্ট আরও বেড়েছে।"
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে– দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বন্যা, লবণ পানি প্রবেশ রোধ, খাদ্য, আবাসন ও কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য ষাটের দশকে ভবদহ এলাকায় ২৪ ও ২৫ নং পোল্ডার নির্মাণ করা হয়। ফলে ২০ বছরে ওই এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হলেও পরবর্তীতে নদীতে পলি জমা হয়ে উচু হয়ে যায়।
একইভাবে ভবদহে নদীর পলিযুক্ত পানি প্রবেশ করতে না পেরে, বিলের উচ্চতা নদীর তুলনায় কমে যায়। এ কারণে বর্ষা মৌসুমে ভবদহ এলাকায় পানি জমা হলে তা আর বের হতে পারে না।
ভবদহ এলাকার বিস্তৃতি রয়েছে যশোরের মনিরামপুর, কেশবপুর, অভয়নগর ও খুলনার ডুমুরিয়া এবং ফুলতলা উপজেলার অংশ বিশেষ নিয়ে।
পাউবো থেকে ১৯৯০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত মোট ২১টি প্রকল্পে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় করেও ওই এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন করা যায়নি।
রণজিৎ বাওয়ালী বলেন, "ভবদহে মোট ২৭টি বিল রয়েছে। হরি নদীর স্লুইস গেট দিয়ে এর পানি বের হওয়ার একমাত্র পথ। তবে সেই নদীর মৃত্যুর ফলে সেই ব্যবস্থা কার্যকর নেই।"
তিনি বলেন, "২০২২ সাল ৪৫ কোটি টাকার 'ভবদহ ও তৎসংলগ্ন বিল এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ' প্রকল্প হাতে নেয় পাউবো। আমরা এই প্রকল্পের বিরোধীতা করে টাইডাল রিভার ম্যাজেমেন্ট টিআরএম প্রকল্প নিতে আন্দোলন করেছিলাম।"
"তবে আমাদের কোনো কথায় কান না দিয়ে পাউবো নিজেদের মত করে প্রকল্প নেওয়ায় আমরা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখন বিকল্প উপায়ে আমডাঙ্গা খাল দ্রুত সংস্কার না করলে এই পানি সরানো যাবে না," বলেন রণজিৎ।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ ব্যাণার্জী বলছেন, "বর্তমানে ৯টি পাম্প দিয়ে হরি নদীতে পানি তুলে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া, হরি নদীর নাব্যতা বাড়াতে সেই ৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার খননও চলছে।"
এছাড়া শিগগির আমডাঙ্গা খাল সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।