৫,০০০ পিয়ানো! নিষ্ক্রিয়, নিঃসঙ্গ পড়ে আছে সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়গুলোয়
কেরানীগঞ্জের জয়নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির একপাশে পড়ে আছে কালো রঙের একটি ডিজিটাল পিয়ানো। দিনের পর দিন অব্যবহৃত পড়ে থাকায় নিষ্ক্রিয় পিয়ানোটির ওপরে জমেছে ধূলোর পুরু আস্তর।
রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে কেরানীগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী শামসুল হক বলেন, "পিয়ানোটি ইতোমধ্যেই উইপোকা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং এর বিভিন্ন অংশ বেরিয়ে আসছে।"
২০১১ সালে কোরিয়া সরকার বাংলাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে ৫ হাজারটি ডিজিটাল পিয়ানো দিয়েছিল তার মধ্যে এটি একটি। বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পিয়ানো বাজাতে না পারায় গত ১১ বছর ধরে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে আছে এটি।
পিয়ানো প্রস্তুতকারী দক্ষিণ কোরিয়ান বুইয়ং কোম্পানির মুখপাত্রের মতে, সে সময়ে প্রতিটি পিয়ানোর দাম ছিল প্রায় এক লাখ টাকা। বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের গান শেখার সুযোগকে আরও প্রসারিত করতেই দেওয়া হয়েছিল পিয়ানোগুলো। তবে বছরের পর বছর গড়িয়ে গেলেও এর উদ্দেশ্য সফল হয়নি সামান্যতম।
স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী মাস্তুরা জাহান সারা জানায়, সে জানে স্কুলে পিয়ানো আছে, কিন্তু সে বাজাতে পারে না। আরেক ছাত্র এহানুল হক আলিদের বক্তব্য, "আমি ঘরে এটি (পিয়ানো) দেখেছি কিন্তু আমি বাজাতে পারি না।"
শিক্ষকরা স্বীকার করেছেন যে, তারা পিয়ানোর ব্যবহার করতে পারেননি।
জয়নগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা হালিমা খাতুন জানান, প্রায় ১০ বছর আগে সরকার পিয়ানো দিয়েছিল। পিয়ানো ব্যবহারের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে শিক্ষকরা কখনই এটি বাজাতে শেখেননি।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকা আরও বলেন, "আমরা নিয়মিত যা করি তা হল, পিয়ানো পরিষ্কার করা এবং এটি ঢেকে রাখা।"
স্কুলের দুই শিক্ষকা হাসিনা রাজ্জাক ও নুরুন নাহার আক্তার ঢাকায় একবার একদিনের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন।
সহকারী শিক্ষকা হাসিনা রাজ্জাক বলেন, "প্রশিক্ষণ শেষে আমরা রুমের বাইরে পিয়ানো নিয়ে আসতাম এবং সকালের অ্যাসেম্বলিতে রেকর্ড করা গান বাজাতাম।"
"একদিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে পিয়ানো বাজাতে শেখা অসম্ভব", যোগ করেন তিনি।
শিক্ষিকা জানান, পিয়ানোটি এখন থেকে পাঁচ বছর আগে শেষবারের মতো সকালের অ্যাসেম্বলির জন্য বের করা হয়েছিল। একজন স্থানীয় সঙ্গীতজ্ঞকে একবার পিয়ানো বাজানোর জন্য আনা হয়েছিল স্কুলে, তবে তিনিও জানতেন না এটি কীভাবে বাজাতে হয়।
তিনি বলেন, "পিয়ানো বাংলাদেশের সাংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে আদর্শ উপহার নয়। কোরিয়ান সরকারের উচিত ছিল তাদের হারমোনিয়াম এবং তবলার মতো ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র উপহার দেওয়া।"
তাহলে পিয়ানোর ভবিষ্যৎ কী? অনিশ্চিতভাবে প্রধান শিক্ষকা উত্তর দিলেন, "যতদিন পারি আমরা পিয়ানোটির যত্ন নেব।"
একই এলাকার পাঁচদোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোরিয়ান পিয়ানোর ভাগ্যেও জুটেছে ওই একই পরিণতি। পিয়ানো রাখা হয়েছে লাইব্রেরিতে। স্কুলের দুই শিক্ষক পিয়ানো বাজানোর প্রশিক্ষণও নিয়েছেন।
সিনিয়র শিক্ষকা আমেদা খাতুন বলেন, "আমার মনে হয় অন্তত এক বছরের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, অথচ আমি মাত্র ৩ দিনের প্রশিক্ষণ পেয়েছি। এটি খুবই কম।"
"তারা আমাদেরকে পিয়ানো চালু ও বন্ধ করা এবং রেকর্ড করা গান বাজানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন", যোগ করেন আমেদা।
তিনি আরও জানান, অ্যাসেম্বলিকালীন প্রায়ই তারা পিয়ানো বাজাতেন। তবে তাতে বাজতো রেকর্ড করা জাতীয় সঙ্গীত এবং অন্যান্য দেশাত্মবোধক গান।
যে উদ্দ্যেশে পিয়ানো উপহার দেওয়া হয়েছিল, তা যথাযথভাবে পূরণ হচ্ছে না বলে জানান শিক্ষকরা। এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে গানের শিক্ষকও নেই বলে জানান তারা।
পাঁচদোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকা আতিয়া আক্তার বলেন, "আমরা পিয়ানো বাজানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করিনি। ফলে রেকর্ড করা গানের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের শেখাতে হয়।"
কেরানীগঞ্জের ভাওয়াল মনোহরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিয়ানোরও ওই একই পরিণতি হয়েছে।
ভাওয়াল মনোহরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শামীমা নাজনীন জানান, স্বাধীনতা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারা পিয়ানো বের করেন এবং রেকর্ড করা গান বাজায়।
শামীমা নাজনীন বলেন, "এমন একজন শিক্ষক আপনি পাবেন না, যিনি পিয়ানো বাজাতে পারেন।"
এমনকি শিক্ষকের অফিস কক্ষে রাখা পিয়ানোটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের স্পর্শ করারও সুযোগ নেই। প্রধান শিক্ষিকা জানান, জায়গা স্বল্পতার কারণে শিক্ষকদের অফিস কক্ষে রাখতে হয়েছে পিয়ানোটি।
পিয়ানো সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুহিবুর রহমান জানান, চলতি বছরের এপ্রিলে তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে যোগদান করেছেন।
তিনি বলেন, "এই প্রথম আমি (বাংলাদেশের) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (কোরিয়ান) পিয়ানোর কথা শুনছি।"
পিয়ানো ছাড়াও কোরিয়া সরকার বাংলাদেশের বিভিন্ন স্কুলে ৫০ হাজার ব্ল্যাকবোর্ড দিয়েছে।
বাংলাদেশই একমাত্র দেশ নয় যেখানে কোরিয়া সরকার পিয়ানো উপহার দিয়েছে। কোরিয়ান কোম্পানি বুইয়ং ইন্দোনেশিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড, পূর্ব তিমুর এবং মালয়েশিয়ায় প্রায় ৬০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি করেছে; সেখানে ৫ লাখ ব্ল্যাকবোর্ড এবং ৬০ হাজার ডিজিটাল পিয়ানো উপহার দিয়েছে।