বাস স্পটিং: বাস ‘ধরা’ যাদের নেশা!
মানবজাতির শখের কি কোনো কমতি আছে? ছবি তোলা, ঘুড়ি ওড়ানো থেকে শুরু করে ম্যাচবক্স, পুরনো টেলিভিশন সংগ্রহে রাখার মতো নানান জানা-অজানা শখে বুদ হয়ে জীবনের বড় একটা সময় কেটে যায় মানুষের। শখের এই বিচিত্র তালিকার ভিড়ে 'বাস স্পটিং' খুব একটা পরিচিত না হলেও বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে বাস স্পটাররা। বাস 'ধরা' তাদের নেশা। আরেকটু ব্যাখ্যা করে বললে বাস প্রেমী হিসেবে বাসের ছবি তোলা, গতিবিধিতে নজর রাখা, খুঁটিনাটি আলোচনা করাই বাস স্পটারদের শখ।
আমেরিকা, ইংল্যান্ড, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়ার মতো বাংলাদেশেও আছে বাস প্রেমীদের বড় কমিউনিটি। দেশে এই বাস স্পটাররা নিজেদের পরিচয় করান 'বাস লাভার' হিসেবে। দূরপাল্লার বাসের গায়ে অহরহ 'বাস লাভার' স্টিকার জানান দেয় তাদের বিশাল নেটওয়ার্কিং এর।
বাংলাদেশে বাস প্রেমীদের কমিউনিটি গড়ে উঠেছে মূলত ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে। ২০১১ সালে ১০-১২ জন সদস্য মিলে গড়ে ওঠা ফেসবুক গ্রুপ 'Bus Lover' এখন দেড় লাখ বাস প্রেমীর মিলনমেলা।
দেশে প্রথম বাস স্পটার কমিউনিটি
সময়টা ২০১১ সালের জুলাই মাস। দেশের তরুণদের কাছে ফেসবুক জনপ্রিয় হতে শুরু করলেও ফেসবুক গ্রুপ তখনো খুব একটা পরিচিতি পায়নি। বাসের প্রতি ভালোলাগা থেকে মেডিকেল শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আকাশ ফেসবুক ঘেঁটে খুঁজে পান নির্দিষ্ট এক বাস কোম্পানির নামে একটি গ্রুপ। সর্বসাকল্যে সেখানে ১০-১২ জনের মতো সদস্য ছিলেন তারা। বাস নিয়ে একেকজনের স্মৃতিচারণ, বাসের ছবি, টিকিটের ছবি ইত্যাদি নানা বিষয়ে পোস্ট আসতো গ্রুপে। কিছুদিন পর গ্রুপের নাম বদলে রাখা হয় 'Bus Lover'।
"এই গ্রুপে জয়েন করার আগ পর্যন্ত সবাই ভাবতাম বাস নিয়ে এমন ফ্যাসিনেশন বোধহয় আর কারো নেই। নিজেদের সমমনা মানুষ খুঁজতে গিয়েই গ্রুপের খোঁজ পাই। আস্তে আস্তে নতুন অনেকেই জয়েন করতে থাকে গ্রুপে। সে সময়ে সবার হাতে হাতে খুব ভালো ক্যামেরার ফোন ছিল না। আমাদের তোলা বাসের ছবিগুলো তখন হয়তো খুব ভালো রেজ্যুলেশনের হত না। তবু সবার বাসের প্রতি ইমোশনে কোনো ঘাটতি ছিল না। ২০১২-১৪ সাল ছিল বাস লাভার গ্রুপের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। তখন গ্রুপের পরিচিতি বাড়তে থাকে মানুষের কাছে," বলছিলেন বাস লাভার গ্রুপের সবচেয়ে পুরোনো এডমিনদের মধ্যে অন্যতম শাহরিয়ার।
বর্তমানে দেশে 'বিডি বাস লাভার', 'বাস লাভার্স' ইত্যাদি নামে আরো নানা বাস ফ্যানিং গ্রুপ থাকলেও এই কমিউনিটিতে বাস লাভারকে 'মাদার গ্রুপ' হিসেবে আখ্যায়িত করেন শাহরিয়ার।
প্রতিদিনই গ্রুপে দেখা যায় অসংখ্য বাস প্রেমীর তোলা নিত্যনতুন সব বাসের ছবি। কে কত সুন্দর বাস 'ধরতে' পারলো তা নিয়ে চলে চাপা প্রতিযোগীতাও। এছাড়াও বাস সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় নিয়ে রাত-দিন এখানে চলতে থাকে তুমুল আলোচনা।
বাসের প্রতি ভালোবাসা থেকে বিনামূল্যে বিভিন্ন কোম্পানির বাসের গায়ের পেইন্টিং ডিজাইনও করে দেন বাস লাভার গ্রুপের ডিজাইনাররা।
বাসপ্রেম থেকে একত্রিত হওয়া এই বিশাল কমিউনিটি এখন ছড়িয়ে আছে দেশজুড়েই। বছরের বিভিন্ন সময়ে এই বাস প্রেমীদের নিয়ে দেশের নানা প্রান্তে আয়োজন করা হয় আনন্দভ্রমণের।
গ্রুপের ব্র্যান্ডিং
২০১৪ সাল থেকে জনসাধারণ আর বাস মালিক কর্তৃপক্ষের মাঝে এই বাস ফ্যানিং কমিউনিটিকে আরো পরিচিত করে তুলতে দূরপাল্লার বাস গুলোতে 'Bus Lover' লেখা স্টিকার লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন গ্রুপের একনিষ্ঠ এডমিন তারিকুল ইসলাম শুভ। এগারো বছর ধরেই গ্রুপের সাথে আছেন তিনি।
ধীরে ধীরে সারা দেশের বাসে ছড়িয়ে পড়তে থাকে স্টিকারগুলো। মালিকপক্ষের অনুমতি নিয়ে বাসে স্টিকার লাগানোর সময় কমিউনিটির সাথে কর্তৃপক্ষের চেনাজানাও বাড়ে। সাধারণ মানুষও এই স্টিকার দেখে গ্রুপের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। বর্তমানে প্রতি মাসে কমপক্ষে ৫০০ বাসে নতুন করে বাস লাভারের এই স্টিকার লাগানো হয়।
স্মৃতিচারণের জায়গা থেকে সাহায্যস্থল
"পরিবার নিয়ে প্রথমবার কক্সবাজার ঘুরতে যাব, কোন বাসে সবচেয়ে আরামদায়ক জার্নি করা যাবে?" বা "ভর্তি পরীক্ষা দিতে সিলেট যাব, সবচেয়ে কম খরচে যাতায়াত করা যাবে কোন বাসে?" এমন সব প্রশ্নের চটজলদি উত্তর মেলে বাস লাভার গ্রুপে।
তারিকুল ইসলাম শুভর ভাষ্যে, "২০১১ সালে শুধুই বাস ফ্যানিং গ্রুপ হিসেবে শুরু হলেও এখন একটা সোশ্যাল হেল্পিং নেটওয়ার্ক হিসেবেই কাজ করছে আমাদের বাস লাভার গ্রুপ। ভ্রমণ সংক্রান্ত যেকোনো জিজ্ঞাসার উত্তর মেলে এখানে। ধরুন লম্বা জার্নিতে মাঝরাস্তায় বাস নষ্ট হয়ে গেল, তখন সেই বাসযাত্রীদের কেউ গ্রুপে পোস্ট দিলে গ্রুপ মেম্বারদের সহায়তায় নতুন বাস খুঁজে পেতে পারে। কোনো নতুন জায়গায় গিয়ে বাস প্রেমীরা কেউ সমস্যার সম্মুখীন হলে অনেকসময়ই সেখানকার স্থানীয় কোনো বাস লাভার সরাসরি গিয়ে তাকে সাহায্য করে।"
শুধু বাস ফ্যানরাই নয়, বাস লাভার গ্রুপে যুক্ত আছেন বড় বড় বাস কোম্পানির মালিক, উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, কর্মচারীরাও। তাই বাস যাত্রার যেকোনো ধরনের সমস্যা, অভিযোগের কথা জানিয়ে গ্রুপে পোস্ট করলে কর্তৃপক্ষের কাছে সমাধানও পাওয়া যায়। বাস লাভার গ্রুপে পোস্ট করার মাধ্যমে বাস যাত্রায় হারানো ল্যাপটপের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার নজিরও আছে বলে জানান শুভ।
গ্রুপের বাস প্রেমীদের সমালোচনাকেও গুরুত্বের সাথে নেন বাস কর্তৃপক্ষ। কোনো রুটে নতুন বাস আনতে গেলে বাস প্রেমীদের পরামর্শ অনুযায়ী সুযোগ সুবিধা যোগ করা হয় পরিবহন ব্যবস্থায়। নতুন বাস রুটে চালানোর আগে বাস ফ্যানদের দাওয়াত দিয়ে ফটোসেশনের আয়োজনও করেন কর্তৃপক্ষ।
সচেতনতা তৈরিতে কাজ করেন
বাস ফ্যান হিসেবে বাস যাত্রা নিরাপদ করতেও অবদান রাখতে চান গ্রুপের সদস্যরা। কোনো কোনো ধরনের ওভারটেকিং, বিপদজনক ড্রাইভিং প্রমোট করা পোস্ট গ্রুপে এপ্রুভ করা হয়না তাই কখনো। শাহরিয়ার বলেন, "আজকাল অনেক ইউটিউব চ্যানেলে বাস ফ্যানিং এর নামে বিপদজনক ড্রাইভিং এর উৎসাহ দেওয়া হয়। 'দেখুন সেরা ১০টি ওভারটেকিং ভিডিও', 'দেশের সেরা পাগলাটে বাস' ইত্যাদি ক্যাপশনে অনেক ভয়ংকর বাস ড্রাইভিং ভিডিও দিয়ে লাখ লাখ ভিউ কামায় অনেকেই। এতে কিন্তু বাস দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। আমাদের গ্রুপে এধরনের কোনো পোস্ট দেওয়া নিষেধ। নিরাপদ ড্রাইভিং করতে উৎসাহ দেওয়া হয় এখানে সবসময়।"
যাত্রাপথের সচেতনতা তৈরি করতে সরেজমিনে গিয়েও কাজ করেছে গ্রুপের সদস্যরা। ঈদের সময় গাবতলী, কল্যাণপুর, সায়েদাবাদের মতো বড় বড় বাস টার্মিনালে গিয়ে লিফলেট বিতরণ করে, পোস্টার লাগিয়ে চেষ্টা করেছেন জনসচেতনতা বাড়ানোর।
স্মরণীয় ঘটনা
ফ্যান হিসেবে বাসের ছবি তুলতে গিয়ে প্রায়ই বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন বাস প্রেমীরা। স্মৃতিচারণ করে শাহরিয়ার বলেন, "দেশে বাস ফ্যানিং এর শুরুর দিকে ছবি তুলতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয়েছে অনেকবারই। সবাই অনেক প্রশ্ন করতো, কেউ কেউ তো ডাকাত বলেও সন্দেহ করতো! ২০১২ সালে একবার গাবতলি বাস টার্মিনালে ছবি তুলছিলাম আমি। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ ডেকে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল আমাকে। সাথে থাকা জিনিসপত্র সব সার্চ করেছিলো। ফেসবুকে গ্রুপ দেখিয়ে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ছাড়া পেয়েছিলাম সেদিন।"
"আগে ছবি তুলতে যেমন সমস্যা হত, এখন আর তেমনটা হয় না। বাস চালক, হেল্পার থেকে শুরু করে মালিকপক্ষের সবাই এখন বাস ফ্যানিং কমিউনিটির সাথে পরিচিত। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা বাস টার্মিনালে গিয়ে ছবি তোলার সময় তারা সবাই বেশ সহযোগীতাই করে। অনেক সময় এমনও হয়েছে বাসের ছবি তোলার সময় ড্রাইভার চলন্ত গাড়ি থামিয়ে ডেকে নিয়ে কুশল বিনিময় করেছেন। আবার কখনো পরিচিত কোন বাস ফ্যানকে দেখলে তারাও ডেকে নিয়ে ছবি তুলতে অনুরোধ করেন। চলন্ত বাসের ছবি তুলতে দেখে চালকের 'ডিপার' দেওয়া (হেডলাইট জ্বালিয়ে অভিবাদন জানানো) বাস ফ্যানদের জন্য আনন্দের বিষয়," যোগ করেন শাহরিয়ার।
সিরাজগঞ্জে পদ্মার মোড়ে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে তোলা বাসের ছবি শাহরিয়ারের বাস স্পটিং এর প্রিয় ছবির তালিকায় আছে শুরুতেই। সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে তার ক্যামেরার খারাপ অবস্থা হলেও পছন্দের ছবি তুলতে পারার আনন্দে সেই দুঃখ গায়ে লাগেনি।
ছবি তোলার সময় সেখানকার পরিবেশ খেয়াল রাখা আর কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে জানান তিনি। রেস্ট্রিক্টেড এলাকায় বাসের ছবি তুলতে গিয়ে বড় ধরনের বিপদে পড়ার সম্ভাবনাও থাকতে পারে।
নানা সময়ে বাস মালিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নানা ধরনের চাপের সম্মুখীন হতে হয়েছে বাস লাভার গ্রুপের এডমিনদের। বাস এক্সিডেন্টের কোনো পোস্ট গ্রুপে যেন এপ্রুভ করা না হয় সেজন্য হুমকিও এসেছে মালিক পক্ষের। কিন্তু কিছুতেই নিজেদের আদর্শ থেকে সরে দাঁড়াননি এই বাস ফ্যানরা। অনেক সময় আর্থিক সাহায্যের কথা বলে বিভিন্ন বাস কোম্পানি থেকে প্রলোভন দেখানো হলেও কারো সাথে কোনো অর্থনৈতিক লেনদেনের বিপক্ষে থেকেছেন বাস প্রেমীরা। নিজস্ব খরচে গ্রুপের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করেছেন যেন কমিউনিটির স্বাধীনতা বজায় থাকে।
নানা দেশে বাস ফ্যানিং
আমাদের দেশে বাস ফ্যানিং-এর ধারণা বেশি পুরোনো না হলেও বিশ্বের নানা প্রান্তে বহু আগে থেকেই ছড়িয়ে আছে বাস স্পটারদের পদচারণা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কোল্ড ওয়ারের পটভূমিতে লেখা বই 'Trapped in the Cold War: The Ordeal of an American Family'-তে শখ হিসেবে লন্ডনের রাস্তায় বাস স্পটিং এর উল্লেখ দেখা যায়।
"বাস ফ্যান", "বাস স্পটার", "বাস নাট" ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিচিত বাস প্রেমীরা। বাসের ইতিহাস, গসিপ, বাস ফ্যানদের আগ্রহের নানা জায়গা নিয়ে লেখার জন্য বিখ্যাত চীনা ম্যাগাজিন "বাস ফোকাস" আর যুক্তরাজ্যের "বাসেস" ম্যাগাজিন।
জাপানের বাস স্পটারদের জন্য গতবছর অনুষ্ঠিত হওয়া টোকিও অলিম্পিকে আসা বাসের সমারোহ ছিল এক অনন্য আনন্দোৎসব।