কেন আপনার কম কাজ করে শখের পেছনে বেশি সময় দেওয়া উচিত?
সারা বিশ্বে কর্মজীবীরা সময়ের অভাবে বেশ চাপেই আছেন। এ চাপের কারণে তারা এমন অনেক কিছু ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন যা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপে বেশির ভাগ মানুষ তাদের পছন্দের তালিকায় এমন কিছু শখের কথা লিখেছেন যা তারা সময়ের অভাবে করতে পারছেন না।
বিষয়টি সাধারণ মনে হলেও, এটি প্রত্যেকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর প্রভাব কেবল ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যখন মানুষ তাদের শখের জন্য সময় বের করতে পারে না, তখন এর প্রভাব তাদের কাজের ওপরও পড়ে। শখ কর্মজীবীদের কাজের দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
প্রতিবেদনটির লেখক বলেন, "আমি এই সত্যটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি। আমার গিটার বাজাতে এবং তা থেকে নতুন সুর তোলার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। তবে বিশ্বের অন্যান্য কর্মজীবীদের মতোই আমিও একই ফাঁদে পড়েছি।"
লেখক নেক্সটিভা-এর ডিমান্ড জেনারেশন বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। একটি বিভাগের প্রধান হিসেবে তাকে দিন-রাত ব্যস্ত থাকতে হয়। এ বিষয়ে লেখক বলেন, "এ কারণে সপ্তাহের ৭২ ঘণ্টা আমার কাজেই চলে যায়। এর বাইরে ফোনেও আমি অফিসের অনেক কাজ সারি। তাতে ব্যয় হয় আরও অনেক সময় যা কর্মঘণ্টায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।"
এসব কাজ করতে করতে যখন তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন তখন তার অলস মন অন্য কিছু করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রে অবসর সময় কাটানোর জন্য টেলিভিশন দেখা সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজ। জার্মানি ও ইংল্যান্ডেও এটি সমান জনপ্রিয়। তবে লেখক টেলিভিশন না দেখে সংগীত চর্চায় তার সময় ব্যয় করেন। তিনি জানান, এর মাধ্যমে আসলে তিনি কর্মক্ষেত্রে তিনি কিছু ভালো দক্ষতা অর্জন করেছেন, যা তাকে কর্মক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় তাকে আরও এগিয়ে রাখছে।
সৃজনশীলতা
আজকের ভিড়ে ঠাসা এবং ক্রমাগত পরিবর্তনশীল কাজের পরিবেশে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন, উদ্ভাবনী ধারণা নিয়ে আসতে হয়, যা ভিড়ের মধ্যে থেকেও নজর কাড়তে সক্ষম। সম্ভাব্য ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য লেখককে সবসময় নতুন উপায় খুঁজতে হয়। কিন্তু যখন লক্ষ্য, পরিমাপক এবং সময়সীমার চিন্তায় মস্তিষ্ক ব্যস্ত থাকে, তখন পুরোপুরি মৌলিক একটি ধারণা বের করা কঠিন হয়ে পড়ে।
তাই লেখক পরামর্শ দেন, "একটি সৃজনশীল শখ আপনাকে এসব থেকে বের করে নিয়ে আসে। আপনি যদি একজন সংগীতশিল্পী, শিল্পী, লেখক, বা রাঁধুনি হন, তবে মনের ভেতর একটি শূন্য ক্যানভাস দিয়ে শুরু করেন। আপনি কেবল ভাবেন: আমি এমন কী সৃষ্টি করব যা আমাকে কাঙ্ক্ষিত অনুভূতিটি জাগাতে সাহায্য করবে?"
তাই এটি কোনো বিস্ময়ের বিষয় নয় যে নিজেকে এই মানসিক অবকাশ দেওয়ার মাধ্যমে এবং অনুভূতিগুলোর ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার মাধ্যমে আপনি সৃজনশীলতাকে নতুন করে জাগ্রত করতে পারেন। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে যৌক্তিক চিন্তা এবং অনুভূতিগুলো মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশকে সক্রিয় করে। সৃজনশীলতার স্রোতধারা উন্মুক্ত করতে উভয়েরই সমন্বয় প্রয়োজন।
দৃষ্টিভঙ্গি
সৃজনশীল প্রক্রিয়ার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজগুলোর একটি হলো কল্পনা করা যে অন্য কেউ আপনার ধারণাটিকে কীভাবে অনুভব করবে। কিন্তু সৃজনশীল শখে যুক্ত থাকা ব্যক্তিরা সবসময় এভাবেই ভাবেন। একজন মৃৎশিল্পী চিন্তা করেন, কোনো কলসির ক্রেতা এটি দেখে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন। একজন রহস্য উপন্যাস লেখক ভাবেন, একজন পাঠক কাহিনির মোড় নিয়ে কতটা বিস্মিত হবেন।
লেখক বলেন, "যখন আমি কাজ থেকে বিরতি নিয়ে সংগীত তৈরি করতে যাই, তখন আমি এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পুনরায় সংযুক্ত হই। আমি ভাবতে থাকি, কেউ যখন প্রথমবার আমার গান শুনবেন, তখন কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করি অন্য কারও চোখ (বা কান) দিয়ে পৃথিবী দেখার (বা শোনার)। পরে যখন কাজের প্রকল্পে ফিরে আসি, তখন আমি সেই মানসিকতাই সঙ্গে নিয়ে আসি।"
আত্মবিশ্বাস
যখন লেখক কর্মক্ষেত্রে কোনো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন এবং সমাধান খুঁজে পেতে বেগ পান, তখন কখনও কখনও নিজের সৃজনশীল সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ জাগে। আত্মবিশ্বাস হারানো সহজ। তিনি বলেন, "কিন্তু যখন গিটারের সুরে এক ঘণ্টা সময় কাটাই, নিখুঁত নোটগুলো স্পর্শ করি, তখন মনটা ভালো হয়ে যায়। বুঝতে পারি যে আমার মস্তিষ্ক ঠিক এই ধরনের তৃপ্তির জন্য ব্যাকুল ছিল। এরপর যখন আবার সেই কাজের প্রকল্পের দিকে মনোযোগ দেই, তখন সেই আত্মবিশ্বাস নিয়েই ফিরি।"
লেখক বলেন, "আমার মতো মানুষের ওপর গবেষণাও হয়েছে।" এক গবেষণায় দেখা গেছে, "সৃজনশীল কর্মকাণ্ড পুনরুদ্ধারের অভিজ্ঞতার (যেমন দক্ষতা অর্জন, নিয়ন্ত্রণ, এবং বিশ্রাম) এবং কর্মসম্পর্কিত ফলাফলের (যেমন কাজের সৃজনশীলতা এবং অতিরিক্ত ভূমিকা পালন) সঙ্গে ইতিবাচকভাবে যুক্ত।' গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, 'কাজের বাইরে সৃজনশীল কর্মকাণ্ড একটি অবসর কার্যকলাপ হতে পারে, যা কর্মীদের উচ্চ মানের পারফরম্যান্সের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ সরবরাহ করে।'
তাই তিনি তার সহকর্মী পেশাজীবীদের উদ্দেশ্যে বলেন, "নিজের সৃজনশীল শখকে বজায় রাখতে কিছুটা সময় বরাদ্দ করুন। এটা খুব বেশি সময় নিতেও হবে না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪৫ মিনিট ধরে কোনো সৃজনশীল কাজে যুক্ত থাকা একজনের আত্মবিশ্বাস ও কাজ সম্পন্ন করার সক্ষমতা বাড়ায়।"
এছাড়া, কর্মীদের শখ উদ্যাপন করতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করার পরামর্শ দেন লেখক। উদাহরণস্বরূপ, জ্যাপোস তাদের অফিসের দেয়ালে কর্মীদের তৈরি শিল্পকর্ম প্রদর্শন করে এবং কর্মীদের ডেস্ক তাদের ইচ্ছামতো সাজানোর অনুমতি দেয়। কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতিভা প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এমনকি যেসব কর্মীর এই ধরনের প্রতিভা না-ও থাকতে পারে, তাদেরও কোনো সৃজনশীল এবং মজার কাজ করার জন্য উৎসাহিত করা উচিত। অনেক সিইও তাদের নিজস্ব শখের জন্য সময় বের করেন, যা কর্মীদের জন্য সঠিক উদাহরণ হতে পারে।
আর যখন সৃজনশীল শখের জন্য কিছু সময় বের করেন, তখন সেটাকে অপরাধবোধ থেকে মুক্ত রাখুন। কারণ, এটি করলে সবারই উপকার হয়।