সোলার মার্কেটের জালিয়াতি যেভাবে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের আইসিটি বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার আরিফুর রহমানের বরাবরের ইচ্ছা ছিল নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করবেন। দিনের বেলায় একটি বা দুটি ছোট ডিসি (ডাইরেক্ট কারেন্ট) ফ্যান চালানোর জন্য একটি ছোট সোলার প্যানেল ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছিলেন তিনি।
দেশে (এবং সারা বিশ্বে) যখন তীব্র জ্বালানি সংকট শুরু হলো, ফিরে এল লোডশেডিং, আরিফ তখন এই প্রচেষ্টা আরও জোরদার করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, বাড়ির কিছু নিয়মিত বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি চালাতে গ্রিডের বিদ্যুৎ ব্যবহার না করে ছাদে সোলার প্যানেল চালানোর সিস্টেম স্থাপন করবেন। ঢাকার অধিকাংশ বাড়ির ছাদে সোলার প্যানেলগুলো অলসই পড়ে থাকে।
একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করার পর আরিফ সিদ্ধান্তে আসেন, তার দরকার শুধু একটি এমপিপিটি (ম্যাক্সিমাম পাওয়ার পয়েন্ট ট্র্যাকিং) সোলার চার্জ কন্ট্রোলার, কিছু ক্যাবল (যা আগে থেকেই তার কাছে ছিল), একটি ইনভার্টার (আসলে তার আইপিএস), একটি ব্যাটারি আর সোলার প্যানেল।
পরিকল্পনা ছিল, ৪০ ভোল্ট ডিসিতে ছাদ থেকে নিচের চারতলায় সৌর বিদ্যুৎ পাঠানো, ১২ ভোল্ট ব্যাটারি প্যাক চার্জ করার জন্য একে ১২ ভোল্ট ডিসিতে রূপান্তর করা, যা ইনভার্টারকে শক্তি জোগাবে। এ কাজের জন্য তিনি এমপিপিটি চার্জার ব্যবহার করবেন বলে ঠিক করলেন, কারণ এটি গ্রিডে ব্যবহৃত স্টেপ-ডাউন ট্রান্সফরমারের মতো উচ্চ ভোল্টেজকে বাড়তি অ্যাম্পারেজে রূপান্তরিত করে। স্থানীয়ভাবে তৈরি অটো কাট-অফ এবং পিডব্লিউএম (পালস ওয়াইডথ মডুলেশন) কন্ট্রোলারর মতো অন্যান্য চার্জ কন্ট্রোলারে চার্জিং ভোল্টেজের উপরের বাকি সব ভোল্টেজই মূলত নষ্ট হয়।
পিডব্লিউএম কন্ট্রোলারের তুলনায় এমপিপিটি কন্ট্রোলার ৩০ শতাংশ বেশি দক্ষ এবং অনেক বেশি ব্যয়বহুল। লো-ভোল্টেজ ট্রান্সমিশনে তাপের মাধ্যমে বিদ্যুৎ অপচয় হয়। এমপিপিটি কন্ট্রোলার ব্যবহারে এরকম বিদ্যুৎ অপচয়ও রোধ হয়।
কিছুদিন ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করার পর আরিফ নবাবপুরে সংযোগ পাওয়ার প্যাক নামে একটি দোকান খুঁজে পান। সেখানে এমপিপিটি চার্জ কন্ট্রোলার বিক্রি হয়। কন্ট্রোলারের পাশাপাশি ট্রান্সমিশনের জন্য তিনি এক কয়েল ক্যাবলও কেনেন দোকানটি থেকে।
শেষ পর্যন্ত সোলার প্যানেল স্থাপনের উদ্যোগ বাস্তব রূপ নিতে যাচ্ছে দেখে আরিফ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তার উৎসাহ মিইয়ে যেতে সময় লাগল না। সিস্টেম স্থাপনের দুদিন পর দেখা গেল সিস্টেমটি আরিফের বাড়ির বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য পর্যাপ্ত শক্তি সরবরাহ করছে না।
পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করার পর দেখা গেল চার্জ কন্ট্রোলারটি আসলে পিডব্লিউএম, কিন্তু লেবেল সাঁটা হয়েছে এমপিপিটি হিসাবে। এটি ১২ ভোল্ট ব্যাটারির ভোল্টেজকে কমিয়ে চার্জিং ভোল্টেজে নামিয়ে আনে, কিন্তু বিদ্যুৎ প্রবাহ বাড়ায় না, অথচ এটাই এ ধরনের ডিভাইসের অন্যতম প্রধান কাজ। ফলে ইনভার্টারটি ছাদের সোলার প্যানেল থেকে সরবরাহ করা শক্তির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পাচ্ছিল।
এছাড়াও ৭০/৭৬ চিহ্নিত ট্রান্সমিশন ক্যাবলগুলো আসলে ৭০/৭৬-এর চেয়ে অনেক পাতলা ছিল। এই পাতলা ক্যাবল মাত্র সাড়ে ৭ অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুতেই গরম হয়ে যাচ্ছিল।
শুধু আরিফই নন, আরও অনেকে সোলার বাজারের বিক্রেতাদের কাছে প্রতারিত হয়েছেন। ক্রেতাদের ঠকানোর জন্য এমপিপিটিসহ চার্জ কন্ট্রোলারসহ আরও অনেক আইটেমেই ভুল লেবেল সাঁটানো হয়েছে।
ঢাকার গুলিস্তানের স্টেডিয়াম মার্কেটের একটি নামকরা ইলেকট্রিক অ্যাপ্লায়েন্স বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এক দশক আগেও সোলার আইটেম বিক্রি করত। হঠাৎ করে বছর দুয়েক আগে তারা এসব সামগ্রী সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। বাজারের ব্যাপক প্রতারণা তাদের এই বিক্রি বন্ধে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে।
অন্য ব্যবসায়ীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় নাম না প্রকাশের অনুরোধ করে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেন, 'অনেক সরবরাহকারী প্রকৃত পাওয়ার রেটিংয়ের চেয়ে বেশি ওয়াটেজ দেখানোর জন্য সৌর প্যানেলগুলোকে রি-লেবেল করে। এটি করলে প্রতি ওয়াটের জন্য কম দাম চাইতে পারে; এতে করে আমরা বাজারে প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা হারাচ্ছি। পাশের দোকানেই সস্তা প্যানেল পাওয়া যাওয়ায় আমাদের দোকান থেকে কেউ কেনে না।'
ওই বিক্রেতা আরও বলেন, 'সাধারণ ক্রেতা এই জালিয়াতি ধরতে পারেন না। তাই তারা আপাতদৃষ্টিতে সস্তা সোলার প্যানেল কেনেন, যদিও তারা আসলে অনেক বেশি দামেই জিনিসটা কিনছেন।'
এসব ঘটনা নতুন নয়। এক দশকেরও বেশি আগে দেশের শহরাঞ্চলে সোলার মার্কেট সম্প্রসারিত হতে শুরু হওয়ার সময় থেকেই বিপণন জালিয়াতিরও জন্ম। এই জালিয়াতির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইন-কানুন থাকলেও নজরদারির অভাবে এসব অসাধু কর্মকাণ্ড চলছে লাগামহীনভাবে।
বর্তমানে ২২৯টি পণ্য বিএসটিআই-এর (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) বাধ্যতামূলক সার্টিফিকেশন মার্কস (সিএম) স্কিমের আওতায় আছে। এই তালিকায় সোলার প্যানেল ও ব্যাটারি চার্জ কন্ট্রোলারসহ বেশ কয়েকটি ফটোভোলটাইক পণ্যের নাম রয়েছে।
বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) মো. নুরুল আমিন উপরোল্লিখিত পণ্যগুলোর নাম নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এ জাতীয় পণ্যের প্রত্যেক প্রস্তুতকারক বা আমদানিকারকের জন্য পণ্যের মান পরীক্ষা ও গুণমান নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক।'
এ বিষয়ে আরও তথ্য দিয়ে বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক (সিএম) আরাফাত হোসেন সরকার বলেন, 'আইইসি (ইন্টারন্যাশনাল ইলেকট্রোটেকনিক্যাল কমিশন) স্ট্যান্ডার্ডই বিভিন্ন সোলার পণ্যের জন্য গৃহীত মানদণ্ড। সোলার পণ্য বিএসটিআইয়ের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা যায়, আবার চাইলে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে স্থাপিত আরেকটি ল্যাবরেটরিতেও পরীক্ষা করা যায়। সেখানে এসব পণ্যের সনদ দেওয়া হয়।'
তবে বিএসটিআই এখন পর্যন্ত কোনো সোলার চার্জ কন্ট্রোলার ব্র্যান্ডকে সনদ দেয়নি বলে জানান আরাফাত। প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যন্ত ২৩টি সোলার প্যানেল ও ইনভার্টার কোম্পানি বা কনসাইনমেন্টকে প্রত্যয়িত করেছে।
এই প্রত্যয়িত পণ্যগুলো মূলত বড়, 'গ্রিড-টাইড' ছাদ সৌর প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়। বিএসটিআইয়ের ছাড়পত্র পাওয়ার পর ব্যবহারকারী যদি নেট-মিটারিং সুবিধা পেতে চান তবে তাকে সরকারের টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়।
আর সোলার ইনভার্টারের জন্য বিএসটিআইতে কোনো পূর্ণাঙ্গ টেস্টিং ল্যাব সুবিধা নেই। তবে তারা স্বীকৃত বিদেশি স্ট্যান্ডার্ড ও টেস্টিং ল্যাব থেকে পাওয়া ছাড়পত্র গ্রহণ করে। তাই প্রকল্পগুলো আটকে যায় না।
কিন্তু সোলার মার্কেটের বাকি পণ্যগুলোর নজরদারি ও মান নিশ্চিত করার জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। তবে কোনো গ্রাহককে বিক্রেতা নিম্নমানের পণ্য দিয়ে ঠকালে তার প্রতিকারের জন্য তিনি বিএসটিআই বা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের দ্বারস্থ হতে পারেন।
ওই বিএসটিআই কর্মকর্তা বলেন, 'আমাদের একটি ভ্রাম্যমাণ আদালতে টিম আছে। আর এ ধরনের প্রতারণার তথ্য পেলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি এবং নেব।'
নবাবপুর ও সুন্দরবন মার্কেটের খুচরা বিক্রেতারা মানের বিষয়টি সম্পর্কে জানেন—কিন্তু তারা জানান, সরকারি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বড় সরবরাহকারীরাই শুধু দরকারি প্রত্যয়নপত্র নেয়।
আরিফের অভিযোগটি যাচাই করার জন্য এই লেখক তার (আরিফ) কাছে চার্জ কন্ট্রোলারটি বিক্রি করা সংযোগ পাওয়ার প্যাকের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাইফুল প্রথমে নিম্নমানের পণ্য বিক্রির কথা অস্বীকার করেন। পরে প্রমাণ দেখানো হলে—বিক্রির রসিদ ও ডিভাইসে খোদাই করা তার কোম্পানির নাম এবং ডিভাইসটি যে ঠিকমতো কাজ করে না তার ভিডিও—এর জন্য তিনি গুলিস্তানের সুন্দরবন মার্কেটের আমদানিকারককে দায়ী করেন। কিন্তু ব্যাপারটির সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের সম্পৃক্ততা থাকায় ঝামেলা আন্দাজ করতে পেরে এই বিক্রেতা বলেন যে তিনি পণ্যটি ফিরিয়ে নেবেন এবং ক্রেতা চাইলে অর্থ ফিরিয়ে দেবেন। পরে তিনি ডিভাইসটির মূল্য হিসেবে নেওয়া অর্থ ফেরত দেন।
ডিভাইসটি চীন থেকে আমদানি করেছিল এমএম ইলেকট্রনিকস। প্রতিষ্ঠানটির মালিকের সঙ্গে কথা বলে মনে হলো ডিভাইসটি যে নিম্নমানের, তা তিনি জানেন; কিন্তু মুখে স্বীকার করেননি। উল্টো তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, পণ্যটি চীন থেকে যেভাবে আসে, সেভাবেই বাজারজাত করা হয়।
আরিফ তার অর্থ ফেরত পাওয়ার পর বলেন, 'এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে পড়ার পরও আমি আমার সৌর প্রকল্পটি চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে অটল আছি।' যদিও ব্যাপক জালিয়াতিতে ডুবে থাকা এই সেক্টরের কোথা থেকে চার্জ কন্ট্রোলার কিনবেন, তা তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না।
সরকারি সংস্থাগুলো যতদিন সোলার মার্কেটের বিক্রেতাদের নিয়মের আওতায় আনা ও মান নিশ্চিতে সফল না হচ্ছে, ততদিন নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে আগ্রহীরা প্রতারণার ঝুঁকিতেই থাকবেন।