টিব্যাগ থেকে শাড়ি, সবকিছুই তার ক্যানভাস
শুরুটা হয়েছিল একদম ছোট্টবেলায়, চশমা এঁকে বাবাকে চমকে দিয়েছিলেন। বাবাও বুঝতে পারেন ছেলের আঁকাআঁকির হাত অসাধারণ। তাই তো ছোট্ট ছেলেটিকে কিনে দিয়েছিলেন এক বাক্স রং। এখন আর ছোট্ট নেই তিনি, মার্কেটিংয়ের মতো কঠিন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শেষে চাকরিও করেছেন বেশ ক'বছর। তবে ছবি আঁকা কিন্তু থেমে থাকেনি। ফেলে দেওয়া টিব্যাগকে ক্যানভাস বানিয়ে, ছবি এঁকে রীতিমতো হইচই সৃষ্টি করেছেন যিনি, তিনি হলেন সাদিত উজ জামান।
এবারে তার ঝুলিতে যোগ হয়েছে শাড়ি তৈরির অনন্য এক অভিজ্ঞতা। আঁচল ও পাড়ে টিব্যাগের আদলে বিউটি বোর্ডিংকে ফুটিয়ে তোলা শাড়ি দিয়ে নতুন করে ভক্তদের মন জয় করে নিয়েছেন সাদিত। টিব্যাগ স্টোরিজের প্রিন্টেড ভার্সন থেকে করা শাড়িটির প্রথম প্রদর্শনী হয় গুলশান শ্যুটিং ক্লাবের হার-ই-ট্রেডে।
সরলা নামে একটি আর্ট ও ক্রাফটিং পেজের সঙ্গে মিলে এ শাড়িটি তৈরি করেন। পুরো শাড়ির কিছুটা ফাঁকে ফাঁকে ঐতিহাসিক এ আবাসিক ও খাবারের হোটেলটির জানালাগুলো আঁকা। পাড়ে ও আঁচলে রয়েছে বোর্ডিংয়ের জানালার ছবি। নিচের দিকে বিউটি বোর্ডিং নিয়ে বেশকিছু তথ্যও লেখা রয়েছে। শাড়িটির রং আর বিউটি বোর্ডিংয়ের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিঃসন্দেহে এর আবেদন বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে।
তবে এর আগেও কিন্তু শাড়ি নিয়ে কাজ করেছিলেন তিনি। ২০২১ সালে অনেকটা ছোটবোনের আবদার মেটাতেই তার বিয়েতে হলুদ মসলিন শাড়িটির কুঁচির অংশে মোগল সম্রাট ও তার স্ত্রীর ছবি আঁকেন সাদিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করে হাতে আঁকা বোনের হলুদের শাড়িটি।
সম্প্রতি বিয়ে করেছেন তিনি। স্ত্রীকে উপহার দিতে সাদিত যা করলেন, তা ছিল একেবারেই ভিন্ন। তিনি তার বিয়েতে স্ত্রীকে তৈরি করে দিলেন তার হাতে তৈরি শাড়ি! হালকা গোলাপি রঙের জমিনের ওপর গোলাপের কারুকারর্যখচিত শাড়িটি তৈরি করে চমকে দেন প্রিয় মানুষটিকে।
ছোটবেলায় নিজের ভালো লাগার জায়গা থেকে ছবি আঁকতে শুরু করা সাদিত ব্যক্তিগত জীবনে পারিবারিক ব্যবসা দেখেন। সঙ্গে রয়েছে তার নিজস্ব একটি ব্যবসাও। হাতের কাজের ওপর একটি বুটিক হাউজ রয়েছে তার। জানালেন, এখনও হ্যান্ড পেইন্টিংয়ের ওপর বাণিজ্যিকভাবে শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেননি। তবে অচিরেই এ কাজ শুরু করার ইচ্ছে রয়েছে তার।
ছবি আঁকায় নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
মতিঝিল মডেল স্কুল থেকে এসএসসি ও বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে (এআইইউবি) বিবিএ ও এমবিএ করা সাদিতের ছবি আঁকার ওপর নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা।
স্কুল ও কলেজের প্র্যাকটিকাল খাতায় খুব সুন্দর আঁকতেন, অনেক সময় বন্ধুর খাতায়ও এঁকে দিতেন, বলেই হাসলেন সাদিত।
এমনিতে স্কেচ বুক বা রেগুলার ক্যানভ্যাস দিয়ে আঁকা শুরু করলেও ২০১৫ সাল থেকে অনেকটা নিয়মিতভাবেই বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকতে শুরু করেন তিনি। একইসঙ্গে আঁকতে শুরু করেন ফেলে দেওয়া টিব্যাগেও।
প্রথমে টিব্যাগ কেন বেছে নেওয়া!
এতো কিছু থাকতে টিব্যাগকে প্রথমে বেছে নেওয়া কেনো, এ প্রশ্নের উত্তরে সাদিত বললেন, 'চা যেমন আমার একটা তৃপ্তির জায়গা, আঁকাআকিটাও তেমন। এই দুই তৃষ্ণাকে এক করতে পারাতেই টিব্যাগ স্টোরিজের উদ্ভব।'
রেগুলার ক্যানভাসসহ বিভিন্ন রিসাইকেলড মাধ্যমে কাজ করার পরও একটি মাধ্যম খুঁজছিলেন তিনি। ধারাবাহিকভাবে কাজ করতে পারবেন এমন জায়গা থেকেই এ ভাবনা। সেরকম সময়ই মার্কিন শিল্পী রুবি সিলভিয়ার কিছু রিসাইকেলড কাজ চোখে পড়ে তার, যার মধ্যে টিব্যাগ আর্টও ছিলো। সেখান এ ধারাটি আমাদের শিল্পাঙ্গনে ভিন্ন একটা মাত্রা যোগ করতে পারে বলে মনেহয় তার।
"ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা নিয়ে যখন আঁকতে বসি কেমন একটা অন্যরকম অনুভূতি হয়। কতো সময় এরকম হয় যে পানিতে তুলি ভেজাতে গিয়ে ভুল করে চায়ের কাপে ভিজিয়ে ফেলি, এতোটাই ডুবে যাই। আঁকার সময় একটা অন্যজগতে চলে যাওয়া যায়, একদম নিজের মতো। এটাই মজা। চায়ের কাপে চুমুকের সাথে সাথে যে বিক্ষিপ্ত ভাবনারা আসে, তাদের প্রকাশ করতে চাওয়ারই একরকম ক্ষুদ্র প্রয়াস আমার এই চায়ের ব্যাগে গল্প বলা। সেই থেকেই টিব্যাগে আঁকা শুরু।"
সাদিত এ পর্যন্ত টিব্যাগে এঁকেছেন ৫শ'র বেশি ছবি। দেখতে দেখতে তার টিব্যাগ স্টোরিজে এখন ৩৯ হাজার ফলোয়ারও রয়েছে।
চলছে ইলাস্ট্রেশনের কাজও
২০১৫ সাল থেকে শুরু করেছিলেন বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা।
এ পর্যন্ত মোট কতটি বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন সাদিত, হিসেব নেই তার কাছে। তবে এবছর বইমেলায়, লেখক লুৎফর হাসানের 'বগি নম্বর জ' উপন্যাসের প্রচ্ছদ, নাজনীন নাহারের কবিতার বই 'সভ্যতার বায়োগ্রাফি', চিঠির বই 'চিঠির কোলাজ', উপন্যাস 'জলময়ূর' এর প্রচ্ছদ, তাবাসসুম নাজের 'ভালোবাসার রঙ নীল' এর প্রচ্ছদ, সুমী শারমীনের 'জলেশ্বরী পত্রাবলী' এর প্রচ্ছদ, ইতি চৌধুরীর উপন্যাস 'পিছুটান' এর প্রচ্ছদ করা হয়েছে তার টিব্যাগ স্টোরি দিয়ে।
নাজনীন নাহারের 'কথোপকথন না ফুরোনো বিকেল', শানজানা আলমের 'এসো আমার ঘরে'- এ বইগুলোর প্রচ্ছদেও রয়েছে টিব্যাগের প্রাধান্য।
তবে হাতে আঁকা সবসময় সম্ভব হয় না বলে কাজ শিখছেন ইলাস্ট্রেশনের। এতে অল্প সময়ে প্রচ্ছদের কাজ করতে পারেন বেশ অনেকখানি।
লেখালেখিও করেন তিনি
কেবল ছবি আঁকাতেই নিজেকে আটকে রাখেননি টিব্যাগ শিল্পী। লেখালিখির দিকেও বেশ ভালোই ঝোঁক রয়েছে তার। বের করেছেন কাব্যগ্রন্থও। 'হেমন্ত আসার আগেও' নামে অনুজ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন নিজেই।
কথায় আছে, যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে, কথাটি পুরোপুরো প্রযোজ্য সাদিতের ক্ষেত্রে। শুধু ছবি আঁকাই নয়, এর সুবাদে নাটকের সেট ডিজাইনের অভিজ্ঞতাও হয়েছে তার এরমধ্যেই। তবে এ বিষয়ে তার খালার অবদানের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
জানালেন, খালা বাংলাদেশ বেতার ও মঞ্চশিল্পী নূর ই হাফজা পারভিনের অনুপ্রেরণায় এ কাজ করেছেন তিনি। পরিবারের অন্যসব সদস্যের পাশাপাশি খালাও তার অনুপ্রেরণার একটি বড় উৎস। তার সঙ্গে থেকে অনেক কিছু শিখেছেন, ছোট থেকেই দুজন মিলে একসঙ্গে অনেক অদ্ভুত ধরনের এক্সপেরিমেন্টের সুযোগও পেয়েছেন তিনি।
কী ধরনের ছবি আঁকতে ভালো লাগে, এমন প্রশ্নের জবাবে সাদিত বললেন, "ধরুন কাজের ফাঁকে হঠাৎ দেখলেন আকাশ কালো করে মেঘ করেছে, একটু হলেও তা আপনার মনকে নাড়া দিবে। আবার ব্যস্ত রাস্তায় হাজারো ব্যস্ততা কাঁধে নিয়ে চলার পথে যখন লাল কমলায় ছেয়ে যাওয়া কৃষ্ণচূড়ার দিকে চোখ যাবে তা একটু হলেও আপনার মনকে চাঙা করবে। ভরা পূর্ণিমায় বাঁধভাঙা চাঁদের হাসি, ছোটবেলার প্রিয় কোনো গল্পের বই, সুন্দর একটা নাটক বা সিনেমার কোনো অংশ, ঈদে বাড়ি ফেরার আনন্দ, খেলায় নিজের দল জেতার আনন্দ, বাবা-মা কে বলতে না পারা, এরকম ছোট ছোট ভালোবাসার মুহূর্তগুলো দিয়েই আমি টিব্যাগ স্টোরিজের গল্পগুলো সাজাই।
তাই তো রোজার মধ্যে কখনও রাঁধুনির হালিম মিক্স, ছোলা বা ধোঁয়া ওঠা গরম বেগুনির ছবি, শরতের শিউলি কিংবা কাঠগোলাপের সাদার মায়া খুব সহজেই ফুটিয়ে তোলেন তার ক্যানভাসে। আবার ঈদের আগের রাতে আকাশের চাঁদ কিংবা বাড়ি ফিরতে যাওয়া মানুষের অনুভূতি, কিংবা কখনও কাশফুল, আবার কখনও তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে অপু-দুর্গার রেলগাড়ি দেখতে যাওয়ার মতো মুহূর্তগুলো, কখনও ভরা বর্ষায় কদম ফুল বা হুমায়ুন আহমেদের বৃষ্টিবিলাস, সবই নিপুণ হাতে খুব জোর দেড় ইঞ্চি চওড়া আর দুই ইঞ্চি লম্বা ক্যানভাসে বন্দি করেন তিনি।
যা কিছু অর্জন
বন্ধুকে দেখে সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছবি আঁকা শুরু করা সাদিত পরিবারের সদস্যদের সমর্থন পেয়েছেন বরাবরই। তিন ভাই-বোনের ভেতর বড় সাদিতের মতে, আঁকাআঁকির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজের কী আঁকতে ভালো লাগছে সেটা মাথায় রাখেন সাদিত। এজন্য কাউকে উপহার দেওয়া বা অনুরোধের জন্য ছবি আঁকেন না তিনি।
তবে টিব্যাগ স্টোরিজ নিয়ে সবার মন জয় করা এ তরুণ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানেও বেশ ভালো একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন সাদিত। এরইমধ্যে কাজ করেছেন ইস্পাহানী মির্জাপুর, কাজি অ্যান্ড কাজি টি, রুপালী ইন্সুরেন্স কোম্পানি, বার্জার পেইন্টসের সঙ্গেও।
তুরস্কের টিব্যাগ ফিল্টার পেপার উৎপাদন কোম্পানি 'পেলিপেপার' এর ক্যাটালগ কাভারেও শোভা পাচ্ছে তার চা ব্যাগের গল্প।
ফেসবুক ভিত্তিক মননশীল সংগঠন 'পেন্সিল ফাউন্ডেশন' আয়োজিত একটি প্রদর্শনী হয় গতবছর শিল্পকলা একাডেমিতে। সেখানেও জায়গা করে নেয় টিব্যাগ স্টোরিজ। এবছরও কিছু কাজ নির্বাচিত হয়েছে প্রদর্শনীটির জন্য। গত বছর রাজশাহী আয়োজিত আঁকিয়েদের জন্য ইংক্টোবার এক্সিবিশনেও স্থান পায় তার টিব্যাগের গল্প। এবছর ময়মনসিংহ কার্টুন ফেস্টে প্রদর্শিত হয় তার কাজের প্রিন্টেড কপি।
গত ১৪ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখকে ঘিরে বার্জারের সঙ্গে একটি প্রজেক্টে অংশ নেন তরুণ এ প্রতিভাবান শিল্পী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলে প্রজেক্টটি। তার আঁকা ছবি দিয়ে একটি পোস্ট করে প্রতিষ্ঠানটি। অসম্পূর্ণ ওই পোস্টটি ছিল অনেকটা এরকম, টিব্যাগের ওপর সংসদ ভবনের ছবি আঁকা, সামনে মানিক মিয়া এভিনিউ। সেখানে বার্জারের পক্ষ থেকে বড় করে লেখা, 'এখানে কী হবে বলুন তো।' পরের ছবিতে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের সামনের পুরো রাস্তাটিতে আল্পনাসহ সাদিতের ছবিটি প্রকাশ করে বার্জার।
প্রতিষ্ঠানটির মূল পাতা থেকে শেয়ার করা ওই ছবিটি সেইসময় ব্যাপক সাড়া ফেলে। শেষপর্যন্ত কী হতে যাচ্ছে এটি নিয়ে বেশ আগ্রহ তৈরি হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের ভেতর।
দেবী চলচ্চিত্রের পোস্টারেও টিব্যাগ স্টোরিজ!
হুমায়ূন আহমেদের গল্প অবলম্বনে নির্মিত দেবী চলচ্চিত্রটির প্রচারণামূলক একটি পোস্টার তৈরি করে টিব্যাগ স্টোরিজ। ইস্পাহানী মির্জাপুর নামক চায়ের ব্র্যান্ডটির সঙ্গে এ কাজটি নিয়ে বেশ কঠিন একটি সময় পার করতে হয়েছে তাকে। তবে সেই কঠিন সময়কেও বেশ ইতিবাচকভাবেই নিয়েছেন সাদিত।
তারমতে, 'চলচ্চিত্রটি প্রচারণার সময় কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। অনেকেই বিষয়টি বুঝতে না পেরে তার মাঝে ধর্ম টেনে এনে কিছু হাস্যকর মন্তব্য করেছিল। তবে প্রথমবারের মতো কোনো চলচ্চিত্রের প্রচারণায় টিব্যাগ চিত্র ব্যবহৃত হওয়ায় কাজটির জন্য অনেক মানুষের কাছ থেকে শুভেচ্ছাবার্তা পেয়েছি, এ বিষয়টি অবশ্যই অনেক বেশি উপভোগ্য ছিল।'
এ জায়গা থেকেই সাদিত মনে করেন মানুষ-মানুষে ভেদাভেদ না করা, ধর্ম নিরপেক্ষতা যেমন জরুরি, তেমনি খুব সামান্য কিছু থেকেই আনন্দ বের করে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করাও খুব জরুরি। আর বিষয়গুলো তিনি শিখেছেন তার মা-বাবার হাত ধরে।
সাদিত চান, যতদিন বাঁচবেন, মন ভরে বাঁচবেন। আর তাই তো নিজের অবস্থান বুঝে আনন্দটাকে খুঁজে বের করে, দেশকে ভালোবেসে, নিজের দেশ ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করতে এ ধরনের ভিন্নধর্মী কাজ সবসময় করে যেতে চান তিনি।