বাইক নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দেখতে হয় দুঃসাহসী একদল তরুণের স্টান্ট!
"ভোর সকালে অন্যরা যখন ঘুমিয়ে থাকে, আমরা স্টান্ট রাইডাররা তখন ঢাকার মানুষের চলাচল কম এমন জায়গাগুলোতে ছুটে যাই অনুশীলন করতে। স্টান্ট করা কী পরিমাণ ব্যয়বহুল তা আমরা স্টান্ট রাইডাররা জানি। কোন প্রকার সাপোর্ট ছাড়া শূন্য থেকে দিনের পর দিন প্যাশনের জোরে এই কাজটা চালিয়ে যাওয়া কেমন চ্যালেঞ্জিং তা আমি আমার জীবন থেকে বুঝেছি"- নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এমনটাই জানাচ্ছিলেন 'কেবি রাইডার্জ' বাইকার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জেনিথ কে বি আর।
সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে প্রায়ই হিরোকে বাইক স্টান্ট করতে দেখা যায়। বিশেষ করে হলিউড ও বলিউড সিনেমার দৃশ্যে বাইক স্টান্টের মাধ্যমে হিরোর বীর ও সাহসীসুলভ ব্যক্তিত্ব তুলে ধরা হয়। বলিউড সিনেমা 'ধুম-২' বা হলিউডের 'মিশন ইম্পসিবল' সিনেমায় দেখানো বাইক স্টান্ট দৃশ্যের সাথে কমবেশি আমাদের সকলের পরিচয় আছে। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের বাইকারদের কাছে স্টান্ট কেবল সিনেমার দৃশ্যপটে আটকে নেই। তরুণরা মিলে নিজেদের মধ্যে গ্রুপ করে, নিত্য কঠোর অনুশীলনের মধ্য দিয়ে রপ্ত করে নিচ্ছে স্টান্ট করার কৌশল।
বাইক স্টান্ট করতে চাইলে
বাংলাদেশে কয়েক বছর আগেও এই ধরনের স্টান্ট খুব বেশি দেখা যেত না। বর্তমান বাইকপ্রেমী তরুণ প্রজন্মের কাছে স্টান্ট খুবই জনপ্রিয়। ঢাকার মিরপুর, হাতিরঝিল, গুলশান, বনানী, উত্তরার দিয়াবাড়ি, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ৩০০ ফিটে যখন মানুষের আনাগোনা কম থাকে তেমন সময়ে বাইকারদের স্টান্টবাজি করতে দেখা যায়। বিশেষ করে বিকেলবেলা সাধারণ মানুষের ভিড় জমে স্টান্টবাজি দেখার জন্যে, যদিও উঠতি বয়সের তরুণদের আগ্রহ থাকে তুঙ্গে।
স্টান্ট করার দৃশ্য দেখলে সাধারণ যে কারও চোখ ছানাবড়া ও ভয়ে গলা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এখানে রাইডারস দল চলন্ত বাইক নিয়ে নানারকম দুঃসাহসিক খেলা দেখিয়ে যান। বাইক চালানো অবস্থায় পেছনের চাকা শূন্যে তুলে দেন, যেটাকে স্টান্টের ভাষায় 'হুইলি' বলে। কেউ আবার চলন্ত বাইক থেকে লাফিয়ে নেমে একহাতে বাইকের হ্যান্ডলবার ধরে চক্রাকারে ঘুরাতে থাকেন, এটাকে বলে 'হিউম্যান কম্পাস'। স্টান্টের মধ্যে আরও আছে- সার্কেল হুইলি, স্টোপি, ক্রাইস্ট ইত্যাদি। চলন্ত বাইকের ওপর দু'হাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকা হয় বলে এর নামকরণ করা হয়েছে যীশু খ্রিস্টের নামে। তবে স্টান্ট করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে অনুশীলন; যথাযথ সেফটি গার্ড ছাড়া স্টান্ট করতে গেলে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। স্টান্ট করতে সার্টিফায়েড হেলমেট, সেফটি নী গার্ড, স্নিকারস জুতা, হ্যান্ড গ্লাভস, ১৫০ সিসি ডাবল ডেকার বাইক ও বাইককে স্টান্ট মোডে রাখতে হয়।
কে বি রাইডার্জ গ্রুপের এডমিন জেনিথ কে বি আর বাংলাদেশের প্রথমদিককার একজন স্টান্ট রাইডার। স্টান্ট রাইডার হওয়ার পথটা তার জন্যে মোটেও সহজ ছিলনা। ২০০৮ সালে স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন বিদেশী চ্যানেলে প্রচারিত স্টান্ট শো দেখে স্টান্ট করার প্রতি গভীর আগ্রহ জন্মে। সেখান থেকে ইউটিউব দেখে নিজে নিজেই স্টান্ট অনুশীলন করা শুরু করেন। পরিবারের সমর্থন না থাকায় সকাল হলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে দূরে সাভারে চলে যেতেন অনুশীলন করতে। বড় ভাই ও পরিবারের কাছে বাইক কেনার বায়না ধরে ঘর ছেড়েছিলেন ৩ বার। অবশেষে বাইক পেয়ে পুরোদমে শুরু করেন শখের স্টান্ট শো। সাধারণ একজন রাইডারের থেকে স্টান্ট করা রাইডারদের মাসিক খরচ বেশি, যা জোগাতে তাকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো। তারপরও কথায় আছে, 'শখের তোলা আশি টাকা'। তাই নিজের কষ্টকে মেনে নিয়ে নিয়মিত চালিয়ে গেছেন স্টান্ট অনুশীলন।
বর্তমানে কে বি রাইডার্জ পেজে ৭০ হাজার মানুষ লাইক দিয়ে তাদের কর্মসূচি অনুসরণ করছে। ফেসবুক পেজটি তিনি খুলেছিলেন সমগ্র দেশের স্টান্ট বাইকাদের একত্রিত করে একটি কমিউনিটি গড়ে তুলতে এবং নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখতে। কবে, কোথায় স্টান্ট শো আয়োজিত হবে তার আগাম তথ্য থেকে শো-গুলোতে করা স্টান্টের ভিডিও আপলোড করা হয় এই গ্রুপটিতে। ইতিমধ্যে ২০১৭ সালে 'কে বি রাইডার্জ গ্রুপ' ১৬ ডিসেম্বর ২১০০ বাইক নিয়ে বিশাল র্যালি বহর করে গিনেস বুকে নিজেদের নাম লিখিয়েছে। এই র্যালির প্রতিপাদ্য ছিল, "Use helmet, Ride Safe". গ্রুপের এডমিন জেনিথ কে বি আর বর্তমানে নতুন স্টান্ট রাইডারদের অভিভাবক হয়ে তাদের শখ পূরণের দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন। নিজের জীবনের কঠিন সময়গুলো একা লড়ে গেছেন, পাননি পাশে দাঁড়ানোর মতো পৃষ্ঠপোষক।তাই তিনি চান অর্থাভাবে কেউ যেন নিজেদের শখ পূরণে হেরে না যায়।
জেনিথ বলেন, "ছোটবেলা থেকেই আমার বাইক চালাতে ভালো লাগতো। তখন নিজের বাইক ছিলনা, এলাকার ভাই-বন্ধুদের বাইক নিয়ে চালাতাম। আমরা কয়েকজন মিলে টুকটাক বাইক স্টান্ট অনুশীলন শুরু করি। বাড়ি থেকে একটা সময় আমার স্টান্ট করার জন্য কোনরকম সাপোর্ট ছিলনা। একরকম জেদ ধরে নিজের শখ পূরণ করে গেছি। এখন আমি স্টান্ট করা ছেড়ে দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু নতুনদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ ও অর্থ সহায়তা দিয়ে স্টান্টের পাশে রয়েছি"।
বাংলাদেশে স্টান্ট প্রতিষ্ঠিত হয় যেভাবে
২০১৬ সালে মোটরসাইকেল কোম্পানি ইয়ামাহার হাত ধরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বাইক স্টান্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। তার পূর্বে ফ্রিল্যান্সিং স্টান্ট বাইকাররা নিজেদের মধ্যে টুকটাক স্টান্ট করতো। ইয়ামাহা স্টান্ট বাইকারদের সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে বড় বড় স্টান্ট শো আয়োজনের ব্যবস্থা করে দেয়। বাইকার জেনিথ কে বি আর ও তার গ্রুপের সদস্যদের স্টান্ট করার জন্যে ইয়ামাহা থেকে সেসময় ৭টা দামী বাইক উপহার দেওয়া হয়, যেগুলোর তৎকালীন বাজারমূল্য ছিল ১৭ লাখ টাকা। জেনিথ জানান, "সেসময় ইয়ামাহার এই উদ্যোগ স্টান্ট বাইকারদের জন্যে খরা মাঠে বৃষ্টির মতো আশীর্বাদ বলা চলে"।
এছাড়াও মোটরসাইকেল কোম্পানি পালসার বাংলাদেশের বেসরকারি চ্যানেল এনটিভি-তে 'পালসার স্টান্টম্যানিয়া' নামের একটি অনুষ্ঠান করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্টান্ট বাইকারদের অডিশনের মাধ্যমে সুযোগ করে দেওয়া হয় এই শো তে। বর্তমানে মোটরসাইকেল, হেলমেট ও বাইকের অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রি করা কোম্পানিগুলো স্টান্ট শো-এর আয়োজন করে। কোন কোন কোম্পানি আবার স্টান্ট রাইডারদের চুক্তির ভিত্তিতে স্পনসর করে থাকে।
বর্তমানে কে বি রাইডার্জ গ্রুপে ৬৫০ জন সদস্যের মধ্যে ১৮ জন স্টান্ট রাইডার রয়েছে। বাকিদের বেশিরভাগ হচ্ছে ট্যুর রাইডার, যারা দল বেধে বাইক নিয়ে দেশের নানা প্রান্তে ঘুরতে যান। প্রাথমিক পর্যায়ে এই বাইকার গ্রুপের সদস্য হওয়ার জন্য সদস্য ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা। প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধা মিলবে বাইকারের প্রবল আগ্রহ ও উদ্যমী শক্তি কতটা তার ওপর নির্ভর করে। পুরো গ্রুপে নারী সদস্য রয়েছে মাত্র ৩ জন, যদিও তারা কেউ স্টান্ট করেন না।
গ্রুপের স্টান্ট রাইডারদের মধ্যে আলী আকবর বেশ পারদর্শী একজন স্টান্টার। তিনি বাকি স্টান্ট রাইডারদের সমন্বয়কারী হিসেবে গ্রুপে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও স্টান্ট রাইডারদের মধ্যে আরও আছেন- শান্ত, রনি, ফয়সাল।
স্টান্ট রাইডারদের মধ্যে আছেন মাইকেল, যিনি ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক মোটরবাইক রেসিং-এ অংশগ্রহণ করেন। বাইকারদের কাছে তিনি 'ডেথ রেসার মাইকেল' নামে পরিচিত। ভারতের চেন্নাইতে তে অনুষ্ঠিত রেসিং শো তে ৪০ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ১২তম স্থান দখল করে নেন। 'ইন্ডিয়া কল অব দ্য ব্লু' নামের একটি প্রতিযোগিতায় স্টান্ট করে অন্যদের থেকে ৪ সেকেন্ড আগে শেষ করলেও পুরস্কার তার ঝুলিতে আসেনি। মাইকেল জানান, "আমি রেসার হিসেবে বিজয়ী হলেও আমাকে পুরস্কৃত করা হয়নি। অনুষ্ঠানটি যেহেতু ভিন্ন দেশে আয়োজিত হয়েছিল, আয়োজকদের কথা ছিল তারা নিজ দেশ থেকে প্রাইজ অন্যদেশে যেতে দিবে না। আক্ষেপ থাকলেও আমি খুশী আমার পারফরম্যান্সে"। মাইকেল চলার পথের প্রতিটি ক্ষেত্রে ও শখ পূরণে পাশে পেয়েছেন তার সহধর্মিণীকে। নিজের শখের কাজকে আনন্দের সাথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন স্ত্রীর হাত ধরে।
জেনিথ বলেন, "আমাদের রেসারদের মধ্যে একধরনের পাগলামি কাজ করে। আমরা জীবনে সুখী হতে খুব বেশি টাকা, দামি বাড়ি বা ভালো চাকরি চাইনা। আত্মীয় না হয়েও আমাদের বাইকার কমিউনিটির মধ্যে আছে আত্মার সম্পর্ক। কেউ বিপদে বা কোনপ্রকার আর্থিক ঝামেলায় পড়লে আমাদের কমিউনিটির সকলে ছুটে যায়, যা অন্যদের ক্ষেত্রে ঘটে না। তাই আমাদের জীবনসঙ্গীরা যদি আমাদের কাজকে আমাদের মতো করে ভালো না বাসে, তাহলে সংসার বা প্রেম কোনটাই সুখের হয়না। বাইকপ্রেমী সঙ্গী ছাড়া সাধারণ কারও কাছে আমাদের এই আবেগ বোধগম্য হওয়ার কথা না"।
কে বি রাইডার্জ গ্রুপের সদস্যদের মিলনমেলা ও আড্ডার জন্য ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে 'কে বি রাইডার্জ ক্যাফে' নামে একটি ফাস্টফুড রেস্টুরেন্ট রয়েছে। রেস্টুরেন্টটি সকল কে বি রাইডারসদের ঠিকানা হলেও, এর মালিক হচ্ছেন কে বি রাইডার্জ গ্রুপের প্রধান জেনিথ কে বি আর। অন্যান্য ক্যাফে তে দেয়ালে খাবারের ছবি শোভা পেলেও, এই ক্যাফের চার দেয়ালে জুড়ে স্টান্ট শো এর ছবি টানানো। গ্রুপের সদস্যদের বাইক র্যালি ও ট্যুরের স্থিরচিত্র স্মৃতি হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে ক্যাফের দেয়ালে। ক্যাফের পাশেই আছে জেনিথের নিজস্ব ওয়ার্কশপ দোকান। এখান থেকে বাইকের যান্ত্রিক সমস্যা ঠিক করা হয়ে থাকে।
গ্রুপ থেকে প্রতিটি স্টান্ট শো এর জন্য নির্ধারিত ফি থাকে লাখ টাকার ওপরে। বিভিন্ন জেলায় শো অনুষ্ঠিত হয়, যার জন্যে পিকআপ ভ্যানে বাইক আনা-নেওয়া বাবদ তাদের ২৫ হাজার টাকার বেশি গুণতে হয়। এছাড়াও থাকা-খাওয়া ও যাতায়াত বাবদ খরচের পর বাকি টাকা সদস্যদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ্যতার ভিত্তিতে ভাগ করে দেওয়া হয়। কিছু অর্থ গ্রুপের ফান্ডে অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য জমা রাখা হয়। এই ফান্ড থেকেই পরবর্তীতে আগ্রহী অস্বচ্ছল রাইডারদের খরচ বহন করা হয়।
জেনিথ জানান, "সাধারণ রাইডারের থেকে একজন স্টান্ট রাইডারের মাসিক ১৫ হাজার টাকা খরচ বেশি হয়। স্টান্ট অনুশীলন করতে প্রতিদিন ৬-৭ লিটার তেল প্রয়োজন হয়। এছাড়াও স্টান্ট করতে যেয়ে টায়ার, ব্রেকপেড নষ্ট হয়ে যায়, এগুলো কয়দিন পরপর পাল্টাতে ভালো অঙ্কের টাকা খরচ হয়। আমি আর্থিকভাবে এই সহায়তাগুলো দিয়ে আগ্রহী রাইডারদের পাশে থেকে তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখানে আমার ব্যক্তিগত স্বার্থ এটাই- আমি চাই স্টান্ট রাইডারদের উৎসাহ দিয়ে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি, বাংলাদেশে স্টান্ট কে আরও শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। সমগ্র বাংলাদেশ মিলে ৫০ জন স্টান্ট বাইকারও হবে না। অথচ অন্যান্য দেশে স্টান্ট বাইকারদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে- তাদেরকে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে উৎসাহ দিতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমাদের গ্রুপের প্রতিটি শো ও কাজের মধ্যে দিয়ে আমরা সার্টিফায়েড হেলমেট ব্যবহার ও সাবধানতার সাথে বাইক চালানোর কথা প্রচার করে যাচ্ছি"।