মগের নৌকা ঘুমিয়ে ছিল ২০০ বছর
দিনে ও রাতে যে দুইজন নৌকাটি দেখাশোনা করেন তাদের একজন সিদ্দিক মিয়া। আগের তিন পুরুষের নাম মনে করতে পারেন সিদ্দিক। বয়স তাঁর এখন ষাটের আশেপাশে। করম আলী, তোরাব আলী আর নূর হোসেন যথাক্রমে সিদ্দিক মিয়ার বড় বাবা (দাদার বাবা), দাদা ও পিতা।
সোনার নৌকার কেচ্ছা সিদ্দিককে বলেছেন তার বাবা, দাদার কাছ থেকে বাবাও শুনেছিলেন। একবার সোনার নৌকার কাঠ ও পিতলের পাত খুলে দুজন নাকি মৃত্যুপুরীতেও পৌঁছে গিয়েছিলেন।
পটুয়াখালীর কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে দুই কিলোমিটার পূর্বে ঝাউবনে একটা বিশাল কুয়ার ভেতর তারা নৌকাটির আগা বা গোড়ার কিছু কিছু দেখতে পেত। বালির ভেতর ডুবে ছিল এর বডি, মানে শরীর। সমুদ্র তখন বেশ দূরেই ছিল। ঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবে এই খানিক জেগে উঠত, আবার অনেকটাই সেঁধিয়ে যেত বালিতে।
১৯৯১ সালের জলোচ্ছ্বাস ম্যারিয়েনের দাপাদাপিতে নৌকাটি বালিতে সবটাই দেবে যায়। পরে ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের ধাক্কায় বালু অনেকটাই ক্ষয়ে যায়। নৌকাটির কিছু অংশ আবার বেরিয়ে আসে।
তখন সিদ্দিক মিয়া কাছের এক জায়গায় দোকানদারি করতেন। দোকানটি তার বেশি বড় ছিল না। চা-টা পাওয়া যেত। একদিন তিনি এক সাদা সাহেবকে দেখলেন। নৌকাটির ধারেকাছে ঘোরাফেরা করছে। উঁচু লম্বা লাল চুলের সাহেব। অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নৌকাটি দেখলেন। অবশ্য এটা দেখার মতোই।
সিদ্দিক মিয়ারা যেমন নৌকা দেখেছেন বাপ দাদার সময় থেকে এটি তার চেয়ে ভালোই আলাদা। বিরাট বিরাট তক্তা এর আর গজাল দিয়ে নয়, লোহার রড দিয়ে গাঁথা তক্তাগুলো। এটা বুঝি সে আমলে বানানো যখন স মিল (কাঠ চেরাই কারখানা) ছিল না!
নৌকার শরীরের বাইরেটা পিতলের সোনালি পাত দিয়ে মোড়ানো। তাইতো সোনার নৌকা নাম ছড়িয়েছে দিক-বিদিক। কতক মানুষ হেঁটে আবার কতক মানুষ ভ্যানে চড়ে দেখতে আসে নৌকাটাকে। কোনো কোনো দিন শত মানুষও হাজির হয়ে যায়। তখন সিদ্দিকের সুবিধাই হয়, বেচাবিক্রি বাড়ে কিছু। তবে কেউই ঠিক করে ঠাহর করতে পারে না, কত আগের আমল ছিল সেটা, যখন তৈরি হয়েছিল নৌকাখানা।
মানুষের মুখের অবশ্য লাগাম নাই। কেউ বলে এটি আমীর সওদাগরের জাহাজ যিনি কিনা দক্ষিণ বঙ্গের বড় ধান ব্যবসায়ী ছিলেন। আবার আরব বণিকদের জাহাজও বলে বসে অনেকে। পর্তুগীজ জলদস্যুদের কথাও আনে কেউ কেউ। উচাচি মাতুব্বর যিনি এ তল্লাটের রাখাইন নেতা তিনি অবশ্য বলেন, 'এই নৌকা আমাগো পূর্বপুরুষরাই বানাইছে। আমাগো পূর্বপুরুষরা আরাকান দিয়া এই দেশে আইছে এই নৌকায় চড়ে। এমন একটা-দুইটা নয়, অনেক কয়টি জাহাজই আসছে।'
সিদ্দিক মিয়াও শুনেছেন, বোদাপায়া নামের এক কড়া মেজাজের বলশালী মানুষ ছিল। সে আরাকানের রাজাকে হারিয়ে দিয়েছিল যুদ্ধে আর দখলে নিয়েছিল দেশটা। তারপর শত শত পরিবার ভয়ে নৌকায় করে সাগরে ভেসেছিল। তেমন নৌকার সংখ্যা নাকি দেড়শ আর ঘটনাটা ঘটেছে দুইশ বছরেরও বেশি আগে।
সিদ্দিক মিয়া আরো শুনেছেন, নৌকাটার বয়স পেছাতে পারে আরো দুই-আড়াইশ বছর। তাহলে বয়স হয়ে যাবে চারশো-সাড়ে চারশো বছর। সেটা নাকি বাগেরহাটে ষাট গম্বুজ মসজিদ যিনি বানিয়েছেন, সেই খান জাহান আলীর আমলের ব্যাপার।
ব্যাপারটি উড়িয়ে দেওয়ার মতোও নয়। খান জাহান আলী সাহেব যে মসজিদ বানিয়েছেন সেটা তো এক পেল্লায় ব্যাপার। তার জন্য পাথরও লেগেছে আর সেই পাথর তো নৌকায় করেই আনা হয়েছে। যে নৌকাগুলো ওই পাথর বহন করেছে এই নৌকাটি নাকি সেই নৌকাগুলির একটি।
এখন এই যে সাহেব এসেছেন, দেখা যাক তিনি কোনো মতামত দেন কি না। সাহেবের বুঝি চায়ের তেষ্টা পেয়েছে, উঠে আসছেন সিদ্দিক মিয়ার দোকান বরাবর। না, তিনি চা খাবেন না, চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দোকানের জিনিসপত্র দেখতে থাকলেন।
ছোট এই দোকান, কতই বা দেখবেন, কতক্ষণই বা দেখবেন। তার চোখ স্থির হলো ফিজ আপ নামের পানীয়ের বোতলের ওপর। আঙুল তাক করলেন বোতলটির দিকে, ইশারায় চাইলেন। তিনি টুকটাক ইংরেজি বলেন, তবে ইংরাজদের মতো নয়। সিদ্দিক মিয়া বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন মানুষটা কোন দেশের।
পরে তিনি জেনেছিলেন মানুষটার নাম ইভ মার। আসল বাড়ি ফ্রান্স। তিনি একজন নৌকা বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশের জলে চলে, এমন ৬৫ রকমের নৌকার ছোট ছোট প্রতিরূপ তিনি তৈরি করেছেন। একটা নৌকা জাদুঘর বানাচ্ছেন। বিদেশেও তিনি বাংলাদেশের নৌকা দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশেই বিয়ে করেছেন।
এগুলো জানার পর সিদ্দিক মিয়ার বিশ্বাস স্থির হলো, এবার একটা হেস্তনেস্ত হবে। জানা যাবে নৌকাটা কোন আমলের, কেন এখানে এসে থেমে গিয়েছিল। তবে তার আগে তো নৌকাটাকে বের করে আনতে হবে।
২০১২ সালের মাঝামাঝিতে পত্রপত্রিকায় বেশ লেখালেখি হলো নৌকাটি নিয়ে। ইভসও জোর দিলেন, এটির সংরক্ষণের ওপর। তিনি নৌকা বিশেষজ্ঞ, তার কথার তো একটা মূল্য আছে।
সরকারের প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরেও আলোচনা চলল। তারা নৌকাটি পরিদর্শনের জন্য একটি দলও পাঠাল। দলটিও বালির তলা থেকে উদ্ধার করে এটির সংরক্ষণের ব্যাপারে সহমত পোষণ করল।
কিন্তু নৌকাটি তোলা তো কাদা থেকে হাতি তোলার চেয়েও কঠিন হবে। তাই এগিয়ে আসতে হবে অনেককে, খরচও কম হবে না। তবে আগে দরকার একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। প্রত্নতত্ত্ব দপ্তর লিখল সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেই প্রধান করা হলো কমিটির। সব মিলিয়ে ১১ জন সদস্য।
ইভস মারকে প্রধান করে নৌকাটি উদ্ধারের জন্য একটি কারিগরি কমিটিও গঠন করা হলো। সেনাবাহিনী আর ফায়ার সার্ভিসের সাহায্য চাওয়া হলো। স্থানীয় লোকেদেরও কাজে লাগানো হলো।
তারপর শুরু হলো কর্মযজ্ঞ, ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে। সিদ্দিক মিয়া দোকানদারির পাশাপাশি উদ্ধার কাজেও হাত লাগান সময় সময়। ইভস মার সকালে রুটি আর ফিজ আপ খান কেবল, দুপুরে দুই চামচ ভাত, তাতেই লোকটার গায়ে শক্তি অনেক। থাকেন জিরো পয়েন্টের কাছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউজে। তবে কোনো কোনো রাত ওই নৌকার ধারে খোলা আকাশের নিচেই কাটান। নৌকাটার জন্য মানুষটার মায়া দেখে অবাক হন সিদ্দিক মিয়া।
ইভস নৌকাটিকে জাহাজ বলতেই ভালোবাসেন বেশি। তাঁর মতে এটি স্কুনার, মানে সমুদ্রগামী ছোট্ট জাহাজ। শীতকাল ছিল, সাগর তাই শান্তই ছিল। উদ্ধারকারীদল কাজ করে আরাম পেয়েছে।
সত্তর জনের সে বিরাট দল দুই মাস ধরে লড়াই করে উদ্ধার করল জাহাজটিকে। মেপে দেখা গেল ৭২ ফুট দীর্ঘ এটি, প্রস্থে ২৪ ফুট, উচ্চতায় সাড়ে ১০ ফুটের মতো। ওজন হবে ৯০ টনের কাছে। দুই-তিনশ লোক এতে আরামসে জায়গা পেয়ে যেতে পারে।
ইতিমধ্যে নৌকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তামার তৈরি পেরেক, নারকেলের মালা, ভাঙা মৃৎপাত্রের টুকরো, ধানের চিটা, ভারী ও বিশাল শিকল। আরাকান থেকে তাড়া খাওয়া লোকগুলি বুঝি ছয় মাসের রসদ নিয়ে চেপে বসেছিল জাহাজটিতে। এটি ছিল পালতোলা দ্রুতগতির নৌযান।
কিন্তু এখানে এসে ভিড়ল কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তর মিলছিল না, কারণ সমুদ্র তো ছিল দূরে।
শেষে হিসাব মেলানো হলো এভাবে যে, প্রবল বাতাসে জাহাজটি দিক হারিয়ে ঢুকে পড়ে খাঁড়িতে, আর শেষে আটকে যায় বালুতটে।
তারপর দিন গেছে, মাস গেছে, বছর গেছে আর জাহাজটি ঘাপটি মেরেছিল এই এখানটাতেই।
গর্জন আর শালকাঠে তৈরি এ জাহাজ। সময় দাঁত বসাতে পারেনি। মোটামুটি অক্ষতই আছে জাহাজটি।
উদ্ধার শেষে নৌকাটিকে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে আসার পালা এখন। তার জন্য বসানো হলো রেইললাইন, সেটির ওপর বসিয়ে টেনে আনা হলো জাহাজটিকে। ইভস খুব হুঁশিয়ার ছিলেন, টানাটানিতে এর যেন কোনোরকম ক্ষয়ক্ষতি না হয়।
সত্যি সত্যি তেমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেইনি। ঠিকঠাক মগেদের জাহাজ পৌঁছে গিয়েছিল জিরো পয়েন্টে তার জন্য নির্ধারিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গাটিতে, যেটিকে বলা হচ্ছে মেরিন মিউজিয়াম। এখানেই সিদ্দিক মিয়া দিনে বা রাতে পাহারা দেন। তার সেই দোকানটি, যেখান থেকে ইভস ফিজ আপ খেতেন, সেটিও উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে।
প্রতিদিন শতাধিক লোক আসে জাহাজটি দেখতে। সিদ্দিক মিয়া দর্শনার্থীদের কাছে বলে যান ইতিহাস।
যুদ্ধ মানুষকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। যুদ্ধের কারণে মানুষ ভাসে জলে, হারায় সন্তান, ভোগে অসুখে। দুইশ বছর আগে আরাকান থেকে ভেসে আসা মানুষগুলো অবশ্য এতেই থেমে যায়নি, তারা বন সাফ করেছে, গড়েছে বসতি, ফলিয়েছে ফসল। সিদ্দিক মিয়া সবটাই বলে যান, সবটা মিলেই তৈরি হয়েছে ইতিহাস, যার সাক্ষী এই শাল-গর্জনের নৌকা।