যে কারণে বুড়িগঙ্গার মাঝিরা ঘরে থাকেন না
সদরঘাট থেকে কিছুটা পূর্বে ফরাসগঞ্জ ঘাটে তিনটি পন্টুন নিয়ে একটি জেটি। বিশ্রামবারে দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চগুলো এখানে ভিড়ে থাকে। তাদের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে ভাসে গুটিকয় নৌকা। ফরাসগঞ্জ জামে মসজিদ ঘাট থেকে ওপারে কালিগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত এগুলো যাত্রী পারাপার করে।
ডিউটি টাইম বিকাল ৫টা থেকে রাত ২টা। কাজ শেষে পন্টুনে ফিরে নৌকাতেই ঘুমান মাঝিরা। খুব অল্প সম্বল তাদের। জামাকাপড় বলতে লুঙ্গি, শার্ট আর গেঞ্জি। ঘুমানোর সরঞ্জামের মধ্যে চাটাই, পাতলা কাঁথা আর বালিশ। আরও আছে গামছা। নৌকা বাওয়ার লগি আর বৈঠার কাজ বিশ্রামকালেও কমে না। কখনো এগুলো মশারি বাঁধার খুঁটি, কখনোবা কাপড় শুকানোর লাঠি।
ঈদের দিন (১৭ জুন, ২০২৪) সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছেন খোরশেদ কবিরাজ। সত্তরের কাছাকাছি তার বয়স। পয়ত্রিশ বছর ধরে বুড়িগঙ্গায় নৌকা চালাচ্ছেন, সমান সময় ধরে শয্যাও পেতেছেন নৌকাতেই। তার আছে দুটি পাঞ্জাবী, একটি শার্ট ও দুটি লুঙ্গি। আরও আছে চিরুনি, আয়না, মিল্লাত ঘামাচি পাউডার আর সরিষার তেলের শিশি।
ঈদের দিন সকাল। ঘুম থেকে উঠে বিদ্যুৎ কালো নিমের মাজনের শিশিটি বের করলেন খোরশেদ। ডান হাতে বোতলের ছিপি খুলে বাম হাতে মাজন-গুড়ো ঢেলে দাঁত সাফ করলেন। তারপর ডাঙ্গায় গেলেন সাপ্লাই পানিতে গোসল করতে। দশ টাকা গুনতে হয় এরজন্য। দশ টাকা দামের ছোট একটি সাবান কিনে রেখেছিলেন আগের রাতেই। সেটি দিয়ে গোসল সেরে নৌকায় ফিরে পাউডার গায়ে মাখলেন; আর হাত, পা ও মুখে দিলেন তেল। আয়না ও চিরুনি বের করে চুল আঁচড়ে নিলেন।
তার ওয়্যারড্রোব এবং ড্রেসিং টেবিল বলতে ভারী পলিথিনের একটি ব্যাগ, যেটি থাকে নৌকার খোলে। শেষে ব্যাগ থেকে একটি সাদা রঙের জোব্বা বের করলেন। এটি তার বিশেষ পোশাক। আগের দিন লন্ড্রি থেকে আয়রন করিয়ে এনে রেখেছেন। জোব্বা গায়ে দেওয়ার পর মানুষটিকে শুভ্র দেখাল, চললেন ঈদের নামাজ পড়তে।
মাঝারি গড়নের মানুষটির এই বয়সেও চুলে পাক ধরেনি, গুছিয়ে দাড়ি রেখেছেন, মুখ তেল চকচকে। নামাজ সেরে ফরাসগঞ্জ বাজারের বরিশাল হোটেলে গেলেন। বরাবর এই হোটেলেই খাবার খান। আজ ঈদের দিন বলে সেমাই দিয়ে পরোটা খাবেন। এক প্লেট সেমাই ৪০ টাকা দাম, আর পরোটা তিনটি ত্রিশ টাকা। নাস্তা সেরে এবার একটি পান খাবেন। দিনে তার ত্রিশ টাকা খরচ হয় পানের জন্য। সারাদিনে এটুকুই যা বিলাসিতা।
যে ছয়জন ফরাসগঞ্জ ঘাটে নৌকা বেঁধে থাকেন, তাদের সবার বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ। ডাঙ্গায় ঘর নেওয়ার সাহস কেউ করেননি। এতে যে ভাড়া বেঁচে যায় তা সংসারের অনেক কাজে লাগে। দলের ছয়জনের দুইজন খোরশেদ কবিরাজ ও রাজ্জাক হোসেনের বয়স বেশি, দেলোয়ার হোসেন ও হারুন আকন্দ মাঝবয়সী, রবিউল আর রুবেল অল্পবয়সী।
বত্রিশ বছর বয়সী রুবেল এক বছর হলো বুড়িগঙ্গায় পারাপারের কাজ করছেন। তার আগে মেহেন্দিগঞ্জে পানের বরজ করতেন। দুই বছর আগের এক মৌসুমে প্রায় ১০ লাখ টাকার ফসল তার নষ্ট হয়ে যায়। তারপর আর উপায় না পেয়ে ঢাকায় এসে নৌকার হাল ধরেন।
দুই ধরনের নৌকা আছে জামে মসজিদ ঘাটে— সিরিয়ালের নৌকা আর রিজার্ভ নৌকা। সিরিয়ালের নৌকাগুলো বড় হয়, ১০ জনের বেশি লোক ধরে। সিরিয়ালের নৌকা পেতে হলে ঘাট মালিক বা ইজারাদারকে মোটা অংকের টাকা দিতে হয়। এ নৌকার মাঝিরা সিরিয়াল অনুযায়ী যাত্রী তুলে থাকে, তাদের হাঁকডাক করা লাগে না।
অন্যদিকে, রিজার্ভ নৌকার মাঝিরা সারাক্ষণই 'তেলঘাট, তেলঘাট' বলে চেঁচাতে থাকে। যাত্রী একজন হলেও ৩০ টাকা, একাধিক হলেও ৩০ টাকাই পায় তারা। তবে দিনে ঘাট সর্দারকে ১০ টাকা, ইজারাদারকে ১০ টাকা এবং মাহফিলের (বছরে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান) জন্য ১০ টাকা দিতে হয় মাঝিদের। খোরশেদরা ছয়জনই রিজার্ভ নৌকার মাঝি। সারাদিনে তাদের ৪০০ টাকা খরচ আছে। এরমধ্যে নৌকা ভাড়া ১২০ টাকা, তিনবেলা খাবার খরচ প্রায় ২০০ টাকা, বাকিটা চা অথবা পানে খরচ হয়। সবখরচ বাদ দিয়ে দিনে তারা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বাঁচাতে পারে।
খোরশেদের মা মারা গিয়েছিলেন ছোটবেলায়। তারপর বাবা আরেকটি বিয়ে করেন। ১৪-১৫ বছর বয়সে খোরশেদ ইলিশ ধরার নৌকায় কাজে লেগে গিয়েছিলেন। মাসে ২০-২৫ দিন নৌকাতে থাকতেন। বাড়িতে বেশিদিন থাকতে মন চাইত না, সাংসারিক অশান্তি তাকে বহির্মুখী করে তুলেছিল। শেষ ধাক্কা আসে যখন বাবা তাকে সকল সহায় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন। তার ওপর মাছের কাজেও সুখ ছিল না; খাটনি হতো বেশি, কিন্তু মহাজন টাকা দিতে চাইত না। অথচ ততদিনে তার বিয়েও হয়ে গেছে, একটি কন্যা সন্তানও আছে।
বাড়িতে স্ত্রী-কন্যা রেখে খোরশেদ বুড়িগঙ্গায় নৌকা বাইতে চলে আসেন ১৯৮৮ সালের বন্যার পরপরই। তখন বুড়িগঙ্গার পানি এখনকার মতো কালো ছিল না, জেলেরা ঝাকি জাল ফেলে বোয়াল, শিং, শোল মাছ ধরতেন। নদীর ওইপারের কালিগঞ্জে উচু ভবন ছিল তিন-চারটি। রিজার্ভ নৌকার ভাড়া ছিল ২ টাকা। প্রথম দিন থেকেই নৌকায় সংসার পেতেছেন খোরশেদ, কখনোই আর ঘর ভাড়া নেননি। তিনবেলা হোটেলে খান। লঞ্চের জেনারেটরে মোবাইল চার্জ দেন।
ঝড়-বাদলের দিনে লঞ্চের আশ্রয়ে নৌকা ভিড়িয়ে রাখেন খোরশেদ। বালিশ, কাঁথা ভিজে গেলে পন্টুনে শুকাতে দেন। দিনের বেলা রোদ থেকে বাঁচতে অস্থায়ী ছই লাগিয়ে নেন। নৌকার খোলে ধনুকের মতো বাঁকানো তিনটি বাঁশের কঞ্চি আছে। নৌকার মাচায় সেগুলো কিছুদূর পর পর গেঁথে নিয়ে তার ওপর লুঙ্গি বিছিয়ে ছই তৈরি করেন। নদীর জীবনে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। শীতকালে নদীর পানি যখন কালো হয়ে যায়, দুর্গন্ধে নাক চেপে ধরতে হয় তখনো খোরশেদ নদীতেই ভাসেন। কারণ তার সয়ে গেছে সবকিছু।
খোরশেদ বললেন, "গরীবের অত কিছু বাছলে চলে না। আমাদের মতো আরো শত শত মাঝি নৌকায় থাকে। যদি ঘর ভাড়া করে থাকতাম, তবে ছেলে-মেয়ে বড় করতে পারতাম না। এখন আমার চারটি ছেলে মেয়ে। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, বড় ছেলেটা দর্জির কাজ করে, ছোট ছেলেটা চায়ের দোকানের কর্মচারী। গত ৮-১০ বছরে জিনিসপত্রের দাম খুব বেড়েছে। আগের ২,০০০ টাকা এখনকার ৫,০০০ টাকার সমান।"
নদীর জীবনে খোরশেদের সমস্যা দেখা দিচ্ছে এই এখন ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর। আগের মতো খাটতে পারেন না, রাত ১০টা বাজলেই শরীর আর চলতে চায় না। মানতে হচ্ছে কিছু নিয়মকানুন; যেমন— সকালে আর রাতে রুটি খান। ইনসুলিন কিনে কাছে রাখতে বলেছিলেন ডাক্তার। ইনসুলিন রাখতে হয় ফ্রিজের নরমাল তাকে। কিন্তু খোরশেদের তো ফ্রিজ নেই, ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে ইনসুলিনের শিশি প্লাস্টিকের বোতলে ভরে নৌকার খোলে ভিজা জায়গায় রেখে দিয়েছিলেন, কিছুকাল পরে বুঝেছেন সেগুলোর কার্যকরিতা থাকে না। এখন তাই বিকল্প হিসাবে দুটি করে ট্যাবলেট খান।
আগে খোরশেদ লোক মারফত সপ্তাহে সপ্তাহে টাকা পাঠাতেন, এখন বিকাশ করে দেন। টাকা গুছিয়ে উঠতে পারেননি বলে ঈদে বাড়ি যেতে পারেননি। শুধু তো লঞ্চ ভাড়া নয়, নাতির জন্য জামাকাপড়, বাজার খরচ ইত্যাদিও আছে। তবে সপ্তাহ দুই পরে যাবেন, তখন মেয়েরাও আসবে জামাই নিয়ে, কিছু টাকা তাই জমিয়ে নিচ্ছেন।
খোরশেদ কবিরাজের সাগরেদ হলেন হারুন আকন্দ। লম্বা একহারা গড়নের হারুনের বয়স পয়তাল্লিশ। শান্ত আরও চুপচাপ মানুষ। মেঘনায় মাছ ধরেছেন প্রথম জীবনে। নদীর উথাল পাথালে তার কষ্ট হতো। শেষে মাছ ধরার নৌকা ছেড়ে ঢাকায় এসে যাত্রী পারাপারের নৌকা নিয়েছেন। হারুনের দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলেটা চট্টগ্রামে এক দোকানে কাজ করে, মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, ছোট ছেলে মায়ের সঙ্গে বাড়ি থাকে। তিনি দুই মাসে একবার বাড়ি যান। ঈদে যেতে পারেননি কারণ তিনি ঋণগ্রস্ত। ছয়মাস আগে পেটের পীড়ায় ভুগে বরিশাল হাসপাতালে ২০-২৫ দিন ভর্তি ছিলেন। তখন ঋণ করেই চলতে হয়েছে।
তিনি বললেন, "ঋণের বোঝা খুব ভারী, শোধ না করা পর্যন্ত শান্তি নেই। কোরবানির ঈদে বাড়ি যেতে মন চাইছিল, কিন্তু গেলেই তো খরচ আর রোজগারও বন্ধ। সকালে সেমাই আর পরোটা খেয়েছি। দুপুরে এক স্থানীয় লোক আমাদের জন্য খাবার পাঠাতে পারেন। তাহলে হয়তো গোশত খাওয়ার সুযোগ হবে।"
হারুন আকন্দকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বুড়িগঙ্গার পানির কারণে কি আপনারা অসুখ-বিসুখে ভোগেন? হারুন বললেন, "অনেকদিন নদীতেই গোসল সারি, এই পানিতে জামা-কাপড় ধুই, হাত-মুখও ধুই। এতে চুলকানি হয়। কোনো কোনো দিন দুর্গন্ধ এতো বেশি হয় যে বমি বমি ভাব হয়, মাথা ঘোরায়। এই পানির সঙ্গেই আমাদের সবকিছু। মাঝিরা পেট-ব্যাথা, ডায়রিয়ার মতো পেটের অসুখেও ভোগেন মাঝেমধ্যে।"
রাজ্জাক হোসেন দলের সবচেয়ে বয়স্ক মাঝি। খালি গায়ে থাকেন দিনের বেশিরভাগ সময়। ঢাকায় এসেছেন ৪০ বছর আগে। আগের মতো রোজগার করতে পারেন না, কিন্তু কাজ ছেড়ে দিলে খাবেন কী?
"ছেলেরা সংসার আলাদা করে নিয়েছে, মেয়েরা জামাইয়ের বাড়ি, স্ত্রী মারা গেছেন, আমি এখন একা মানুষ। নৌকা বাইতে শক্তি লাগে, হাত পা ব্যথা হয়ে যায়। বালুর নৌকা, তেলের জাহাজ, বরিশালের লঞ্চ সব সামাল দিয়ে চলতে হয়। ভুল হয়ে গেলে আর রক্ষা নেই," বলছিলেন রাজ্জাক হোসেন।
অন্যরা যখন গল্প করে বা লুডু খেলে তখনো একাই বসে থাকেন রাজ্জাক। জানতে চাইলাম, সামনে কী পরিকল্পনা? রাজ্জাক বললেন, "কোনো পরিকল্পনা নেই, যতদিন গায়ে শক্তি থাকবে নৌকা বেয়ে যাব।"
মাঝি হওয়ার একটি সুবিধার কথা বললেন খোরশেদ কবিরাজ, সেটা হলো স্বাধীনতা। তার ভাষায়, "এখানে আমাকে হুকুম দেওয়ার কেউ নেই। আমি নিজের সুবিধামতো সময়ে কাজে যাই, ভালো না লাগলে পন্টুনে চলে আসি।"
রবিউল মাঝি এরসঙ্গে যোগ করলেন, "আমাদের উপার্জনে কোনো ভেজাল নেই। আমরা কাউকে ঠকাই না, ঠকানোর কোনো সুযোগ নেই। অনেকসময় বরং উপকারে আসি, যার কাছে দুই টাকা-পাঁচ টাকা কম আছে তাকেও পার করে দিই। যাত্রীদের অনেকে অবশ্য খারাপ ব্যবহার করে। তবে ভালো মানুষও আছে, ১০ টাকার জায়গায় ২০ টাকাও দেয়। সব মিলিয়ে আমরা ভালোই আছি।"