বাঁশের পর্দায় ঘর ঠাণ্ডা! দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে মিরিতিনার বাহারি পণ্য...
গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদের অতিষ্ঠতা থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই ঘরে লাগিয়েছেন এসি বা এয়ারকুলার। কিন্তু এগুলো মধ্যবিত্তের অনেকের সামর্থ্যের বাইরে হওয়ায় তারা ঘর শীতল রাখতে বেছে নিয়েছেন এক ভিন্ন পদ্ধতি। ঢাকার বেশকিছু বাড়ির বারান্দায় তাকালে চোখে পড়ে বাঁশের পর্দা ঝুলছে। কেউ কেউ এগুলো লাগিয়েছেন বাইরের রোদ, তাপ থেকে ঘরকে ঠান্ডা রাখতে। কেউ আবার বাঁশের পর্দা ঝুলিয়েছেন শখের গাছকে রোদের হাত থেকে রক্ষা করতে।
অনেকে আবার ঘর ও বারান্দায় নান্দনিকতা আনতেই লাগিয়ে থাকেন বাঁশের ঝুলন্ত পর্দা। আধুনিক নাগরিক জীবনকে প্রকৃতির ছোঁয়ায় সাজিয়ে তুলতে অনেক রেস্তোরাঁয় লাগানো হয়েছে বাঁশের পর্দা। গ্রামে একসময় বাঁশ দিয়ে তৈরি পর্দার ব্যবহার ছিল প্রচুর। কিন্তু কালক্রমে এই ঐতিহ্য এখন ফিকে হয়ে গেছে। গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্যকে নতুন করে মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ থেকেই দুবছর আগে যাত্রা শুরু হয়েছিল সাবিহা শবনমের 'মিরিতিনার'।
হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে ফিরে পেতে...
বগুড়া জেলার দুঁপচাচিয়া উপজেলার সাবিহা শবনম কে লোকে না চিনলেও; তার তৈরি বাঁশের পর্দা এখন শহর থেকে গ্রামের অনেক বাড়িতেই শোভা পাচ্ছে। অঞ্চলভেদে বাঁশের তৈরি পর্দাকে অনেক স্থানে চিক নামে ডাকা হয়। বগুড়া জেলায় এটি সুড়কি বলেই পরিচিত। বাঁশের পর্দা রোদের অতিরিক্ত তাপকে শুষে নিয়ে ঘরকে ঠান্ডা ও শীতল রাখে। সহজেই এগুলোকে গুটিয়ে ভাজ করে রাখা যায় বিধায় ঘরে সবসময় পর্যাপ্ত আলো, বাতাস বয়ে যায়। এ যেন বাঁশের কঞ্চির ফাঁক দিয়ে রোদ আলোর ঝলমল রেখা টেনে খেলা করে যাওয়া।
সাবিহার অনলাইন পেজ 'মিরিতিনা' তে নিয়মিত অর্ডার আসে বাঁশের তৈরির নানা পণ্যের জন্যে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে এতো ভালো সাড়া পাবেন ভাবেননি সাবিহা। তাইতো এখন স্বপ্ন দেখেন নিজের কাজের মধ্য দিয়ে হারানো ঐতিহ্যকে পৌঁছে দিবেন সকলের কাছে। আবার নতুন করে ফিরিয়ে আনবেন বাঙালির বহুকালের চিরচেনা বাঁশ শিল্পের ব্যবহার।
করোনাকালীন ঘরবন্দী সময়ে অনেকেই অনলাইন ব্যবসায় শুরু করেন। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা সে সময়ে উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। অনলাইন গ্রুপ 'উই' তে নারী উদ্যোক্তারা নিজেদের কাজ করা পণ্য থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক নানা বিষয়াদি নিয়ে পোস্ট করতেন। সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সাবিহা ভাবলেন তিনি নিজ জেলার সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করবেন। ছোটবেলায় দাদীর কাছে গল্প শুনেছিলেন খাবার ঘরে বাঁশের পর্দা টানিয়ে রাখা হতো; যেন মাছি, পোকামাকড় ঢুকতে না পারে। কিন্তু কালক্রমে বাঁশ শিল্প এখন অনেকটা বিলীন ও মলিন হয়ে গেছে। তাইতো এখন আর বগুড়া জেলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশের তৈরি পণ্যের ব্যবহার নেই বললেই চলে। সাবিহার হাত ধরে সেই বাশঁ শিল্প যেন নতুন প্রাণ পেয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত বগুড়াতে তিনি একাই এই শিল্প নিয়ে কাজ করছেন। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কেউ কেউ এই শিল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছেন।
২০২০ সালে মাত্র পাঁচশ টাকা মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল 'মিরিতানার'। বহু আগ থেকেই সাবিহার ইচ্ছা ছিল তিনি উদ্যোক্তা হবেন। কিন্তু পরিবারের সায় ছিলো না তার এই সিদ্ধান্তে। তাই নিজের জমানো স্বল্প টাকাতেই ঝুঁকি নিয়ে শুরু করেছিলেন সাবিহা। বর্তমানে তিনি মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন এবং একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পার্ট-টাইম চাকরি করছেন। এতকিছুর মধ্যেও চালিয়ে যাচ্ছেন 'মিরিতিনার' কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি শুরু করেছিলেন তার এই উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা। যা এখনো শত ব্যস্ততায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং দেশের সব প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছেন তার তৈরি বাঁশের পণ্য।
সাবিহা বলেন, "২০১৫ সাল থেকে আমি পিঠা উৎসবে অংশগ্রহণ করি। সেখান থেকে কিছু টাকা আমি জমিয়ে রেখেছিলাম। করোনার দীর্ঘ সময়ে ঘরে বসে না থেকে কিছু করার সিদ্ধান্ত নেই। উদ্যোক্তা হওয়ার ব্যাপারে পরিবার থেকে সমর্থন না থাকায় নিজের জমানো টাকা দিয়ে শুরু করি। কিন্তু বিষয়টি কঠিন হয়ে পড়েছিল কর্মী জোগাড় করতে গিয়ে। কেননা বাঁশের তৈরি পণ্যের চাহিদা ও ব্যবহার কমে যাওয়ায় অনেকেই এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। ২-৩ মাস আমি শুধু কর্মী জোগাড়ের জন্য এক এলাকা থেকে অন্য এলাকা ও বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি। কর্মী খুঁজে পাওয়া, তারপর তাদের রাজি করানো সব কিছুর ক্ষেত্রে আমাকে অনেক ঝক্কি সামলাতে হয়েছিল।"
দুই বছরের মধ্যে ৩০টি জেলায় 'মিরিতিনা'র পণ্য পৌঁছে দিয়েছেন সাবিহা। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়াসহ বেশকয়েকটি দেশে উপহার হিসেবেও গেছে 'মিরিতিনা'র বাহারি সব পণ্য।গত ১বছরে তার কাছে ২৫০টির বেশি বাঁশের পর্দার অর্ডার এসেছে। যার বেশিরভাগ ছিল ঢাকার মধ্যে। কিন্তু এই পণ্যগুলো ক্রেতার গন্তব্যে পৌঁছে দিতে তাকে পাড়ি দিতে হয় মাইলের পর মাইল পথ।
উদ্যোক্তা সাবিহা জানান, "আমার বাড়ি থেকে কুরিয়ার অফিস দূরে হওয়ায় ডেলিভারি দেওয়া নিয়ে শুরুতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হতো। এমনকি শুরুর দিকে আমার একটি পার্সেল পাঠানোর পর তা সিলেট থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। ৫/৬ জন ক্রেতা অর্ডার করার পর সেগুলো বাতিল করে দেয়। এরকম নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল আমাকে। তাই ডেলিভারি চার্জ বাবদ কিছু পরিমাণ অর্থ অগ্রিম নেওয়া হয়। তারপর বাকি টাকা পণ্য হাতে পাওয়ার পর ক্রেতারা পরিশোধ করেন।"
অনলাইন পেজের নাম 'মিরিতিনা' রাখার পেছনে কারণটিও জানালেন সত্ত্বাধিকারী সাবিহা। তিনি বলেন, "আমাদের চার ভাই বোনের নামের প্রথম অক্ষর থেকেই পেজের নাম রাখা হয়েছে। বিক্রি-বাট্টা ভালো হওয়ায় পরিবার থেকেও পরবর্তীতে সমর্থন করা হয় আমার কাজকে।"
বাঁশ দিয়ে বাহারি কারুশিল্প
সাবিহার পেজ 'মিরিতিনা'তে সবচেয়ে বেশি অর্ডারকৃত ও বিক্রিত পণ্যটি হচ্ছে বাঁশের পর্দা। এছাড়াও জুয়েলারি বক্স, ঝুড়ি, হাতপাখা, সোরপশ (ঢাকনা), ডালা, কুলা, টেবিলম্যাটসহ নানারকম বাঁশপণ্যের সমাহার রয়েছে এখানে। বেশিরভাগ পণ্যেই ক্রেতারা নিজেদের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টমাইজ করিয়ে নেন। একেকটি বাঁশের পর্দার উচ্চতা ও চওড়া হয় ক্রেতাদের ঘরের জানালা বা বারান্দার মাপ অনুযায়ী। তাই ক্রেতাদের অর্ডার করার পর মাপ জেনে সে অনুযায়ী তৈরি করা হয় একেকটি পর্দা। 'মিরিতিনার' সবচেয়ে ছোট সাইজের বাঁশের পর্দার জন্যে দাম পরবে ৩০০ টাকা এবং বড় পর্দার একেকটির দাম রাখা হয় ২৪০০ থেকে ২৫০০ টাকা। 'মিরিতিনার' সবচেয়ে ছোট ও স্বল্পমূল্যে পণ্যটি হচ্ছে বাঁশের টেবিল ম্যাট। যেগুলোর প্রতিটির নির্ধারিত মূল্য ১০০টাকা।
উদ্যোক্তা সাবিহা বলেন, "অর্ডার দেওয়ার পর ডেলিভারি পর্যন্ত আমি ক্রেতাদের কাছ থেকে ১৫-২০ দিনের সময় চেয়ে নেই। অন্যান্য পণ্য আগে থেকে বানিয়ে রাখা হলেও পর্দাগুলো অর্ডার পাওয়ার পর মাপ অনুযায়ী বানাতে হয়। এক্ষেত্রে বাঁশ চিকন চিকন করে কেটে নেওয়া হয়, যেটাকে খিল উঠানো বলে। তারপর বাঁশের খিলকে একধরনের মেডিসিনে ভেজানো হয়, যেন পোকামাকড় থেকে অনেকদিন সুরক্ষিত থাকে। পরবর্তীতে সেগুলোকে রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে সেলাই করা হয়। বাঁশ কাটা থেকে সেলাই পর্যন্ত পর্দা বানানোর সম্পূর্ণ কাজ করা হয় হাতে। তাই বড় সাইজের একেকটি পর্দা বানাতে সময় লেগে যায় ৫/৬দিন। আর ছোট সাইজের পর্দা বানাতে ২/৩ দিন সময় লাগে। বাঁশের চিকগুলো ২/৩ বছর বা তার অধিক সময় স্থায়ী হয়। প্রাকৃতিক জিনিস থেকে তৈরি বলে সহজে নষ্ট হয়ে যায়না। তাই অর্থের তুলনায় অধিক স্থায়ী হয় এই পর্দাগুলো।"
বর্তমানে 'মিরিতিনায়' ৭/৮ জন কর্মী নিয়মিত কাজ করেন। নিজের ভাগ্যের চাকার পাশাপাশি উদ্যোক্তা সাবিহা শবনম অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছেন। কর্মীরাই বাঁশ বাছাই করে কেনা থেকে যাবতীয় পণ্য তৈরি করে থাকেন। পর্দা বানাতে বড় ও মজবুত ধরনের তল্লা বাঁশ প্রয়োজন হয়, যেগুলো ৫ ফিট চওড়া হয়। উদ্যোক্তা সাবিহার ভবিষ্যতে ইচ্ছা তিনি একটি কারখানা দিবেন। এবং বৃহৎ পরিসরে বাঁশের কারুশিল্প কে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখবেন।