অন্দরসজ্জায় বাঁশের ঝাড়বাতি আর ল্যাম্পশেডে মুগ্ধতা ছড়াবে আলো-আঁধারির খেলা
ছিমছাম ছোট্ট একটা প্যাসেজ। এপ্লিকের চাদর বিছানো সুন্দর একটি বিছানা। কয়েকটা কুশনও রয়েছে। তার পাশে রাখা ছোট্ট একটা বুকশেলফ। আর ছোট-ছোট বেশ কয়েকটা গাছ বুকশেলফের পাশে। হোম ডেকর নিয়ে কাজ করে এরকম পেজের একটা ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে বেশ কয়েকদিন সামনে এসে পড়ছিল। কিন্তু পুরো ছবিটি অন্যসব ছবি থেকে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ছাদ থেকে নেমে আসা ঝাড়বাতিটির কারণে। বাঁশের তৈরি ওই ঝাড়বাতিটির আলো-আঁধারির দিকে চোখ আটকে যাচ্ছিল বারবার। সেখান থেকেই প্রথমবারের মতো 'ব্যাম্বু ফালক'-কে খুঁজে পাওয়া। বাঁশের তৈরি ঝাড়বাতি আর ল্যাম্প তৈরির কারিগর ব্যাম্বু ফালক। কথা হচ্ছিল ব্যাম্বু ফালকের স্বত্বাধিকারী দিব্য ত্রিপুরার সঙ্গে।
তখন করোনাভাইরাস মহামারির তুমুল প্রকোপ চলছিল। ক্লাস-পরীক্ষার দেখা নেই। সময় কাটাতে আর ব্যবসায়র আগ্রহ থেকে বাঁশের তৈরি ল্যাম্পশেড নিয়ে ব্যাম্বু ফালক বা 'বাঁশের দোকান'-এর ঝাঁপি খোলেন খাগড়াছড়ির দিব্য ত্রিপুরা। এক টেবিল ল্যাম্প যে কতরকমের হতে পারে; ওয়াল ল্যাম্প থেকে শুরু করে ঝুলন্ত ল্যাম্প, টেবিল স্টিকি ল্যাম্প; তার প্রমাণ মিলবে দিব্যর ফেসবুক পেজ ব্যাম্বু ফালক-এ গেলেই। ১১ ইঞ্চি থেকে ২০ ইঞ্চি উচ্চতার এসব এক স্তর, দুই স্তর কিংবা তিন স্তরের ল্যাম্পগুলোর আবার কত ধরন আর কত নিত্যনতুন বাহারি ডিজাইন! বসার ঘর, বেডরুম তো বটেই এমনকি ঘরের পাশের ছোট্ট কোনো প্যাসেজ বা বারান্দায় যেকোনো জায়গাতেই নিঃসন্দেহে মানিয়ে যাবে এসব ল্যাম্পশেড!
শুরুটা করেছিলেন ২০২১ সালের মাঝামাঝির দিকে। সে সময় ঘর সাজানো আর ব্যবসায় আগ্রহের জায়গা থেকে দিব্য খুলে ফেলেন অনলাইন এ পেজটি। বর্তমানে তার পেজের লাইক ছাড়িয়েছে ২৫ হাজার। গোটা ৩০ রিভিউ পেয়েছেন আর জনাবিশেক কর্মীও নিয়োগ দিয়েছেন।
করোনার সময় বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়র আইডিয়া মাথায় ঘুরছিল দিব্যর। প্রথমদিকে কিছুদিন অফলাইনে আইসক্রিমের ব্যবসায় করেছেন। এরপর অনলাইন আরেকটি ব্যবসায় শুরু করেছিলেন তিনি কিন্তু দুটোর একটাতেও সাফল্যের দেখা পাননি। তারপর টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক কাজিনের কাছে প্রথম শোনেন বাঁশ আর বাঁশের তৈরি পণ্যের কথা।
টাঙ্গাইলে ভালো পাওয়া যায় শুনে সেখান থেকেই বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র এনে ব্যবসায় শুরু করেন দিব্য। বর্তমানে টাঙ্গাইলে নিজেই একটি কারখানা তৈরি করেছেন। সেখানে একজন ম্যানেজারের তত্ত্বাবধানে চলে বাঁশের ঝাড়বাতি আর ল্যাম্প তৈরির কারবার। তবে টাঙ্গাইলে কারখানা দেওয়ার আগে যশোর আর রংপুর থেকে বাঁশের তৈরি পণ্য কিনে নিতেন তিনি। সে সময় নিজস্ব কোনো পণ্য ছিল না তাদের।
ব্যাম্বু ফালক নামের রহস্য জানা গেল হেডমাস্টার বাবা-মায়ের বড় ছেলে দিব্যর কাছ থেকে। ইংরেজি আর ত্রিপুরা ভাষায় দোকানের নাম রেখেছেন তিনি। ত্রিপুরা শব্দ 'ফালক'র অর্থ দোকান।
সাধ্যের মধ্যে সাধের ল্যাম্প
ফালকের সব ল্যাম্পশেডগুলো সাধারণত ৯০০ থেকে ২০০০ টাকার ভেতর পাওয়া যায়। উচ্চতা ও স্তরের ওপর ভিত্তি করে সাধারণত দাম নির্ধারিত হয়। এ দাম ওঠানামা করে এক থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যেই। ল্যাম্পের সঙ্গে তার, হোল্ডার, প্লাগ এগুলোও বিনামূল্যেই সরবরাহ করে ব্যাম্বু ফালক।
বাঁশের তৈরি বিভিন্ন পণ্য নিয়ে ব্যবসায়র কাজ শুরু করলেও বর্তমানে ভিন্নধর্মী পণ্য বেশি রাখতে পারেন না দিব্য। এজন্য ইদানীং ল্যাম্পের ওপরই বেশি জোর দিচ্ছে ব্যাম্বু ফালক। তবে ল্যাম্প ছাড়া দিব্যর দোকানে আরও পাওয়া যাবে বাঁশ ও স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি পানির ফ্লাস্ক, ব্রাশ, মগ ইত্যাদি। তবে যেই পণ্যই বিক্রি করা হোক না কেন, তা পরিবেশবান্ধব কিনা তার ওপর সবসময়ই জোর দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন দিব্য।
যেভাবে তৈরি হয় ল্যাম্পশেড
বাঁশের তৈরি ল্যাম্পশেড তৈরি হয় পাঁচ ধাপে। আগে বাঁশ কেটে ফালি করা হয়। এরপরের ধাপে একে ভালো করে শুকিয়ে সিরিশ কাগজ দিয়ে ঘষতে হয়। এভাবে ল্যাম্প তৈরির উপযোগী করা হয় বাঁশকে। তারপর মূল কাজ। বিভিন্ন আকৃতিতে একেকটি ঝাড়বাতি বা ল্যাম্পশেড বানাতে সময় লাগে তিন থেকে চার দিনের মতো।
প্রথমে টাঙ্গাইলের স্থানীয় বাজার থেকে কেনা হয় বাঁশ। পরে চীনের ডিজাইনগুলো দেখে সাধারণত ব্যাম্বু ফালকের ঝাড়বাতিগুলোর নকশা করা হয়। তবে তাদের পণ্যের মান চীনের পণ্যের তুলনায় উন্নতমানের বলে দাবি দিব্যর।
দিব্য বলেন, ব্যাম্বু ফালকের উদ্দেশ্য কেবল বাণিজ্যিক নয়, একইসঙ্গে পরিবেশবান্ধব পণ্য নিয়ে কাজ করা এবং তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াও এর অন্যতম লক্ষ্য। আর সংস্কৃতি রক্ষার বিষয়টি তো রয়েছেই।
ব্যাম্বু ফালকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন দিব্য। খাগড়াছড়ির খাগড়াপুরে তার বাসা। আর ব্যবসায় টাংগাইলে। তবে বাঁশ সংগ্রহ থেকে বিক্রিবাট্টা; সবকিছুই বাসা থেকেই তদারকি করেন তিনি। বাঁশ সংগ্রহকারী ও বাঁশের বাতি প্রস্তুতকারীরা থাকেন টাঙ্গাইলে। হোম অফিসের মাধ্যমে দিব্যসহ আরও চারজন পণ্য বাজারজাতকরণ, ব্যবস্থাপনা ও বিতরণের কাজ করেন।
দিব্য জানালেন, নিছক আলোকসজ্জার জন্য নয় বরং সাজসজ্জার কেন্দ্রবিন্দু ল্যাম্পগুলো। সাধারণত ডাইনিং টেবিলের ওপরে, বিছানার পাশে, স্টাডিতে বা বারান্দার যেকোনো জায়গাতেই চমৎকার মানিয়ে যায় এগুলো। এছাড়া বাতিগুলোর গুণগত মানও যথাযথভাবেই নিশ্চিত করা হয় বলেও জানান তিনি।
১৮৭৯ সালে বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার করেছিলেন বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন। তার আগে ছিল কুপি বাতি, হ্যারিকেন ইত্যাদি। আর রাজা-বাদশা-ধনীদের ঘরে শোভা পেত ঝাড়বাতি। ১৯২০ সালের দিকে এল ল্যাম্পশেড আর পেনডেন্ট লাইট। তাই উচ্চমানের ঝাড়বাতি আর ল্যাম্পশেড এখন সবশ্রেণীর সৌখিন মানুষের ঘরে।
ঝাড়বাতি থেকে শুরু করে ল্যাম্পশেড; বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় সবই। পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী হওয়ায় খুব দ্রুত এ ধরনের পণ্য দখল করে নিয়েছে সব ধরনের খদ্দেরের মন। তার প্রমাণ মিলবে ব্যাম্বু ফালকের ফেসবুক পেজে গেলেই। সেখানে রয়েছে দেশে হোম ডেকরের জন্য পরিচিত কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের ইতিবাচক রিভিউ।
ব্যক্তি দিব্য
পড়াশোনা নিয়ে এখন আর অত মাথা ঘামান না দিব্য। সে নিয়ে অবশ্য বাবা-মায়ের চিন্তার শেষ নেই। তবে পাঠ্যবই না পড়লেও অন্য ধরনের বই গোগ্রাসে গিলেন দিব্য। ইউটিউব দেখেও নিয়মতি শেখেন তিনি। আমাদের দেশে পড়াশোনার পদ্ধতিতে খুব একটা কাজ হয় না বলেই মনে করেন দিব্য।
ব্যবসায়র সব খরচের পর হাতে বেশ ভালোই টাকা থাকে দিব্যর। সেটা দিয়েই শখের পড়াশোনার খরচ ও হাতখরচ দিব্যি চলে যায়। প্রতিমাসে কিছু টাকা জমাতেও পারেন। যদিও বাবা-মায়ের শখ, পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরির জন্য পড়বেন দিব্য। তবে বিষয়টি নিয়ে এ মুহূর্তে বিশেষ কিছু ভাবছেন না বলেই জানালেন তিনি।
ঘরে বসে টাঙ্গাইলে যোগাযোগ রক্ষা করছেন কীভাবে? উত্তরে সহকর্মীদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা দিব্যর। তাদের আন্তরিক সাহায্যের সুবাদে বিশেষ অসুবিধা হয় না দিব্যর। যদিও খদ্দেরদের কারণে বেশ কয়েকবার ভোগান্তিতেও পড়তে হয়েছে দিব্যদের। অনেকসময়ই ক্রেতারা ঠিকমতো বোঝাতে পারেন না তারা কি চাচ্ছেন, তখন ধকলের মাত্রা বেড়ে যায় একটু। খদ্দেরদের যেকোনো সমালোচনাকে স্বাভাবিকভাবে নেন তারা। বিশেষ করে কোনো অভিযোগ থাকলে তা শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
বয়স ১৬ কি ১৭, এরমধ্যেই নিজের ব্যবসায়। শুধু কি ব্যবসা নিয়েই থাকেন নাকি আড্ডা দিতেও ভালো লাগে? 'ব্যবসায় ব্যবসায়র জায়গাতেই।' আপাতত ব্যবসায়কে ঘিরেই নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন দিব্য ত্রিপুরা।