সেনচা, হোয়াইট টি... দার্জিলিং টি, বিশ্বের সেরা ১০ চায়ের তালিকায় আরও যা যা আছে!
চা এমন একটি পানীয় যা নিয়ে খুব বেশি ভূমিকা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে চায়ের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। ভৌগলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে চা যুক্ত হয়ে গেছে বহু মানুষের আটপৌরে পানীয়র তালিকায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে চমৎকার এক কাপ চায়ে চুমুক দিলেই অনেকের মন ভালো হয়ে যায়। আবার ক্লান্তি-উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলে চাঙা হয়ে উঠতেও চায়ের জুড়ি নেই।
বিশ্বে নানা ধরনের চা উৎপাদিত হয় এবং স্বাদ ও মানের দিক থেকেও রয়েছে নানা পার্থক্য। চা পান করা যাদের কাছে প্রায় নেশার মতো, সেরা চায়ের স্বাদ নেওয়ার জন্য তারা সবকিছুই করতে পারেন। সেই সব চা-প্রেমীদের জন্যই থাকছে বিশ্বের সেরা ১০ চায়ের তালিকা।
১০. সেনচা
জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রিন টির নাম সেনচা। সরাসরি সূর্যালোকের নিচে আবাদ করা হয়, এমন চা পাতা থেকে আসে এই চা। পাতাগুলো তোলার পর অল্প সময়ের জন্য এগুলোকে ভাপে রাখা হয় এবং রোল করে শুকাতে দেওয়া হয়। সেনচা'র কয়েকটি প্রকারভেদ রয়েছে, যেমন- শিনচা বা ইকিবান-চা'কে সেনচার সবচেয়ে ভালো মানসম্পন্ন চা হিসেব ধরা হয়।
মৌসুমের প্রথম চা পাতা থেকে আসা এই চা সাধারণত মিষ্টি ধরনের হয় এবং কোমল ফ্লেভার থাকে। জাপানি সেনচার পাতা সবুজ এবং সূচের মতো দেখতে। কিছুটা মিষ্টি এবং কিছুটা কষজাতীয় স্বাদ এই চায়ের। সীফুড এবং ভাতের সাথে এই চা খেতে দারুণ।
৯. হোয়াইট টি
হোয়াইট টির উৎপত্তিস্থল চীন। গ্রিন বা ব্ল্যাক টির চেয়ে এই চায়ের রঙ হালকা এবং ফ্লেভারও হালকা হয়। হোয়াইট টিরও কয়েকটি প্রকারভেদ রয়েছে, কিন্তু আসল চমক হলো- চা গাছের পাতা যখন পুরোপুরি খোলে না এবং কুড়িগুলো কোমল-সাদা কেশে আবৃত থাকে, তখন পাতাগুলো সংগ্রহ করে গুড়ো চা পাতাতে রূপ দেওয়া হয়। আর সে কারণেই এটির নাম হোয়াইট টি।
হোয়াইট টি সাধারণত নন-অক্সিডাইজড কিংবা সামান্য অক্সিডাইজড হয় যা এর কোমল ভাবকে ধরে রাখতে সাহায্য করে। যখন এই পাতা থেকে চা বানানো হয়, দেখা যায় এটি হালকা হলদে রঙ ধারণ করেছে। এই চা থেকে কখনো কখনো ফুল, ফল, মধ্য, ভ্যানিলা বা ভেষজ ফ্লেভার পাওয়া যায়।
৮. উলং
উলং এক প্রকারের সেমি-অক্সিডাইজড চা যা পাতার ধরন, অক্সিডাইজেশন, রঙ ও রোস্টিং এর মাত্রার উপর ভিত্তি করে নিজের রূপ পরিবর্তন করে। গ্রিন ও ব্ল্যাক টি'র মাঝামাঝি পর্যায়ের এই চায়ের অসংখ্য প্রকারভেদ রয়েছে।
সুগন্ধ ও ফ্লেভারের দিক থেকে নানা ধরনের উলং চা রয়েছে। হালকা সবুজাভ বা হলদে থেকে শুরু করে গাঢ় কমলা রঙ এর হতে পারে এই চা এবং এর মধ্যে ফুটিজাতীয় ফল, অ্যাপ্রিকট, অর্কিড, মশলা, এমনকি কাঠের সুগন্ধও পাওয়া যেতে পারে! এই চায়ে অক্সিডেশনের মাত্রা থাকে ১০-৮০ শতাংশের মধ্যে। সবচেয়ে কম অক্সিডেশনের মধ্যে যেটি রয়েছে, সেটির সাথে গ্রিন টি'র সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে, সবচেয়ে বেশি অক্সিডেশনের চায়ের সাথে ব্ল্যাক টি'র সাদৃশ্য দেখা যায়।
৭. মাচা
মাচা এক ধরনের চীনা গ্রিন টি। চা পাতা তোলার প্রক্রিয়া, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পানীয় হিসেবে প্রস্তুত প্রণালী- সবদিক থেকেই এটি অদ্বিতীয়। চা পাতা তোলার তিন থেকে চার সপ্তাহ আগে চা গাছগুলোকে ঢেকে দেওয়া হয় সরাসরি সুর্যালোক থেকে বাঁচাতে। এরপর বাকি দিনগুলোতে ছায়ার মধ্যে গাছগুলো বেড়ে ওঠে।
ফসল তোলার পর পাতাগুলো ছাড়িয়ে নেওয়া হয় এবং প্রক্রিয়াজাত করে চায়ের গুড়ো বানানো হয়। মাচা চা সবসময় একেবারে গুড়ো অবস্থায়ই পাওয়া যায়, দানাদার নয়। চীনে প্রথম এই চায়ের প্রচলন হলেও বর্তমানে জাপানেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
৬. সিলন চা
শ্রীলঙ্কায় উৎপাদিত হয় বলে এই চায়ের নাম সিলন চা। শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন নাম ছিল সিলন। দ্বীপরাষ্ট্রটির বিভিন্ন অঞ্চলে চা বাগান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এবং উপযুক্ত জলবায়ুর কারণে সারা বছরই শ্রীলঙ্কায় চা উৎপাদিত হয়।
তবে সিলন ব্ল্যাক টি সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং এর সবচেয়ে ভালো আবাদ হয় দ্বীপের মধ্যভাগে ও সবচেয়ে উঁচু জায়গায় অবস্থিত চা বাগান থেকে। মাঝারি উচ্চতায় জন্মানো চা গুলোতে ফ্লেভার অনেক বেশি থাকে এবং সবচেয়ে নিচুতে জন্মানো চা পাতা সাধারণত মিশ্রণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৫. পু এরহ
পু এরহ-কে বলা হয় পুরনো বা ভিন্টেজ চা পাতা। চীনের ইউনান প্রদেশ এই চা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এর প্রধান দুটি প্রকারভেদ রয়েছে- গাঁজনমুক্ত পু এরহ, যার নাম পু এরহ শেং এবং অন্যটি হলো গাঁজান পু এরহ, যার নাম পু এরহ শু।
গাঁজনমুক্ত পু এরহ এর ফ্লেভার বেশ সজীব এবং কিছুটা তিতকুটে ও কিছুটা মিষ্টি ভাব রয়েছে এর মধ্যে। অন্যদিকে, গাঁজান পু এরহ এর মধ্যে কিছুটা মেটে ফ্লেভার পাওয়া যায়। এই চা পাতাগুলোকে ব্রিক টি (জুয়ান চা), কেক টি (বিং চা), বেল-আকৃতির চা (তোয়া চা) কিংবা মাশরুম আকৃতির চা-তে (মাও গু তোয়াও) রূপ দেওয়া যায়।
৪. ইংলিশ ব্রেকফাস্ট টি
যুক্তরাজ্য ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই চা বেশ জনপ্রিয়। আসাম, সিলন, চীনা ও কেনিয়ান ব্ল্যাক টি মিশ্রণ এটি। ইংলিশ টর নাম শুনে এর উৎপত্তিস্থল বুঝা গেলেও তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে অনেকের। কারো কারো মতে, ১৮৯২ সালে স্কটিশ চা মাস্টার ড্রাইসডেল এই চা উদ্ভাবন করেন যা রানি ভিক্টোরিয়ার প্রিয় ছিল। বলা হয়ে থাকে, রানিই চা'টির এই নাম দেন। আবার কেউ কেউ রিচার্ড ডেভিসকে এই চা উদ্ভাবনের কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন।
৩. গ্রিন টি
গ্রিন টি একটি নন-অক্সিডাইজড চা। হালকা সবুজ রঙ এর এই চায়ে রয়েছে ভেষজ গুণাবলি। চিরহরিত চায়ের গুল্ম দিয়ে এই চা পাতা তৈরি হয়। প্যান ফ্রাই বা ভাপের মাধ্যমে চা পাতার অক্সিডেশন দূর করে তারপর এটি প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের গ্রিন টি পাওয়া যায়। চায়ের আবাদ, ফসল তোলা, উৎপাদনের প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে চা পাতার মধ্যেও পার্থক্য হয়। সজীব-সতেজ, ঘেসো বা হালকা ফুলেল ফ্লেভার আসে এই চা থেকে।
২. ব্ল্যাক টি
ব্ল্যাক টি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় শ্রেণীর একটি চা। এই চা বানানোর সময় অক্সিডেশনের ফলে ক্যামেলিয়া সিনেসিস চা গাছের পাতা গাঢ় রঙ ধারণ করে। ফুটন্ত পানিতে দেওয়ার পর এটি বাদামি রঙ ধারণ করে এবং তীব্র সৌরভ বের হয়। এর স্বাদ মিষ্টি, মেটে, বাদামি বা ফ্রুটি হতে পারে।
১. দার্জিলিং টি
ভারতের দার্জিলিংয়ে উৎপাদিত এই চা বিশ্বের সবচেয়ে সেরা চা হিসেবে বিবেচিত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলায় চা উৎপাদন শুরু হয় জনৈক ইংরেজ আর্থুর ক্যাম্পবেলের (১৮০৫-১৮৭৪) মাধ্যমে, যিনি দার্জিলিং-এ নিজের ব্যক্তিগত বাগানে চা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। সেখান থেকেই তিনি ১৮৬৪ সালে দার্জিলিং কোম্পানি চালু করেন যা পরে ১৮৯৬ সালে 'দার্জিলিং কনসোলিডেটেড টি কোম্পানি' নাম দেওয়া হয়।
সূত্র: টেস্ট অ্যাটলাস