১৯ শতকে কলকাতার যৌনকর্মীরা কেন ফরাসি এক কলোনিতে পালিয়ে গিয়েছিল
চন্দননগর। ফরাসি স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত। এই চন্দননগরের গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে ৫০০ মিটার জায়গা নিয়ে অবস্থিত লক্ষ্মীগঞ্জ বাজার।
লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারে আছে কিছু ছোট ও মাঝারি আকারের দোকান, কিছু আবাসিক ভবন ও একটি শপিং কমপ্লেক্স। কিন্তু এসবের কোনোটির মাঝেই প্রাণচঞ্চল অতীতের কোনো চিহ্ন নেই, যে অতীতে এখানে ঠাঁই হয়েছিল বাংলার নিষ্ঠুর ব্রিটিশ আইনের হাতে সাজা পাওয়া যৌনকর্মীদের। এককালে যে এখানে লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের অস্তিত্ব ছিল, সে কথাও আজ অধিকাংশ মানুষ বিস্মৃত।
সময়ের আবর্তে চন্দননগরের ফরাসি স্থাপত্যের সিংহভাগই আজ রিয়েল এস্টেটের উদরে। টিকে আছে শুধু ১৯২১ সালে গঙ্গার তীরে নির্মিত প্রমোদকেন্দ্র চন্দননগর স্ট্র্যান্ড।
১৭ শতকের শেষের দিকে ফরাসি বসতি হিসেবে চন্দননগরের পত্তন হয়। এর পরের একশো বছর বা তারও বেশি সময় ধরে চন্দননগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফরাসি ও ব্রিটিশদের মধ্যে লড়াই চলে। তবে ব্রিটিশ-ফরাসিদের হানাহানির মাঝেও চন্দননগরে বহাল তবিয়তে যৌন ব্যবসা টিকে থাকে। ধীরে ধীরে শহরটিতে যৌনকর্মীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
পরে লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারে যৌনকর্মীদের ঢল নামে। ১৮৬৮ সালে ব্রিটিশরা ইন্ডিয়ান কন্টাজিয়াস ডিজিজেস অ্যাক্ট (সিডিএ), বা অ্যাক্ট ১৪ প্রণয়ন করে। এ আইনের আওতায় সমস্ত যৌনকর্মীদের সরকারি নিবন্ধন নিতে হতো। সেইসঙ্গে তাদের যৌনরোগ আছে কি না, তা নির্ণয়ের জন্যও পরীক্ষা করতে হতো। আশা ছিল, আইনটির সুবাদে ব্রিটিশ সৈন্যরা যৌনকর্মীদের থেকে দূরে থাকবে। কিন্তু আইনটি উল্টো যৌনকর্মীদের ওপর নিপীড়নের খাঁড়া হয়ে নেমে আসে। ফলে যৌনকর্মীরা চন্দননগরে চলে যান।
সিডিএ বা চৌদ্দ আইনের সমালোচনা করে পুস্তিকাকারে অসংখ্য প্রহসন ছাপা হয়। এসব প্রহসনের মধ্যে ছিল 'বদমাইশ জব্দ', লেখক প্রাণকৃষ্ণ দত্ত। ১৯ শতকের বাংলায় যৌনকর্মীদের জীবনের করুণ আখ্যান এ বই।
গবেষক সুরজিত সেন লিখেছেন, 'অ্যাক্ট ১৪ ছিল একটি হঠকারী আইন বাজেভাবে প্রয়োগের ঘটনা। যার ফলে সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শ্রেণি নির্যাতনের শিকার হয়, এবং শেষ পর্যন্ত তাদের জীবিকা শেষ হয়ে যায়।'
'চৌদ্দ আইনের' সংকট
ইতিহাসবিদ সুমন্ত ব্যানার্জির 'ডেঞ্জারাস আউটকাস্ট: দ্য প্রস্টিটিউট ইন নাইনটিনথ-সেঞ্চুরি বেঙ্গল' বই থেকে জানা যায়, ১৮০০-র দশকে কলকাতা এবং এর উপকণ্ঠে বাণিজ্যিক যৌনকর্মের বিকাশ ঘটে।
প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলে তাওয়াইফরা সম্মান নিয়েই বাঁচতেন। তারা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন, শিল্পকলায় সম্পৃক্ত হতেন এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশ নিতেন।
কিন্তু ব্রিটিশ আমলে গণিকা ও উপপত্নীদের সম্মান কমতে শুরু করে। এ সময় বাণিজ্যিক যৌনকর্মীদের কাজ ছিল শরীরী আনন্দ দেওয়া। রাজ্যের সবচেয়ে ঠিকানাহীন ও বাস্তুচ্যুত নারীরাই এ সময় কলকাতায় এসে যৌনকর্মীর পেশায় যোগ দিত।
যৌনকর্মীদের প্রতি ব্রিটিশদের আচরণ ছিল দ্বিচারিতায় ভরা। একদিকে এ পেশাকে ব্রিটিশরা অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। অন্যদিকে ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য যৌনকর্মকে সংগঠিত ব্যবসায় পরিণত করে। এখানেই চলে আসে সিডিএর প্রসঙ্গ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে ব্রিটিশ সৈন্যদের পতিতালয় গমন থেকে রোখা যায়নি। ব্রিটিশ সৈন্যদের অনেকেই যৌনরোগে আক্রান্ত হয়। এতে সৈন্যদের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, সেইসঙ্গে প্রশাসনের ঘাড়ে বাড়তি স্বাস্থ্যসেবার বোঝা চাপে। কোম্পানির কাছ থেকে ভারতীয় প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার এটি বন্ধ করার চেষ্টা করে। ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ সরকার ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট প্রবর্তন করে। সেইসঙ্গে যৌনরোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের জন্য 'রেজিমেন্টাল বাজার'-এর মধ্যে সরকারি গণিকালয় নির্মাণের নির্দেশ দেয়।
কিন্তু উদ্যোগটি শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। সৈন্যরা ঘন ঘন ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাতায়াত করত কিংবা নিজেদের ব্যারাক থেকে পালিয়ে অন্যত্র যৌনমিলন করত। এতে যৌনরোগের বিস্তার অব্যাহত থাকে। এ কারণে ১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিল ব্রিটিশরা ভারতে কন্টাজিয়াস ডিজিজেস অ্যাক্ট প্রবর্তন করে।
সিডিএ অনুসারে ভারতে যৌনকর্মীদের সরকারিভাবে নিবন্ধিত নিতে হতো। সেইসঙ্গে যৌনরোগ আছে কি না, তা নির্ণয়ের পরীক্ষাও বাধ্যতামূলক করা হয়। কোনো যৌনকর্মীর মধ্যে যৌনরোগ পাওয়া গেলে তাকে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হতো এবং কাজে ফেরার উপযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত চিকিত্সা নিতে হতো। কেউ সরকারিভাবে নিবন্ধন করতে রাজি না হলে তাকে জেলে ভরে দেওয়া হতো।
কলকাতার যৌনকর্মীরা এ আইনের কঠোর সমালোচনা করে। তাদের যুক্তি ছিল, আইনটি তাদের ব্যবসার জন্য খারাপ করছে। কারণ এর ফলে তাদের দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে হতো।
অনেক যৌনকর্মী ঘুষ দিয়ে ছাড়া পেলেও রাস্তায় পুলিশ এই অসহায় নারীদের ওপর নিপীড়ন করত। এর ফলে কলকাতার যৌনকর্মীরা এলাকা ছাড়তে শুরু করে। ১৮৮৭ সালের একটি সরকারি মেমো থেকে জানা যায়, অর্ধেকেরও বেশি গণিকা শহর ছেড়ে শহরতলিতে এবং আরও দূরে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
দুই নগরের গল্প
লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের বয়স কলকাতার গণিকালয়ের চেয়েও বেশি। চন্দননগরের ইতিহাসবিদ বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, সফররত ব্যবসায়ীদের জন্য ১৭০০-র দশকে গড়ে ওঠে লক্ষ্মীগঞ্জ বাজার।
কলকাতা থেকে পালিয়ে আসা বহু যৌনকর্মী লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারে আশ্রয় নেয়। বিপুলসংখ্যক পতিতা আসায় ফরাসি সরকার তাদের ওপর করারোপ করতে শুরু করে। লক্ষ্মীগঞ্জ বাজার হয়ে ওঠে গণিকাদের আনুষ্ঠানিক কাজের জায়গা। কয়েক শতাব্দী পরে রিয়েল এস্টেট গড়ে তুলতে সহায়তা করার জন্য বামফ্রন্ট সরকার ১৯৮০-র দশকে লক্ষ্মীগঞ্জ বাজার থেকে গণিকাদের বিতাড়িত করে। তারা তখন পার্শ্ববর্তী চুনসুরা ও কালনা শহরে আশ্রয় নেয়।
সংখ্যায় অনেক বেশি হওয়ায় ১৯ শতকে যৌনকর্মীরা অত্যন্ত সস্তা হয়ে পড়ে। প্রাণকৃষ্ণ দত্তের সমসাময়িক অঘোর চন্দ্র ঘোষ 'পাঁচালী কমলকলি' প্রহসনে লিখেছেন, 'আট পয়সার মজুর যারা খেজুর চাটায় থাকে/খাটপলঙ্কী খাসা বিছানায় শুচ্ছে লাখে লাখে'।
এদিকে কলকাতা ও অবশিষ্ট ব্রিটিশ বাংলায় সিডিএর অত্যাচার অব্যাহত থাকে। এ সময় প্রতিদিন অন্তত ১২ জন নারীকে নিয়ম না মানার জন্য জেলে পাঠানো হতো। এছাড়া কারাগার ও হাসপাতালে থাকাকালে ভারতীয় পতিতা এবং ইউরোপীয় ও ইউরেশীয় বংশোদ্ভূত পতিতাদের সঙ্গে পুলিশ আলাদা আচরণ করত।
এতে ভদ্রলোক সমাজের সহানুভূতি যৌনকর্মীদের পক্ষে চলে যায়। কলকাতার মধ্যবিত্তরা প্রথমে আইনটিকে সমর্থন দিয়েছিল। তারা ভেবেছিল, এই আইনের ফলে গণিকাবৃত্তির অশুভ ছায়া কেটে যাবে। কিন্তু পরে তারা বুঝতে পারে, সিডিএ আসলে অসহায় এই নারীদের ওপর নিপীড়ন চালানোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তাই তারা এ আইন বাতিল চায়।
যুক্তরাজ্যেও সিডিএ প্রচলিত ছিল। সেখানেও আইনটি বাতিলের জন্য আন্দোলন করছিল লেডিস ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন। ১৮৮৬ সালের এপ্রিলে যুক্তরাজ্যে আইনটি বাতিল করা হয়।
এরপর লেডিস ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ইন্ডিয়ান সিডিএর দিকে নজর দেয়। ভদ্রলোক রাজনীতিবিদরাও এ আইন বাতিলের আন্দোলনে নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন জোগান। ভারতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী লক্ষ করে স্রোত বদলে যাচ্ছে। এছাড়া গ্রেপ্তারকৃত যৌনকর্মীদের অল্প কজনই কেবল দোষী সাব্যস্ত হন। আর হাসপাতালে চিকিৎসাও পান খুব কম গণিকাই।
অবশেষে ব্রিটিশরা হার মানে। প্রবর্তনের ২০ বছরেরও বেশি সময় পর অবশেষে ইন্ডিয়ান কন্টাজিয়াস ডিজিজেস অ্যাক্ট প্রত্যাহার করা হয়।
এখনও আছে সংস্কার
কমিউনিস্টপ্রভাবিত নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থানের কারণে পরের শতাব্দীতে চন্দননগরে পতিতাবৃত্তি কমে আসে। অন্যদিকে ব্রিটিশদের বিদায়ের ফলে কলকাতায়ও যৌন বাণিজ্য ফের রমরমা হয়ে ওঠে। এবার কলকাতার সোনাগাছি হয়ে ওঠে যৌন ব্যবসার কেন্দ্র।
১৮৬৮ সালের আইনের কারণে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছিল—যৌনকর্মীদের মধ্যে যৌন-সংক্রামক রোগ বা সরকারি দমনপীড়ন—তা কি এখনও আছে? এ প্রশ্নের উত্তরে পশ্চিমবঙ্গের ৬৫ হাজার যৌনকর্মীর সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির পরামর্শদাতা ভারতী দে বলেন, হ্যাঁ এবং না দুটোই।
১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটি যৌনকর্মীদের জন্য সমর্থক গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করে, তাদের কাজের পরিবেশ নিরাপদ করে। ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশনের সঙ্গে সংগঠনটি যৌথভাবে যৌনকর্মীদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ৪৯টি ক্লিনিক পরিচালনা করে।
ভারতী দে বলেন, তাদের সংগঠন যৌনকর্মীদের ক্ষমতায়ন করেছে এবং যেসব গ্রাহক কনডম ব্যবহার করতে চায় না তাদের না বলার ক্ষমতা দিয়েছে।
২০১৮ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ভারতের ১.৬ শতাংশ নারী যৌনকর্মী ২০১৭ সালে এইচআইভি-পজিটিভ বা এইডসে আক্রান্ত ছিল এবং ৯১ শতাংশ যৌনকর্মী ২০১৮ সালে কনডম ব্যবহার করেছিলেন।
তবে এখনও অনেক বাধাবিপত্তি আছে। ভারতী দে বলেন, 'যৌনকর্মীদের সরকারি তালিকায় নাম নিবন্ধন করতে হবে কেন? আজও প্রায়ই পুলিশ বা সরকার এই ধরনের অনুরোধ নিয়ে আমাদের কাছে আসে। ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পরিচয়ের প্রমাণ সব যৌনকর্মীর কাছে আছে। তাহলে কেন তারা স্বাধীনভাবে তাদের ব্যবসা করতে পারে না?'
কলকাতার যৌনকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হলেও তাদের প্রায়ই সামাজিক কুসংস্কার ও হয়রানির শিকার হতে হয়। ২০১০-এর দশকের গোড়ার দিকে তারা সোনাগাছিতে দুর্গাপূজা উদযাপনের অনুরোধ জানায়, কিন্তু স্থানীয়রা তাদের অনুরোধের বিপক্ষে প্রতিবাদ করে। বিষয়টি কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। ওই মামলায় যৌনকর্মীরা জেতেন।
যৌনকর্মীরা এমন আরও অনেক অধিকার আদায়ের জন্য লড়ছে বলে জানান ভারতী দে। দেশটিতে যৌনকর্মীরা এখনও শ্রম আইনের আওতায় আসেনি। ভারতে পেশাটিও এখনও বৈধতা পায়নি।