বাজার, থানা, মন্দির, মিনার: কবিতার মতো বিমূর্ত রূপ নিতে চাইছে আজ
মগবাজারে আশরাফ ভূঁইয়ার দাদার চকমিলানো জমি ছিল। প্রভাব-প্রতিপত্তিও কম ছিল না, তবু আশরাফ বখে যাননি। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই তিনি ব্যবসা করতে লেগে যান। দেখতে সুন্দর ছিলেন। মেয়েরা তার প্রেমে পড়ত, যেমন পড়েছিলেন বিনি। জেদিও ছিলেন বিনি। ভাবতেন প্রেম যেহেতু করেছি, বিয়েও করে ফেলব। একসময় আশরাফকে জীবনসঙ্গী বানিয়েও নেন।
বছর ৩০ আগে আশরাফ মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুরে (বসিলায়) একটা জমি কেনেন। তবে জায়গাটা পুরোদস্তুর শহর হয়ে ওঠেনি বলে আশরাফ আর বিনি দোটানায় ভুগতে থাকলেন। বাড়ি ওঠানোর টাকা দিয়ে ধানমন্ডির মতো জায়গায় ফ্ল্যাট কেনার কথাও ভেবেছিলেন। শেষে যখন মনস্থির করলেন, বাড়িই বানাবেন; আর তা ওই বসিলাতেই– তখন আরেক ঝামেলা দেখা দিল।
একজন ভালো স্থপতি দিয়ে নান্দনিক একটি বাড়ি বানানোর ইচ্ছা তাদের। জায়গা ছোট তার ওপর বসিলায়, তারকা খ্যাতি পাওয়া স্থপতিরা কি সময় দেবেন? না হয় 'কনসালটেন্সি ফি' কিছু বেশিই হবে; তবু ভালো স্থপতি দিয়ে বানাবেন একটা সুন্দর বাড়ি– স্বপ্নের বাড়ি। বিনি হুমায়ুন আহমেদের ভক্ত। বিছানায় শুয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখার সাধ তার বহু পুরোনো– যদিও সম্বল মাত্র পৌনে দুই কাঠা।
বিনির সাধপূরণে আশরাফ গলদঘর্ম। মাসে দু-তিন জন স্থপতির সঙ্গে বৈঠক করেন্। কিন্তু এটা মিলে তো সেটার অমিল হয়। অবশেষে এক সুন্দর সকালে, তখনও ঘুমাচ্ছিলেন বিনি; আশরাফ তাকে ডেকে তুলে বললেন, আমি বের হচ্ছি। বিনি ঘুম ঘুম চোখেই বললেন, 'আজ একটা সুরাহা করেই এসো। আর ভালো লাগছে না'।
মগবাজার থেকে ধানমন্ডির ১৫/এ পথ খুব দূরের নয়, তবে যানজটে আটকে গেলে আর রক্ষে নেই। যানের জট সামলে তবে প্রাণে লেপ্টে থাকা গুমোট ভাবটা সঙ্গে করেই পাঁচতলায় উঠলেন আশরাফ। স্থাপত্যবিদ্যা চর্চাকারী প্রতিষ্ঠানটির নাম 'ফ্রেমওয়ার্ক'। সহ-ব্যবসায়ী এক ছোট ভাই প্রতিষ্ঠানটির নাম বলে দিয়েছিল। ভিতরে ঢুকে আশরাফ দেখেন একঝাঁক তরুণ ছেলেমেয়ে। হিমুন আর অনুপ নামের যে দুজন এর কর্তা– তাদের বয়সও বেশি নয়।
আশরাফ একটু হোঁচট খেলেন। তার ভাবনা ছিল, বাড়ির মতো বড় কিছু যারা বানাবে– তাদের ছোট হওয়া চলবে না। তিনি ইন্টারভিউ নেওয়ার মুড খুঁজে নিলেন। কিন্তু রথ যে উল্টোপথে চলতে লাগল। হিমুন আর অনুপই তার ইন্টারভিউ নিতে থাকল– আপনি বাড়ি তৈরির সব নিয়ম মানবেন তো? আমরা কিন্তু নিজেদের পছন্দমতো নকশা করব, আপনি আপত্তি জানাতে পারবেন– তবে খবরদারি করতে পারবেন না। আমরা আপনাদের বাড়ি যাব, সেখানে দুবেলা খাব। আপনার ছেলের সঙ্গে গল্প করব আর ভাবির বাসনকোসন দেখব। এসবে যদি রাজি থাকেন– তবে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।
আশরাফ দেখলেন, এ তো ভারী মজা। এমনটি তার ভাবনাতেও ছিল না। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে 'দেখাই যাক না কী হয়'- ভাব নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। বিনিকে বিস্তারিত বললেন। বিনিও সহজভাবেই নিলেন ব্যাপারটি। সে মতোন হিমুন আর অনুপ এলেন আশরাফ-বিনির সংসার দেখতে।
২০১৮ সালে ওদের ছেলে জায়েদ তখন খুব ছোট। চুপচাপ ছেলেটা মনমরা। হিমুন ঠিক করে ফেললেন, এ ছেলেটার জন্য সে এমন একটা বাড়ির নকশা করবে– যাতে তার মন ভালো থাকে সারাদিন। আসলে তো এই শহরের ফ্ল্যাট বাড়ির সব শিশুই বন্দি; শিশুদের তো এতে দোষ নেই, বড়দেরকেই সমাধানের দায়িত্ব নিতে হবে।
'ভিটামিন ডি সংকট ঘুচল'
দুদিন পরে নতুন বৈঠকের দিন ঠিক করে, হিমুনরা ফিরে এলেন। এর মধ্যে জানা হয়ে গেছে, পরিবারটির কী কী দরকার। বাড়িতে তারা কী কী চায়। সে মতো একটা নকশাও তৈরি হয়ে গেল। আশরাফও মিটিং করে সন্তুষ্ট। ফিরে যাওয়ার সময় হিমুন বিনীত হয়ে বললেন, আর কি পাঁচটা মিনিট সময় আপনার হবে? আমরা আরেকটা নকশা করেছি। সেটাও যদি একনজর দেখে নেন।
আশরাফ সম্মতি দিলে তারা আবার বসলেন। আধঘণ্টা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নতুন নকশা দেখলেন। এটা একেবারেই আলাদা। এতই আলাদা যে– আশরাফ তখুনি কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারলেন না। বললেন, বিনির সঙ্গে একবার কথা বলে নিয়ে জানাই। তিন-চার দিন পর আশরাফ এসে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে গেলেন, তারা নতুন নকশাতেই বাড়ি গড়বেন।
এবার হিমুনরা ভাবনায় পড়ে গেলেন। কারণ এর চ্যালেঞ্জ নানামুখী। বাড়িটা এখনকার সাধারণ বাক্সবাড়ির মতো হবে না; এর তিন তলায় উঠান থাকবে, পাঁচ বা ছয় তলা থেকে তিনতলাও দেখা যাবে, এর দক্ষিণ-দিকটা হবে খোলা, দরজা-জানালা থাকবে মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত পুরোটা জুড়ে।
তাপ কমানোর জন্য পশ্চিম দিকের মেটেরিয়াল হবে আলাদা। মেঘনা ব্রিজ গড়তে এসেছিল যে জাপানিরা তাদের অ্যাকোমোডেশন হাউজ তৈরি করতে গিয়েও হিমুনদের গরম, ধুলা আর নয়েজের সঙ্গে লড়তে হয়েছিল। জায়গাটা ছিল হাইওয়ের ধারে। তাই থাকার জায়গার ধারের দেয়ালটিতে ইটের জালি তৈরি করতে হয়েছিল— যেটি একইসঙ্গে শব্দ, ধুলা আর গরম হ্রাস করেছিল। হাউজ প্রাঙ্গনে তারা জেন গার্ডেন তৈরি করেন; আর হাউজের ভিতরে শরীর ঠান্ডা করার জন্য পুকুর বানিয়ে দেন।
হিমুনরা অবশ্য ভাবনায় পড়লেও পিছপা হলেন না। প্রথম তিনতলা উঠে গেল সহজেই, পরের তলায় উঠান গড়া হলো– এক হাঁটু সমান মাটি এনে পুরু করে লেপে দেওয়া হলো। মাঝখানে একটি নিমগাছ লাগিয়ে পাঁচতলার ঘরটি দেওয়া হলো জায়েদকে। মাস্টার কিচেন আর লাগোয়া ডাইনিংটিও হলো চারতলাতেই। নিমগাছের ধারে বসার একটি জায়গা করা হলো– যেন বাতাস খেতে খেতে চাঁদের আলো গায়ে মেখে নেওয়া যায়। নিমগাছের তলার মাটিতে ঘাস লাগানো হলো, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই জায়গাটি সবুজে ভরে গেল।
ডাইনিংঘরে মেঝে থেকে ছাদ বরাবর ফোল্ডিং জানালা দেওয়া হয়েছে, গুটিয়ে নিলেই বাড়ির এমাথা-ওমাথা একাকার হয়ে যায়। জায়েদ এখন সারাবাড়ি দৌড়ে বেড়ায়, আর ছয়তলার ছাদে বৃষ্টিতেও ভেজে। রোদে পুড়তেও খারাপ লাগে না তার। তাইতো বিনি নিশ্চিন্ত, ছেলেটার ভিটামিন ডি সংকট ঘুচবে এবার। নতুন বাড়িতে বিনির সবচেয়ে ভালো লাগে– ভোরবেলাটা আর পূর্নিমার মধ্যরাত। সত্যি শুয়ে চাঁদ দেখার স্বপ্ন তার পূরণ হয়েছে। সবাই মিলে বাড়িটার নাম রাখল, মেঘমল্লার।
হিমুন বলছিলেন, 'আশরাফ ভাই আর ভাবীর সঙ্গে যদি আমাদের বন্ধুত্ব (আত্মীয়তাই বলা ভালো) না গড়ে উঠত– তবে এ বাড়ি এমন হতো না। তাঁদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল– প্রয়োজনে আর সেটা যদি সেখানেই থেমে থাকত, তবে বাড়িটা হতো ঠিকই যেমন আর দশটা ফ্ল্যাটবাড়ি হয়। সম্পর্কটা বন্ধুত্বে গড়িয়েছে বলেই– এটা একটা আনন্দবাড়ি হয়ে উঠেছে। আমরা যার নকশা করি– হোক সেটা বাজার, পুলিশ ফাঁড়ি কিংবা মন্দির– তার সঙ্গেই মায়ার বন্ধনে জড়াতে চাই। চাই বসবাসের বা জিরানোর একটা ভালো জায়গা হোক মানুষের'।
হিমুন যেভাবে বেড়ে উঠলেন
অনুপ বসাক আর ফয়সাল কবীর হিমুন ২৬ বছর ধরে একসঙ্গে আছেন। বুয়েটে স্থাপত্য বিষয়ে পড়ার সময় তারা রুমমেট ছিলেন। একসঙ্গে স্থপতি কাশেফ মাহবুবের আরবানায় (স্থাপনা নির্মাণ বিষয়ে উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান) শিক্ষানবীশী করেছেন। ২০০৭ সালে হিমুন প্রতিষ্ঠা করেন ৩৭ ব্রিজ। তারপর ২০১৬ সাল থেকে বন্ধু অনুপ কুমার বসাকের সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ফ্রেমওয়ার্ক। অনুপের বাড়ি টাঙ্গাইলে আর হিমুনের বাড়ি মাগুরায়। হিমুন মা হারিয়েছেন ৫ বছর বয়সে। বড় ভাই ছিলেন তার ছায়া হয়ে। ভাইটি যখন ক্যাডেট কলেজে চলে গেল তখন হিমুন গেলেন একা হয়ে। কবিতা লিখে আর সাইকেলে পাড়া বেড়িয়ে দিন কাটতো তার। তারপর নটরডেম কলেজে ভর্তি হয়ে ঢাকায় আসেন। সেখান থেকে বুয়েটে স্থাপত্য বিষয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে যান।
অংকে মাথা তাঁর ভালো ছিল, তবে থিওরি ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতেন বেশিরভাগ দিন। শামসুল ওয়ারেসকে স্যার পেয়ে হিমুনের চোখ খুলে গিয়েছিল। আগ্রহী শিক্ষার্থীর ভিতরে স্যার আলো জ্বেলে দিতে পারেন। হিমুন থার্ড ইয়ারে পড়ার সময়ই বুঝে যান– বাড়ি বানানো আসলে কবিতা লেখার মতো ব্যাপার। ভাব-অনুভব, ছন্দ-সুবাস, স্মৃতি-বিস্মৃতি, হতাশা-আশা নিয়ে যেমন কবিতা তৈরি হয়– বাড়িতেও তেমন তেমন সব থাকে, বাড়তি থাকে ইট-কাঠ-লোহা-জানালা, পাইপ-দরজা, ছাদ, মেঝে, আয়না এবং বাড়িওয়াওলার বহুমাত্রিক বিচিত্র সব বায়না।
শেষ অংশ মানে– ফাংশনালিটি বা কার্যকরিতা ছাড়া তো স্থাপনা গড়ার প্রশ্ন আসে না। প্রথমে ভবনটিকে বাস উপযোগী করে তুলতে হবে, তারপরই আসে কবিতারা ভিড় করে। হিমুনের কাছে কেমন করে যেন কবিতাগুলোই আগে চলে আসে। বলেন, 'স্থাপনা এমন হবে যেটায় বাতাসেরা লুকোচুরি খেলতে পছন্দ করবে, হেসে উঠতে চাইলে সূর্যের প্রথমে এ বাড়িটার কথাই মনে পড়বে; নিজের ঘুমবাড়ি হিসাবে আকাশ ভাববে এর কথাই। সবমিলিয়ে জায়গাটা হয়ে উঠবে এক আনন্দবাড়ি।'
হিমুনের অফিসে বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুই আই কান, মেক্সিকান মাস্টার স্থপতি লুই বারাগান যেমন আছেন– তেমনি আমাদের দেশের স্বনামধন্য স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, শামসুল ওয়ারেসও আছেন, মানে তাঁদের ছবি আছে। আছেন হিমুনের শিক্ষাগুরু কাশেফ মাহবুবও। হিমুন আর অনুপ বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে থাকতেই নড়াইলের লোহাগড়ায় একটি বাড়ির নকশা করে ফেলেছিলেন। শেষ বর্ষে ওঠার পর কাশেফ মাহবুবের শিষ্যত্ব নেওয়ার আগ্রহ হিমুনের হয়েছিল। 'তিনি (কাশেফ মাহবুব) যেকোনো স্থাপনা– হোক তা বাড়ি বা ট্রেনিং সেন্টার বা ফ্যাক্টরি বা হাসপাতাল– নকশা করতে গিয়ে আসলে কবিতাই লিখে ফেলেন। আর এতোটা নিখুঁত হতে চেষ্টা করেন, যে একই নকশা শতবারও আঁকেন অথবা একই কবিতা লিখে চলেন বার বার'- বলছিলেন হিমুন।
শেষ পরীক্ষার ফলও বের হয়নি হিমুন বিয়ে সেরে ফেলেছেন। মিরপুরে এক বাড়িতে সাবলেট থাকেন। বড়ই টানাটানির সংসার। কাশেফ মাহবুবের অফিসে গেলেন তাঁর শিষ্যত্ব পাওয়ার আশায়। সঙ্গে নিয়েছেন, লোহাগড়ার বাড়ির কয়েকটি ফটোগ্রাফ। ছবিগুলো দেখে কাশেফ মাহবুবের মুখে স্বস্তির চিহ্ন ফুটল। তিনি প্রথম প্রশ্নই করলেন, কবে থেকে যোগ দিতে পারবে? প্রশ্ন শুনে হিমুনের মুখে রা নেই। এতটা আশা তাঁর ছিল না। পারলে তো আজই সে যোগ দেয়। দিনকয় সময় চেয়ে ফিরল হিমুন। অফিসে যোগ দিতে যাওয়ার আগেই সে ঠিক করেছিল, গুরুমুখী বিদ্যাপদ্ধতি অনুসরণ করবে। যতটা পারা যায় শিখবে কাশেফ ভাইয়ের কাছ থেকে, গুরুর ভাবনা এবং দুর্ভাবনা কোনো কিছুই বাদ রাখবে না– আয়ত্ত্ব করতে।
চার বছর ছিলেন আরবানায়। তারপর নিজে নিজে কাজ করা শুরু করলেন। কিন্তু কাজ পাবেন কীভাবে? কারুর কাছে যেয়ে কাজ চাইতে তার মুখ ফোটে না। তিনি বিভিন্ন কম্পিটিশনে অংশ নিতে থাকলেন। রাতের পর রাত জাগার সেই শুরু। কম্পিটিশনে অংশ নেন আর তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। অথচ প্রথম না হতে পারলে তো নকশা বাস্তবায়িত হবে না। তৃতীয় হলে প্রশংসা পাওয়া যায় বটে, কিন্তু রুটিরুজির প্রশ্নের উত্তর মেলে না। তবু থেমে যান না হিমুন।
বলছিলেন তিনি, আমার ভূমিষ্ঠ না হওয়া ৬৮টি সন্তানের (স্থাপত্য প্রকল্প) শোক আমি ভুলতে পারি না। 'একটা প্রকল্প তো স্রেফ অর্থের কারণেই অসমাপ্ত থেকে গেছে। সেটি হিমুনের নিজের গ্রামের মুক্ত ভাইয়ের বাড়ি। একজন সৎ পরিশ্রমী শিক্ষক মুক্ত ভাই। বাড়িটি অনেকটাই গুছিয়ে এনেছিলেন, আর কিছু অর্থ সংস্থান করা গেলেই স্বপ্ন সার্থক হতো– কিন্তু শেষাবধি আর হয়নি।
একটা ভালো স্থাপনা নকশা করা মানে মানুষকে একটু সেবা দেওয়া- হিমুনের কাছে ব্যাপারটি এমনই। বুয়েটে পড়াকালীন সময়ে রাষ্ট্র তার জন্য সাড়ে ২২ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। পড়া শেষ করার পর তাই হিমুন ভেবেছে এ দায় শোধ করবে। হিমুনের অফিসের দেয়ালে দেয়ালে তাই ছাপা অক্ষরে লেখা আছে,
সেবা দেব, আনন্দ পাব
বিশ্ব মাঝে প্রথম হবো।
হিমুন কাজ করেন পার্টিসিপেটরি মেথডে। হিমুন আর অনুপের সঙ্গী আছেন– স্থপতি সুরাইয়া জাবিন রুমকি, স্থপতি মোহাম্মদ মাসুদ, স্থপতি সুমাইয়া সারওয়াত প্রমুখ। মানুষ-প্রকৃতি-পরিবেশের বন্ধু হয় তারা প্রথমে তারপর নকশায় হাত দেয়। এর বড় নমুনা চট্টগ্রামের গোলপাহাড়ের কালীবাড়ি। মন্দিরের কমিটি চাইল, নতুন করে এর নকশা করা হবে। একটা প্রতিযোগিতা ঘোষণা করলেন তারা। সেসঙ্গে বললেন, কী কী বিষয় নকশায় অবশ্যই থাকতে হবে, তার একটি যেমন ১,৫০০ জনের একসঙ্গে বসে ভোজন সারার জায়গা। ওয়ারেস স্যার, উত্তম সাহা প্রমুখ নামী স্থপতিদের বিচারক করা হলো। এ বছরেরই ঘটনা এটা।
ঘুরতে বের হলেন হিমুনরা
সুলতানী থেকে মুঘল আমল তারপর ব্রিটিশ আমলের যত মসজিদ আর মন্দির– দুই সপ্তাহে দেখা সম্ভব। আর সবই দেখব বলে বের হলেন- অনুপ আর হিমুন। পদ্মার ওপাড়েই ফরিদপুর, তারপর আছে বাগেরহাট, যশোর, নড়াইল তারপর উত্তরে গিয়ে পুটিয়া রাজবাড়ি, আতিয়া মসজিদ, দারাশবারি মসজিদ ও মাদ্রাসা দেখেছিলেন সেবার। চেয়েছিলেন স্থাপনাগুলোর ওজন, সুবাস, পরিপার্শ্বের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে।
৪০০-৫০০ বছর ধরে জনপদে এগুলো উপস্থিত এবং জীবনের সঙ্গে নিবিড়। তারা প্রার্থনাগৃহগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য খেয়াল করলেন– আর তা হলো এগুলো 'ওয়েলকামিং'। সবার জন্যই এগুলোর দ্বার অবারিত। ফিরে এসে তাই গেটের নকশাই করলেন প্রথম, সেটা আসলে বড় একটা ভারি মোটা দেয়াল। দেয়ালের নীচের ভাগে রাখা হলো ঢোকার পথ আর ওপরে তিনটি গর্ভগৃহ। কালীবাড়ির প্রধান কাজটিই শেষ হলো– এর মধ্য দিয়ে। যেহেতু জায়গা ১০ কাঠারও কম– তাই এটাই ছিল সর্বোত্তম পন্থা। তারপর দেয়াল পেরিয়ে নাটমন্দির, ভোজনালয়, রান্নাঘর, লাইব্রেরি এবং শ্মশান (দাহ করার নয়, কবরস্থ করার)।
মন্দির নকশা প্রতিযোগিতা এর আগে আসলে দেশে হয়নি। এটি তাই বেশ আগ্রহউদ্দীপক ছিল। হিমুনদের মানে– ফ্রেমওয়ার্কের নকশা দেখে বিচারকরা চমকে উঠেছিলেন। কারণ অল্প জায়গায় এতো কিছুর সম্মিলন ঘটাতে গিয়ে যে জটলা তৈরি হবে, নিশ্চিত ছিল সবাই। তাই ফ্রেমওয়ার্কের ব্যতিক্রমী উপস্থাপনায় চমকে গিয়েছিলেন বিচারকরা। মন্দির কমিটি যা যা চাইছিলেন, অন্য প্রতিযোগীদের মাথায় সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার ভাবনাই আসেনি। হিমুনরাও চ্যালেঞ্জ করেননি, কেবল ধারাবাহিকতা বদলে দিয়েছেন মানে কনভেনশনাল মন্দির ধরণে নতুন ব্যাকরণযুক্ত করেছেন'।
এমন ঘটনা ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ মিনার করতে গিয়েও ঘটেছিল। তখন ব্যাপারটি বলা ভালো জটিল হয়ে উঠেছিল। অনেকে প্রশ্ন তুলেছিল, জাতীয় কোনো প্রতীককে রি-অ্যারেঞ্জ করা আদবের খেলাফ কি -না! লাল রঙের একটা উচু বাঁকা দেয়ালের মাঝে মাঝে ফাঁকা জায়গা তৈরি করে মিনারটি গড়ে তোলা হয়েছে। স্থপতিরা মানে অনুপ আর হিমুন ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, এখানকার স্থান-স্বল্পতা নতুনভাবে ভাবতে সাহায্য করেছিল আমাদের। শহীদ মিনারের যে ওয়ান পয়েন্ট পার্সপেক্টিভ (কেবল সামনে দেখলেই দৃশ্যটা পাওয়া যায়) তা তৈরির করার মতো দূরত্ব এখানে নেই। তাই বক্র দেয়াল তৈরি করতে হয়েছে– যার চারপাশ থেকে সময়ভেদে সূর্যের নানা আলো পড়ে। তৈরি হয় অনেকগুলো প্রেক্ষাপট। এর মধ্য দিয়ে পুরো প্রাঙ্গনটাই অর্থবহ হয়েছে'।
সিরাজগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের শহীদ মিনার গড়ার কথাও প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে এলো। নির্ধারিত জায়গার পিছনে পুকুর ছিল। হিমুনরা চাইলেন, যেন সেটিকেও ব্যবহার করা যায়। মিনারের প্রতিবিম্ব যেন পড়ে পানিতে আর ঢেউয়ের দোলায় আন্দোলনের স্মৃতি ছড়িয়ে যায় শেষ অবধি। স্থানীয় যুবকরা হিমুনদের কন্ট্রাক্টর ভেবে চাঁদা চাইতে এসেছিল, হিমুনরা দিতে রাজি না হওয়ায়– শেষে বাঁশের আঘাত সইতে হয়েছিল।
ফ্রেমওয়ার্ক একটি বাজারের নকশা করেছিল। সেটি মৃতপ্রায় একটি খালের ধারে, ছোট্ট জায়গাজুড়ে। বুড়িগঙ্গার ওপাড়ে কালিগঞ্জ বাজার। প্রচুর মাছ বিকিকিনি হয় এখানে। হিমুনদের ভাবতে হলো, ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগমের কথা, মাছ লোড-আনলোড করার কথা, পানি নিস্কাশন ব্যবস্থার কথা। জায়গাটি প্রায় সময়ই অন্ধকারাচ্ছন্ন আর স্যাঁতস্যাঁতে থাকে– সেটাও দূর করার কথা মাথায় রাখল নকশা করতে গিয়ে। নকশা শেষ হয়েছে, তবে কাজ এখনো শুরু করেননি কর্তৃপক্ষ। এটা হয়ে গেলে বেশ একটা শেখা হবে। এখানকার সীমাবদ্ধতা দূর করে আরো বাজার নকশা করা যাবে।
একটা বাগানবাড়ি
শহরের ব্যস্ত মানুষের মাঝে মধ্যে হাঁফ ধরে যায়। গ্রামীণ পরিবেশে একটা বাড়ি তৈরির ইচ্ছা থাকে অনেকের। কিন্তু তেমন সৌখিন বাড়ির বড় অসুবিধা হলো সিকিউরিটি বা নিরাপত্তা।
ভালুকায় হিমুনরা যে বাগানবাড়িটির নকশায় হাত দিলেন– তার জায়গাটা গ্রামের একধারে। পানির মধ্যে একটা দ্বীপের মতো। ক্লায়েন্ট চাইলেন, বাড়িটি রাজকীয় ভাবের কনটেমপরারি (সমসাময়িক) সুবিধাসম্পন্ন হবে। ভিতরবাড়িতেও একটা সুইমিং পুল থাকবে– যেখান থেকে বাইরের জলাশয় দেখা যাবে। শেষে দুর্গের মতো একটা বাড়ির নকশা করেছেন হিমুনরা; যার প্রাচীর আছে কিন্তু প্রকৃতিকে বিচ্ছিন্ন করেনি।
বিপরীত অভিজ্ঞতা সামলাতে হলো– আবার ঢাকার মহাখালীতে একটি অফিস গড়তে যেয়ে। সেখানে জায়গাটা হাইওয়ের কাছে, রেললাইনও বেশি দূরে নয়– তার ওপর পশ্চিমমুখী। বক্রতা আর জালি পদ্ধতিকে বেছে নেন হিমুনরা। ভবনের গা বাঁকা হওয়ায় আলো পিছলে চলে যায় এবং জালির মতো ইট জুরে দেওয়ার কারণে শব্দও আধা ঢোকার অনুমতি পায়– আর আধা বাইরেই বসে থাকে। হিমুনরা ৩৫ তলা উঁচু এক ভবনের নকশাও করেছেন, যার ৬ তলা মাটির নীচে। এটি একটি পাওয়ার স্টেশন বলে কারিগরি ব্যাপারে নজর রাখতে হয়েছে অনেক বেশি।
এবং একটা থানা
থানাগুলোর ওপরতলায় সাধারণত পুলিশদের থাকার জায়গা রাখা হয়; আর সামনে জব্দ করা গাড়ির ভিড় দেখা যায়। দুয়েই আপত্তি হিমুনদের। সারাদিন ডিউটি সেরে উপযুক্ত একটা বিশ্রামের জায়গা দরকার যে কারুর। পুলিশ তার ব্যতিক্রম হবে কেন?
আর থানার সামনে জঞ্জাল থাকলে সেবা দাতা বা সেবা নিতে আসা কারুরই আনন্দ লাগার কথা নয়। তাই দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার নকশায় হিমুনরা গাড়ির স্তুপ রাখার জায়গা করল পেছন দিকে, আর থানা থেকে কিছু দূরে একটু নিরালায় ফাঁড়ি বা পুলিশের থাকার জায়গা করলেন।
হিমুন আর অনুপের কাছে ভবন কেবল প্রয়োজন পূরণের জায়গা নয়। এর সঙ্গে বড় হওয়ার, বেড়ে ওঠার, শান্তি পাওয়ার আছে নিবিড় যোগ। তাই একটি স্থাপনা মানে– একটি কবিতা যা জীবনে ছন্দ আনে, আর স্বাচ্ছন্দ্যও।