টুনটুনি বয়ফ্রেন্ড, ড্রাইভ স্লো, চাবি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না: মোটর বাইকের বাংলা স্টিকার
'কমবেশি আড়াইশো বাইকার গ্রুপ আছে দেশে, সার্ভিস সেন্টার আছে শয়ের বেশি, শুধু হেলমেট বিক্রি করে এমন কোম্পানিও আছে। কোনো কোনো টায়ার কোম্পানি উপহার হিসেবেও স্টিকার দেয় বাইকারদের। সওয়ারি নামের এক প্রতিষ্ঠান আছে যারা স্টিকার লাগানো চাবির রিং বানায়। এই সব মিলিয়ে বাইকের স্টিকার বাজারটি একেবারে ছোট নয়। তবে এ বাজার তৈরি হয়েছে বছর ৫-৬ হলো। আগে বংশালে যেখানে ৫০টি দোকান ছিল এখন তা ৫০০ হয়ে গেছে। শত কোটি টাকার ব্যবসা এখানে। আর দিন দিনই বাজারটি বড় হচ্ছে। যুবকরাই মূলত এ ব্যবসায় জড়িত। সংলাপ বানানো, ডিজাইন করা, ছাপানো, কাটা, জোড়া দেওয়া ইত্যাদি সব কাজই আমাদের দেশে হচ্ছে এখন। আগে তো স্টিকার আসতো বিদেশ থেকে। এখন বাংলা স্টিকারও দেখবেন কিছু কিছু,' নীলক্ষেতের টিএস বাইক স্টিকার নামের প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী তানভীর আহমেদ শুভ জানালেন খবরগুলো।
শুভ এমবিএ শেষ করেছেন, চাকরি করার ইচ্ছা তার ছিল না। প্রিন্টিং ব্যবসা তাদের দাদার আমল থেকে। পড়াশোনা শেষে ভাবলেন নিজেদের ব্যবসাটাকেই এগিয়ে নেবেন। চার বছর আগে যখন ব্যবসায় নামলেন তখন কিছু ব্যানার আর স্টিকার রোল আনিয়েছিলেন চীন থেকে। সেগুলো ভালো করে খেয়াল করে বুঝলেন স্টিকার নকশা করার কাজটি নিজেই পারবেন। গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ তার আগে থেকেই জানা ছিল। প্রথম কয়েকটি নকশা নিজের ফেসবুক পাতায় আপলোড দিলেন। অবাক করার মতো ব্যাপার, ঘণ্টাকয়েকের মধ্যেই ৪০টি অর্ডার (ফরমায়েশ) পেয়ে গিয়েছিলেন।
সব এখন দেশি
মোটরসাইকেলে স্টিকার লাগানোকে 'মডিফাই' করা বলে। হেলমেট, বনেট, বাম্পার, ট্যাংকার সব জায়গাতেই স্টিকার বসানো যায়। ইদানিংকালে এ হার বেড়েছে অনেক। এক বা দেড় লাখ টাকা দাম হয় এমন মোটরসাইকেল মালিকরা সাধারণত স্টিকার লাগান না। তবে আড়াই-তিনলাখ টাকার যেসব বাইক বাজারে পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর মালিকদের সৌখিন বলা চলে। তারা বাইককে রত্নের মতো যত্ন করেন। পারলে পুরো বাইক মডিফাই করেন। শুভ বলেন, 'পুরো বাইক মডিফাই করার মতো প্রযুক্তি এখনো আমরা আয়ত্ত্ব করতে পারিনি তবে বাদবাকি কোনো কিছুর জন্যই বিদেশের দ্বারস্থ হওয়ার দরকার আমাদের পড়ছে না'।
এখন বছর বছরই স্টিকার ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বাড়ছে। গত বছর শুভ ২০ লাখ টাকার বেশি ব্যবসা করেছেন, আর এ বছরের আট মাসেই সেটা ছাড়িয়ে গেছে। অথচ ২০২০ সালে ১৫ লাখের বেশি ব্যবসা হয়নি। সাধারণত স্টিকারের নতুন নকশা তৈরি হলে ফেসবুকে আপ করেন শুভ। তাতে কাস্টমারদের আগ্রহের পরিমাণ বোঝা সহজ হয়। যেমন 'আমার মন ভালো নেই' লেখা স্টিকারের নকশা যখন প্রকাশ করলেন প্রথম দিনেই দেড়শটি অর্ডার পেয়ে গিয়েছিলেন। পরের দিন আরো ২০০টি ছাপাতে হয়েছিল।
বাংলা স্টিকারের চাহিদা বাড়ছে
শুভ জানালেন, বাংলা স্টিকার মানে যেসব স্টিকারে বাংলা বাক্য থাকে সেগুলোর চল শুরু হয়েছে দেড় বা দুই বছর। সাধারণত ট্রেন্ড (সময়ের প্রবণতা) ধরে এসব বাক্য তৈরি হয় আর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছবি যোগ করা হয়। আগে স্টিকারে ইংরেজি বাক্য বা ছবি থাকত বেশি।
কেন বাংলা স্টিকারের চাহিদা তৈরি হচ্ছে? এমন প্রশ্নের সুন্দর উত্তর দিলেন খিলগাঁওয়ের 'স্টিকার' নামের প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আফফান হোসেন আনজুম। বললেন, 'বাংলাকে আমার সবাই ভালোবাসি আর এর মাধ্যমে যোগাযোগ তৈরিও সহজ হয়।'
আনজুম প্রথম যে বাংলা স্টিকারের নকশা করেছেন তাতে লেখা, 'আম্মু বলেছে ড্রাইভ স্লো'। এ নিয়ে তার ব্যাখ্যা হলো, 'বাইক চালাতে যাওয়ার আগেই আম্মুরা বলে থাকেন সাবধানে চালাইও বাপু, বেশি স্পিড তুলিও না, দেখে শুনে চালাইও, আস্তে আস্তে যাইও। সাধারণত আম্মুদের শঙ্কার কথা খেয়াল রেখেই এমন স্টিকার তৈরি হয়েছে। আবার উল্টো স্টিকারও আছে- 'আব্বা বলছে উড়ায়া দাও'।'
'গরীব বাইকার' নামের সাম্প্রতিককালের আরেকটি স্টিকার নিয়ে আনজুম বলছিলেন, 'বাইকাররা ইদানিং দুষ্টুমি করে বলছেন, গাড়িতে তেল ভরার টাকা নাইরে দোস্ত অথবা গার্লফ্রেন্ডকে বলে ঘোরাঘুরি করাতে পারবো, খাওয়াতে পারবো না। তাদের এসব কথাবার্তা মনে রেখেই স্টিকারটি তৈরি করা হয়েছে।'
কিছু স্টিকার আছে যেগুলো নারীদের উদ্দেশ্য করে বা বার্তা দিয়ে লেখা হচ্ছে যেমন নজর সামলাও আপু, আপু চোখ নামাও বা দামি বাইকে মাইয়া পটে ইত্যাদি। এমন বাক্য দিয়ে কি বোঝাতে চায় স্টিকার লাভাররা? জানতে চাইলে উত্তরে শুভ বললেন, 'এগুলো কাস্টোমারের টেস্ট বা রুচিমতো তৈরি করতে হয়। ব্যবসায়ী বলে ভালো-খারাপ বিচার করার সুযোগ আমাদের সবসময় হয় না। তবে সবাই কিন্তু এই রকম স্টিকার চায় না, একধরনের বাইকার এসব দিয়ে হয়তো ইন্ডিরেক্টলি (পরোক্ষভাবে) কিছু বোঝাতে চায়।'
স্টিকার মার্কেট বড় হচ্ছে
স্টিকার ব্যবহারের প্রধান উদ্দেশ্য হলো বাইকটিকে সাজানো। যার যেমন রুচি সে তেমন সাজায়। আনজুম নিজেও বাইক চালান। অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন বলে 'প্রকৃতির মধ্যে বাইক' এমন একটি স্টিকার তিনি ব্যবহার করেন। তার প্রকাশিত স্টিকারগুলোর মধ্যে স্পোর্টস স্টিকারও আছে। আছে ইসলামিক স্টিকার। এগুলো আরবী, ইংরেজী বা বাংলায় লেখা হয়। এমন স্টিকারের বাজার বেশ বড়। সাধারণত সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভরসা রাখা বা তার প্রশংসা করা বিষয়ক শব্দ থাকে ইসলামিক স্টিকারগুলোতে।
আনজুম বলছেন, 'আমাদের তৈরি স্টিকার কলকাতার স্টান্ট বাইকাররাও ব্যবহার করে। দেশি বা বিদেশি স্টান্টরা ভক্তদের নিজের নাম লেখা বা নিজের পরিচয়জ্ঞাপক লোগোটি শত শত ছাপিয়ে বিলি করে থাকে।'
তিনি জানালেন, প্রায় ১০০ জন স্টিকার পাইকার আছে দেশে। ঢাকায় বংশাল, মিরপুরে আছে বড় স্টিকার মার্কেট। চট্টগ্রামেও আছে, আছে জেলায় জেলায়। সারা দেশে যত স্টিকার ব্যবহৃত হয় তার প্রায় সবই দেশে তৈরি হয় এখন। কেবল স্টিকার পেপারটি বিদেশ থেকে আসে।
'এখন আমাদের এখানে তৈরি হওয়া স্টিকারগুলোর মধ্যে ৬০ ভাগ ইসলামিক স্টিকার, বাংলা স্টিকার ১৫-২০ ভাগ আর ইংরেজি ১০-১৫ ভাগ। কিছু স্টিকার তৈরি হয় কাস্টমারের পছন্দের ব্যক্তিত্বের ছবি দিয়ে যেমন চে গুয়েভারা। কাস্টোমাইজড স্টিকারের জন্য বাইকাররা আগে থেকেই আমাদের ফেসবুক পেইজে কন্টেন্ট, সাইজ ইত্যাদি পোস্ট করে রাখেন,' বলেন তিনি।
'আরেকটি ব্যাপার হলো বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যেও যায় আমাদের স্টিকার। ওসব দেশে আমাদের দেশি লোক আছে অনেক, তারা ফেসবুকে দেখে ফরমায়েশ দেয় বা কেউ এলে তাকে নিয়ে যেতে বলে। সারা সপ্তাহ ধরে আমরা অর্ডার নিই আর সপ্তাহের নির্দিষ্ট কুরিয়ার মারফত ডেলিভারি দেই। গেল সপ্তাহে আড়াই হাজার স্টিকার ডেলিভারি দিয়েছি।'
আনজুম জানালেন, ৫০ টাকা থেকে স্টিকারের দাম শুরু হয়, হাজার টাকার স্টিকারও আছে। স্টিকার পেপারও আছে বিভিন্ন দামের। স্টিকার বাজারে ছাড়ার আগে তা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়। দিনের পর দিন রোদে ফেলে রাখা হয়, খেয়াল করা হয় যে রোদে জ্বলে যায় কি না, আবার স্যাঁতস্যাঁতে জায়গাতেও ফেলে রাখা হয় স্টিকার।
সোশ্যাল ইস্যুতে কোনো স্টিকার?
আনজুম জানিয়েছেন, যুবকরাই বেশি বাংলা স্টিকার পছন্দ করে। আর মেটালিকা (মনস্টার, আর্তনাদ, লুসিফার) ধাঁচের স্টিকার পছন্দ করে চল্লিশোর্ধ্বরা। যারা এক সময় মেটাল বা হার্ড রক পছন্দ করত বা এখনো শোনে তারাই মেটালিকা স্টিকার বেশি ব্যবহার করে।
আনজুমের কাছেই জানতে চেয়েছিলাম, এখন তো অনেক নারী বাইকার আছেন। তাদের কথা ভেবে কি কোনো স্টিকার প্রকাশ করেছেন? অথবা কোনো সোশ্যাল ইস্যুতে যেমন দুর্নীতি থামাও কিংবা অযথা হর্ন বাজাবেন না ধরনের স্টিকার প্রকাশ করেছেন?
তিনি বললেন, 'না এমন স্টিকার এখনো প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি। আগামী দিনে হয়তোবা এমন স্টিকারের চাহিদা বাড়বে। যেমন নেচার বিষয়ক স্টিকারও ছিল না মার্কেটে, এখন ভ্রমণকারী বাড়ছে, তাই তেমন স্টিকারও তৈরি হচ্ছে।'
আনজুম পড়াশোনা করেছেন অর্থনীতি বিষয়ে। বয়স তার এখন পঁচিশ। পছন্দ করেই এ পেশা তিনি বেছে নিয়েছেন। ছোটবেলায় তার স্টিকার সংগ্রহের শখ ছিল। একটা মোটা খাতা ছিল যা কেবল স্টিকারেই পূর্ণ ছিল। তাই স্টিকার তৈরিকে পেশা হিসাবে বেছে নিতে তার দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। তিনিই এখন পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী।
বাইক লইয়া পিরিতি নাই
বংশালের শেষ মাথায় মাহুতটুলি যেখানে শুরু হয় সেখানে স্টিকারের টং দোকান কিছুদূর পর পর। শরীফুল আলম সবুজের দেখা পেয়েছিলাম তেমন একটা টং দোকানে। সে নিজে কিছু বাংলা স্টিকার নকশা করেছে। একটা যেমন 'ভয় পাইছি'। ন্যাড়া মাথার পেট মোটা এক লোক চেঁচিয়ে বলছে কথাটি। লোকটিকে নরওয়েজিয়ান শিল্পী এডভার্ড মুংকের দ্য স্ক্রিম ছবির চরিত্রটির মতো দেখালো। সবুজকে এ কথা মনে করিয়ে দিলে, সে বলল, 'এটা ইমোজি। নেট ঘাটতে ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়েছি।'
আবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনি আইডিয়া কিভাবে পান?
সবুজ বললেন, 'বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে আইডিয়া পাই। কোনো কোনো সময় হঠাৎই আইডিয়া চলে আসে'।
সবুজের দোকানে বাংলা স্টিকারই বেশি। তার মধ্যে কয়েকটি এমন- টুনটুনি বয়ফ্রেন্ড, লাল গাড়ির টান বেশি, বাইক লইয়া পিরিতি নাই, আবে হালা সাইড দে, চাবি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না।
সবুজ বলল, 'বাইক দেখলেই ফ্রেন্ডরা এসে বলে দোস্ত চাবিটা দে একটু চালিয়ে দেখি। এটা সব জায়গাতেই দেখবেন। এখন আপনার তো দিতে ইচ্ছে করে না। তখন গাড়িতে যদি চাবি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না বা বাইক লইয়া পিরিতি নাই স্টিকার লাগানো থাকে তবে আপনি বাঁচবেন। বন্ধুরে সোজা স্টিকার দেখিয়ে দিবেন, ঝামেলা ফ্রি।'
তারপর টুনটুনি বয়ফ্রেন্ডের ব্যাপারটা একটু খোলাসা করতে বললাম সবুজকে। সবুজ বলল, 'কিছু বাইকার দেখবেন শরীরে চামড়া ছাড়া কিছু নেই কিন্তু বাইক চালায় একটা ষাঁড়ের মতো তাগড়া। এইসব বাইকারকে আমরা দুষ্টামি করে বলি টুনটুনি বয়ফ্রেন্ড।'
পড়াশোনায় সবুজের মন বসতো না, পরিবারের লোক তাই বলত, টো টো বাদ দিয়ে কিছু একটা কর। তখন স্টিকার করার ব্যাপারটি তার মনে ধরে। ডিজাইন শিখেছে নিজে নিজে। বয়স তার বাইশ-তেইশ।
বাইকাররা খাওয়াতে পছন্দ করে
স্টিকারের প্রধান দুই পাত্র-পাত্রী হলো লেখা ও ছবি। তবে যারা কপি ডিজাইনার তারা অনেক সময় ছবি আর কথার মিল রাখতে পারে না।
আনজুম বলছেন, 'আমরা কখনো কপি করি না, আমাদেরকে অন্যরা করে। এ ব্যাপারে কপিরাইট বলে কিছু নেই। আমাদের 'সাবধান এই বাইকের মালিক পাগল' এবং 'আইলো আমার পাগলা ঘোড়া' স্টিকার দুটি দারুণ হিট করেছে। সাধারণত বাইকাররা সবাইকে পেছনে ফেলতে চায়। তাই পাগলা ঘোড়া টাইপ স্টিকার অনেকে লাগায় তাড়াতাড়ি সাইড পাওয়ার জন্য। এছাড়া 'বাইকার ভাইদের দিল বড়' স্টিকারটিও জনপ্রিয় হয়েছে কারণ এটা ইউনিক আর কথাটা সত্যিও। বেশিরভাগ বাইকারকে দেখবেন মেহমানদারি পছন্দ করে, অন্যের বিপদ দেখলে এগিয়ে যায়।'
প্রায়শই নতুন মডেলের মোটর সাইকেল বাজারে আনছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। অ্যাপাচি বা জিক্সারের মতো মারকুটে নাম হয় মডেলগুলোর, দেখতেও হয় ড্যাশিং। মডিফাই করে বাইকগুলোকে আরো স্টাইলিশ করে তুলছেন বাইকাররা। একই মডেলের যেহেতু অনেকগুলো কপি বাজারে আসে একসঙ্গে তাই বাইকাররা মডিফাই করে স্বাতন্ত্র্য তৈরি করেন। ফলে স্টিকারের ব্যবসা বড় হচ্ছে, কর্মসংস্থান হচ্ছে অনেকের তবে স্টিকার হোক রুচিশীল ও নান্দনিক- এই প্রত্যাশা শুভ, আনজুম আর সবুজেরও।