‘শাকিবিয়ান’ কারা? তারা কেন শাকিব খানের ভক্ত?
গল্প সিনেমায় নয়, কল্প কাহিনিতে নয়, নয় কোনো মহাকাব্যে। লাখো ভক্তের মতে বাস্তবেই ঢাকাই সিনেমার অবিসংবাদিত বাদশা শাকিব খান! এ দাবি শাকিব খান ভক্তদের। তাদের কারো কাছে তিনি 'অভিনয়ের ইনস্টিটিউট', কারো কাছে সমগ্র এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ হিরো, আবার কেউ তাকে দেখেন বিশ্বের সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষদের মাঝে অন্যতম হিসেবে।
ফেসবুকে তার অফিশিয়াল ফ্যান গ্রুপ "দ্য কিং অভ ঢালিউড সুপারস্টার শাকিব খান"-এর সদস্য সংখ্যা ৬ লাখের ওপরে। যারা নিজেরদেরকে 'শাকিবিয়ান' বলে পরিচয় দেন, তাদের কাছে সত্যিকার অর্থেই "লাইফ ইজ ওয়ান, গড ইজ ওয়ান, নাম্বার ওয়ান শাকিব খান"।
কিং খানের সিনেমাসহ সব ধরনের কাজের আপডেট থেকে শুরু করে শাকিবিয়ানদের প্রত্যাশা, মতামত সবই তারা ব্যক্ত করেন এই অফিশিয়াল গ্রুপে। এখানে এডমিন হিসেবে আছে শাকিব খানের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজটিও। প্রিয় নায়ককে নিয়ে স্মৃতিচারণ, তার মতো সেজে ছবি শেয়ার করা, বিশেষ দিনে নায়ককে অভ্যর্থনা জানানোর পরিকল্পনাও করা হয় এই গ্রুপেই।
এমনকি শাকিবের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেলে সারাদিন না খেয়ে কাটান গ্রুপের কেউ কেউ- এমন ঘটনাও আছে। গত ১৭ আগস্ট দীর্ঘ নয় মাস আমেরিকায় থাকার পর শাকিব খানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আনন্দ মিছিল করে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন গ্রুপের সদস্যরা।
সোশ্যাল মিডিয়ায় শাকিব খানকে নিয়ে নাক সিঁটকানো প্রজন্মের ধারণা শাকিবের সিনেমা শুধু রিকশাওয়ালা ভাইয়েরা বা নিম্নবিত্ত মানুষেরাই দেখেন বেশি!
শাকিবিয়ানদের অফিশিয়াল এই গ্রুপের কাছে জানতে চাওয়া হয়, কেন তারা শাকিব খানের ফ্যান! জানার চেষ্টা হয়, বিপুল সংখ্যক ভক্তদের এই তালিকায় কারা? শুধুই নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ?
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বেড়ে ওঠা শাকিবিয়ান হাবিবুর রহমান এমবিএ করছেন রাজশাহী কলেজ থেকে। পাশাপাশি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ২০০৮ সালে 'প্রিয়া আমার প্রিয়া' সিনেমাটি দেখে শাকিব খানের ভক্ত বনে যান তিনি। তার ভাষ্যে, "ছোট মানুষ ছিলাম তখন, ফ্যান কী জিনিস বুঝতাম না। সেসময় শাকিব খানের সিনেমার নামসহ একটা টি-শার্ট কিনেছিলাম। সেই থেকেই শুরু।
শাকিব খানের সিনেমা দেখতে বাড়ি থেকে ৮০-১০০ কিলোমিটার দূরের হলেও গিয়েছি। কাজের জন্য বা ঘুরতে যেখানেই যাই, সেখানেই প্রথমে সিনেমা হল খুঁজি আমি। হলে শাকিবের সিনেমা চললে কখনো মিস করি না। এক ঈদে সর্বোচ্চ চারটা সিনেমা দেখেছি শাকিব খানের", বলেন তিনি।
কেন শাকিব খানের ভক্ত তিনি- এমন প্রশ্নের জবাবে জানান, "ভালোবাসার তো নির্দিষ্ট কোনো কারণ বলা যায় না। প্রথম প্রথম শাকিব খান যতক্ষণ পর্দায় থাকতেন ততক্ষণই সিনেমাটা ভালো লাগতো। উনাকে ছাড়া কিছু বুঝতাম না তখন, উনি ক্যামেরার সামনে থাকলেই সাতখুন মাফ। এখন আমরা গল্প, মেকিং, প্রেজেন্টেশন সব দেখি।
পৃথিবীর সব জায়গায় বিনোদনের সর্বোচ্চ মাধ্যম সিনেমা। সেখানে আমাদের দেশকে প্রায় দুই যুগ ধরে লিড দিচ্ছেন তিনি। বাংলাদেশের একমাত্র সুপারস্টার বলা যায় তাকে। দেশের সিনেমার ইতিহাসে তাই রাজ্জাক স্যারের পরে আমার কাছে সেরা নায়ক শাকিব খান। তাকে সামনাসামনি দেখে আমার হার্টবিট অনেক বেড়ে গিয়েছিল।"
এ প্রসঙ্গে শাকিব খানের আরেক নারী ভক্ত রহিমা আফরোজ ইভা বলেন, "আমি একজন ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট। নতুন প্রজন্মের একজন হয়ে আমার অবশ্যই নতুন নতুন নায়ক এর ফ্যান হওয়া উচিত। কিন্তু না, আমি এমন এক পুরুষ দেখেছি যাকে দেখলে অন্য রকম একটা অনুভূতি খুঁজে পাই। আমি এমন এক পুরুষের অভিনয় দেখেছি যাকে দেখলে আর সারা পৃথিবীর কোনো নায়কের অভিনয় দেখতে ইচ্ছে করবে না। আমি এমন একজন পুরুষকে দেখেছি যাকে দেখলে মনে হয় স্বর্গের কোন মানুষ যেন এই পৃথিবীতে নেমে এসেছে।
'আমার স্বপ্ন তুমি' সিনেমাটি নিশ্চয়ই আপনারা দেখেছেন। এটা এমন একটা সিনেমা যেটা আমার মত বয়সী যে কোনো মেয়ে মন দিয়ে দেখলে এই রহস্যময়ী পুরুষের প্রেমে পড়ে যাবে। আর এই রহস্যময়ী পুরুষ অন্য কেউ নয় তিনি হলেন সবার নয়নমণি, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির গর্ব, ঢালিউড রাজকুমার কিং শাকিব খান। নতুন প্রজন্মের হয়েও শাকিবকে কেন এতো ভালোবাসি আমি জানিনা নিজেও জানিনা। শাকিবের বয়স যা-ই হোক না কেন তিনিই চিরকাল আমার কাছে এক নম্বর নায়ক আছেন আর থাকবেন। এখন শুধু আমি নই আমার মত বাংলাদেশের কোটি কোটি তরুণীর হৃদয়ের পুরুষ এই হ্যান্ডসাম।"
শাকিব ভক্তদের বেশির ভাগই প্রিয় নায়ক নিয়ে এমন উচ্ছ্বসিত।
গ্রুপে শাকিব খানের নানা বিষয়ে আপডেট পোস্ট করে সরব থাকেন আরেক ভক্ত জাহিদ হাসান। নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষে একটি বিদেশি কোম্পানিতে কর্মরত আছেন তিনি। শাকিব খানের সিনেমা ছাড়া তিনি কখনো হলমুখী হন না। তার মতে বাংলাদেশি সিনেমার দর্শকদের অধিকাংশই শুধু শাকিব খানের সিনেমা দেখতে হলে যান। শাকিবিয়ানরা শুধু ফেসবুক পোস্টেই সরব না, প্রিয় তারকাকে হলে গিয়ে সাপোর্ট করার দিকেও সবচেয়ে এগিয়ে।
জাহিদ বলেন, "শাকিব সবার চেয়ে আলাদা কারণ সে তার কাজটাকেই ফোকাস করে, কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। তার সামনে যা আছে সেটাই দেখে। পেছনে কে, কী বলছে বা করছে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। এজন্যই সে সবার সামনে আছে এবং থাকবেও ইনশাআল্লাহ।
"এডুকেটেড পার্সনরা হয়তো সবার সামনে তাকে নিয়ে এত কথা বলেন না, কিন্তু অনেকেই তার ফ্যান। আমার পরিচিত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ নানা কর্মক্ষেত্রের উচ্চশিক্ষিত মানুষ শাকিবের সিনেমা দেখেন। আবার অনেক মানুষ অযথাই তাকে নিয়ে সমালোচনা করে। সবারই ভালো-খারাপ দিক আছে। তিনি যতটুকু ডিজার্ভ করেন তারচেয়েও অনেক বেশি সমালোচনা করা হয় তাকে নিয়ে।"
গ্রুপের আরেক সক্রিয় সদস্য মাহদি হাসান তামিম কাজ করেন সিলেটের এক প্রিন্টিং প্রেসে। শাকিব খান তার কাছে আবেগের আরেক নাম। ছোটবেলায় তার গ্রামের বাড়িতে যখন টিভি ছিলো না তখন পাশের বাড়ির সাদা-কালো টিভিই ছিলো ভরসা। ঘরের বাইরে থেকে টিনের ছিদ্র দিয়ে এক চোখ বন্ধ করে আরেক চোখ দিয়ে শাকিব খানের সিনেমা দেখতেন তিনি।
মাহদির প্রিয় সিনেমা 'সত্তা'। তার ভাষ্যে, "যারা শাকিব খানের সমালোচনা করেন, যারা বলেন শাকিব খান অভিনয় জানেনা, এই জানেনা, সেই জানেনা- তাদের সাজেস্ট করব যে আপনারা 'সত্তা' মুভিটা দেখেন। এরপরও যদি আপনি বলেন শাকিব খান অভিনয় জানেনটা, তাহলে আমি বলব আপনি অভিনয়ের কিছুই বোঝেন না।'
শুধু দেশের মানুষই নন, পাশের দেশ ভারতের বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা শাকিব খানের। ভারতীয় অনেক ভক্তও নিয়মিত পোস্ট করেন এই গ্রুপে। তাদের মধ্যে অন্যতম নাম মুক্তার হোসেন। সুযোগ পেলে শাকিব খানকে নিয়ে সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখেন তিনি। সেই সিনেমায় নায়িকা হিসেবে রাখতে চান দক্ষিণ ভারতের জনপ্রিয় অভিনেত্রী রাশমিকা মান্দানাকে।
"দ্য কিং অভ ঢালিউড সুপারস্টার শাকিব খান" গ্রুপের ক্রিয়েটর মিফতাহ উদ্দিন জানান শাকিব খানের সব ভক্তদের এক ছাতার নিচে আনতেই ২০১৭ সালে গ্রুপটা খুলেছিলেন। সিলেট শহরে প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা করেন তিনি। ১৯৯৯ সালে শাকিবের প্রথম সিনেমা 'অনন্ত ভালোবাসা' দেখে তার ভক্ত হয়েছিলেন মিফতাহ। এরপর থেকে তার সব সিনেমাই দেখেছেন অসংখ্যবার। নিজেকে কিং খানের পাগলা ভক্ত দাবি করেন তিনি।
মিফতাহ বলেন, "বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ফ্যানরা মিলে শাকিব খানের সাথে তার জন্মদিন পালন করেছিলাম আমরা ২০১৯ সালে। সেটি আমার সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি। এছাড়াও শাকিবের বিভিন্ন সিনেমার শ্যুটিং এর সময়, রমজানে ইফতারের সময় ভাইয়ার সাথে দেখা করেছি আমরা। যতবারই দেখা হয়েছে তার আন্তরিকতা আমাদের মুগ্ধ করেছে। একবার শ্যুটিং এর সময় দেখা করতে যাওয়া ভক্তদের সবাইকে কলা খেতে দিয়েছিলেন শাকিব ভাই। আমি কলা পাই নি বলে নিজে অর্ধেকটা কলা খেয়ে বাকি অর্ধেকটা পাঠিয়েছিলেন আমার জন্য। এটা অনেক ভালো লাগার একটা বিষয় ছিলো আমার জন্য এটা।"
'পূণর্দৈঘ্য প্রেম কাহিনী' সিনেমা মুক্তির দিন মধুমিতা সিনেমা হলে ভক্তরা মিলে বিশাল মিছিলের আয়োজন করেছিলেন বলে জানান মিফতাহ। "বাংলাদেশের সিনেমা একদিন আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে জনপ্রিয়তা পাবে বলে অনেক বছর আগে থেকেই স্বপ্ন দেখতেন শাকিব খান। তখন কেউ ভাবতেই পারতো না এই কথা। তার স্বপ্ন কিন্তু পূরণ হয়েছে। ভাইয়ার সাথে যখন কথা বলি, তখন মনে হয় যে মুভির সমুদ্রের সাথে কথা বলছি," উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলেন মিফতাহ।
শাকিব খানের সমালোচকদের সম্পর্কে তার মতামত জানতে চাইলে বলেন, "সমালোচকদের আমি ভালো চোখে দেখি। কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনা চাই আমরা। খুল্লামখুল্লা সমালোচনার পোস্ট গ্রুপে এলাও করি না, কমেন্টেও এলাও করি না। বাজে কথাবার্তা দিয়ে যে সমালোচনা, সেটা এক্সেপ্ট করি না। তবে কে বা কারা পেছনে কী বলছে এটা নিয়ে উনিও যেমন ভাবতে চান না, আমরাও ভাবতে চাই না। শাকিবকে নিয়ে অনেকেই অনেক ধরনের কথা বলে প্রতিনিয়ত, কিন্তু আজ পর্যন্ত উনি একটা কথারও মুখে জবাব দেন নাই।"
শাকিবের নতুন সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর নতুন সব লুক গ্রুপের ভক্তদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে বলে জানান মিফতাহ। 'বসগিরি' সিনেমার হেয়ার স্টাইল বাংলাদেশের গ্রাম থেকে শহরে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল । প্রায়ই শাকিব খানের স্টাইল ফলো করে ছবি তোলেন শাকিবিয়ানরা। স্বপ্নের নায়কের হাঁটাচলা, কথা বলার ধরন সবই অনুকরনীয় তাদের কাছে।
দীর্ঘদিন আমেরিকায় কাটিয়ে আসার পর আগামী মাসে আবারও শাকিব খানের বিদেশ যাওয়ার খবরে হতাশ হয়েছেন অনেক ভক্তই। কিন্তু তাদের বিশ্বাস সব সমালোচকের কড়া জবাব দিয়ে অচিরেই কিং খান আবার ফিরে আসবেন নিজ মহিমায়। কারণ দেশীয় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখতে এখনো শাকিব খানের কোনো বিকল্প নেই।
সম্প্রতি ঢালিউডের বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু দাবি করেছেন, জনপ্রিয়তায় প্রয়াত অভিনেতা সালমান শাহকেও ছাড়িয়ে গেছেন শাকিব খান। তবে এই গ্রুপের সদস্যদের কাছে শাকিব শুধু সালমান শাহই নয়, হলিউড-বলিউডের শীর্ষ তারকাদেরও সমকক্ষ! শাকিবিয়ান সুমন আলম যেমন বলছেন, "শাকিব খান যদি বাংলাদেশের হিরো না হয়ে বলিউড বা হলিউডের হিরো হতো তবে জাদুঘরে সালমান খান ও টম ক্রুজের মতো তারও মোমের মূর্তি থাকতো। বস তোমাকে স্যালুট।"