লিথিয়াম-আয়ন হটিয়ে গ্রাফিন ব্যাটারিই কি হতে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ?
বর্তমানে বৈদ্যুতিক যানবাহন এবং স্মার্টফোনের ব্যাপারে সবচেয়ে সাধারণ সমালোচনাটা হলো এগুলো চার্জ হতে বেশি সময় নেয়।
আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে কেউ চার্জের জন্য এক মিনিটের বেশি সময় নেওয়া গাড়ি চালাতে চাইবেই বা কেন? কল্পনা করে দেখুন, একটি বৈদ্যুতিক যানে এমন একটি ব্যাটারি আছে যেটি 'অতিদ্রুত' চার্জ নিতে সক্ষম এবং সাথে আছে লম্বা ড্রাইভিং রেঞ্জ। অথবা এমন একটা স্মার্টফোনের কথা ভেবে দেখুন যেটি মাত্র এক মিনিটের মধ্যে ফুল চার্জ হতে পারবে। শোনামাত্র হয়তো অসম্ভব মনে হতে পারে, কিন্তু গ্রাফিন ব্যাটারি এ সম্ভাবনাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে।
লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির পতন
যত দিন যাচ্ছে বিশ্ব ততই ব্যাটারি চালিত যানবাহনের দিকে ঝুঁকছে। তাই প্রকৌশলীরাও উদ্ভাবন করছেন আরও টেকসই এবং উন্নতমানের ব্যাটারি।
আমাদের আধুনিক জীবন নব্বইয়ের দশকে উদ্ভাবিত লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে নানা চিকিৎসা সামগ্রী, বৈদ্যুতিক গাড়ি, স্যাটেলাইসহ অনেক ক্ষেত্রেই এই ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়।
লিথিয়ামের তৈরি ব্যাটারিতে আছে উচ্চ শক্তি ঘনত্ব (হাই এনার্জি ডেনসিটি)। তাই এ ব্যাটারিগুলোকে শক্তি সংরক্ষাণাগারের (এনার্জি স্টোরেজ) অ্যাপ্লিকেশনগুলোর বেশ পাকাপোক্ত বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তবে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির একটা সমস্যা এখনো দূর করা যায়নি; এর নিরাপত্তাহীনতা। এ ব্যাটারিগুলোতে যে তরল পদার্থ থাকে সেটি অত্যন্ত দাহ্য এবং ব্যাটারিগুলোর বাহ্যিক স্তরের কোনো ক্ষতি মুহূর্তেই শর্ট সার্কিটের সৃষ্টি করতে পারে। এতে ঘটতে পারে অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণের মতো দুর্ঘটনা। যেমনটি ঘটেছিল ২০১৬ সালে। সে বছর পুরো বিশ্বজুড়ে স্মার্টফোনের আকস্মাৎ বিস্ফোরণে বহু ব্যবহারকারীর শরীর পাঁচ ডিগ্রি পর্যন্ত পুড়ে যাওয়ার দুর্ঘটনা ঘটে।
গত কয়েক বছর ধরে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিগুলোতে বড়সড় কুলিং সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে এই কুলিং সিস্টেম অনেক স্থান (স্পেস) দখল করে নেয় যা এনার্জি স্টোরেজ হিসেবে কাজে লাগানো যেত।
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির আরেক সমস্যা হলো এগুলো অনবায়নযোগ্য। এ ব্যাটারিতে যে যন্ত্রাংশগুলো ব্যবহার করা হয় তার অধিকাংশই বায়োকম্প্যাটিবল নয়। যার ফলে এগুলো নবায়ন করা খুবই ব্যয়সাধ্য।
পরিশেষে, এই ব্যাটারিগুলোর ক্ষমতা ঘনত্ব (পাওয়ার ডেনসিটি) কম। একটা স্মার্টফোনের উদাহরণ ধরুন; এটির উচ্চ শক্তি ঘনত্বের কারণে দিনের সিংহভাগ সময় পর্যন্ত এর ব্যাটারিতে চার্জ থাকে। কিন্তু পুনরায় চার্জ দিতে হলে এই ডিভাইসটিকে আরেকটি পাওয়ার সোর্সের সাথে এক বা একাধিক ঘণ্টা ধরে সংযুক্ত রাখতে হয় কারণ এর ক্ষমতা ঘনত্ব নিম্ন।
গ্রাফিনের সম্ভাবনা
গ্রাফিন তাপ ও বিদ্যুৎ পরিবাহী হিসেবে খুবই চমৎকার একটি পদার্থ এবং দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে এর কোনো ক্ষতিও হয় না। মাত্র এক পরমাণু সমান পাতলা এই পদার্থটি নমনীয়, কাঁচের মতো স্বচ্ছ এবং গঠনের কারণে স্টিলের চেয়ে এটির প্রসারণযোগ্য শক্তি চার গুণেরও বেশি।
এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে গ্রাফিন শুধু ব্যাটারিই নয়, সুপারক্যাপাসিটর হিসেবেও উপযুক্ত।
গ্রাফিন-সুপারক্যাপাসিটর ব্যাট্যারির সমপরিমাণ শক্তি(এনার্জি) স্টোর করে রাখতে না পারলেও মাত্র কয়েক মিনিটে পূর্ণ চার্জ নিতে সক্ষম।
গ্রাফিন সুপারক্যাপাসিটরের নিম্ন শক্তি ঘনত্বের সমস্যাটি দূর করতে বিজ্ঞানীরা সুপারক্যাপাসিটর এবং ব্যাট্যারির সংমিশ্রণে শংকর (হাইব্রিড) এনার্জি স্টোরেজ সিস্টেম তৈরিতে কাজ করছেন।
আসতে পারে গ্রাফিন-অ্যালুমিনিয়াম হাইব্রিড ব্যাটারি!
অস্ট্রেলিয়ায়র ইউনিভার্সিটি অভ কুইন্সল্যান্ড-এর গবেষকরা গ্রাফিন ম্যান্যুফ্যাকচারিং গ্রুপ-এর সাথে একযোগে গ্রাফিনের তৈরি শংকর ব্যাটারির একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করেছেন। এতে ইলেকট্রোড ম্যাটেরিয়ালস হিসেবে গ্রাফিন এবং অ্যালুমিনিয়াম উভয় ব্যবহার করে হয়।
গ্রাফিন-অ্যালুমিনিয়াম নামক এ ব্যাটারির ১৫০ থেকে ১৬০ ওয়াট আওয়ার পার কেজি শক্তি ঘনত্ব আছে এবং এটি শুধু এক থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চার্জ নিতে পারে।
নিরাপত্তা এবং নবায়নযোগ্যাতার ক্ষেত্রে গ্রাফিন অ্যালুমিনিয়াম-আয়ন ব্যাটারি অনেক সুবিধাজনক। এ ব্যাটারির স্থায়িত্ব প্রায় ২,০০০ সাইকেলেরও বেশি এবং এর পারফর্ম্যান্সেও কোনো ত্রুটি নেই।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গ্রাফিন ম্যানুফ্যাকচারিং গ্রুপ ঘোষণা করেছে তারা স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপসহ অন্যান্য ডিভাইসে ব্যবহারের জন্য পাউচ সেল ফরম্যাটে গ্রাফিন অ্যালিমিনিয়াম আয়ন ব্যাটারি উৎপাদন করেছে।
তাদের মতে, তাত্ত্বিকভাবে এ ব্যাটারিগুলোর শক্তি সীমাবদ্ধতা প্রায় ১০৫০ ওয়াট আওয়ার পার কেজি। এভাবে আরও উন্নত করা গেলে গ্রাফিন ব্যাটারিগুলো বাণিজ্যিক ব্যাটারির চেয়েও শক্তিশালী হবে।
গ্রাফিন এনহান্সড লিথিয়াম-সালফার ব্যাটারি
২০২১ সালের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক কোম্পানি লাইটেন ঘোষণা করেছিল, বৈদ্যুতিক যানবাহনের জন্য তারা এমন একটি গ্রাফিন ব্যাটারি প্রস্তুত করেছে যেটির শক্তি ঘনত্ব প্রচলিত ব্যাটারির শক্তি ঘনত্বের চেয়ে তিন গুণ বেশি।
এই লিথিয়াম সালফার (লি-এস) ব্যাটারিগুলোকে বলা হয় পুনরায় চার্জযোগ্য ব্যাটারির পরবর্তী প্রজন্ম। কিন্তু বাস্তবে এ ব্যাটারিগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে সমস্যাটি হলো এটির ডিসচার্জ সাইকেলের সময়ে দ্রাব্য পলিসালফাইড স্পিশিজের গঠন। ধনাত্মক প্রান্ত এবং ঋণাত্মক প্রান্তের মধ্যে এই অন্তর্বর্তী স্পিশিজগুলো ছড়িয়ে গিয়ে অভ্যন্তরীণ শর্ট সার্কিট ঘটায়। এটিকে বলা হয় শাটলিং ইফেক্ট। এই ইফেক্টটি লি-এস সেলের সামান্য কার্যকারিতা এবং দ্রুত সক্ষমতা কমে যাওয়ার জন্য দায়ী।
এই সময়াটি দূর করার জন্য লাইটেন সালফার ঋণাত্মক প্রান্তে একটি থ্রি-ডি গ্রাফিন ঝিল্লি যুক্ত করে যেটি সেপারেটর হিসেবে বেশ কার্যকরী এবং সাইক্লিক ক্ষমতা ক্ষয়ের হারকে কমিয়ে দেয়।
লাইটসেল ইভি নামক এই ডিভাইসটির ৯০০ ওয়াট আওয়ার পার কেজি শক্তি ঘনত্ব রয়েছে। পরীক্ষা করে দেখা যায় একটি লাইটসেল প্রোটোটাইপের সহন ক্ষমতা ১,৪০০ চার্জ-ডিসচার্জ সাইকেলের বেশি।
গ্রাফিন এনহান্সড পলিমার ব্যাটারি
সম্প্রতি ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অভ টেকনোলজি (এমআইটি)-র একটি স্পিন-অফ কোম্পানি পলিজুল হাই-পাওয়ার ডেটা সেন্টার ব্যাকআপ এবং পাওয়ার গ্রিড অ্যাপ্লিকেশন্সের জন্য একটি নতুন ব্যাটারি প্রযুক্তির ঘোষণা করেছে। প্রযুক্তিটি হলো একটি দুই ইলেক্ট্রোডের ইলেক্ট্রোকেমিকেল সেলের ডিভাইস। এটিতে আছে কার্বন ও গ্রাফিনের সংমিশ্রণ এবং কন্ডাক্টিভ পলিমার।
ব্যাটারিটি ১০ সেকেন্ডেরও কম সময়ে ১ মেগা ওয়াট পর্যন্ত ডিসচার্জ করতে পারে এবং পাঁচ মিনিটের কম সময়ে পুনরায় চার্জ নিতে পারে। এর ভোলতেজ রেঞ্জ ১৫৮ ভি থেকে ৯৭২ ভি পর্যন্ত এবং বড়সড় কোনো ক্যাপাসিটি লস ছাড়াই -৪০ ডিগ্রি থেকে ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রার পরিবেশে অপারেট করতে পারে।
গ্রাফিন অদাহ্য লি-ব্যাটারি
লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিতে শর্ট সার্কিটের ফলে আগুন ধরে যায়। এটি মূলত হয় এর ভেতরে থাকা দাহ্য পদার্থ ইলেক্ট্রোলাইটের কারণে। যুক্ত্ররাষ্ট্র ভিত্তিক নন-টেক এনার্জি এমন একটি অদাহ্য গ্রাফিন বেজড লি-ইয়ন ব্যাটারি প্যাক তৈরি করেছে যেটি ব্যবহারে নিরাপদ তো বটে, আবার বেশ পরিবেশবান্ধবও। ইলেক্ট্রোড ম্যাটেরিয়াল হিসেবে তারা লি-ব্যাটারিতে গ্রাফিন ব্যবহার করে। তাছাড়া অর্গ্যানোলাইট টিএম নামে তারা একটি অদাহ্য ইলেক্ট্রোলাইট তৈরি করে যেটি দামেও সস্তা।
এই ব্যাটারির ১৬২.৫ ওয়াট আওয়ার পার কেজি শক্তি ঘনত্ব রয়েছে। তাছাড়া ৮০ শতাংশ সক্ষমতায় ১৪০০-র চেয়ে বেশি সাইকেল সহ্য করতে পারে এ ব্যাটারি। অর্থাৎ দশ বছর স্থায়ী হবার ক্ষমতা রাখে এ লি-ব্যাটারি যেখানে সাধারণ লি-ব্যাটারিগুলো দুই থেকে তিন বছর স্থায়ী হয় (৩০০-৫০০ সাইকেল সহ্য করতে পারে)। এছাড়াও এই ব্যাটারি পুরোপুরিভাবে অগ্নি প্রতিরোধী এবং যেকোনো আবহাওয়ার জন্য উপযোগী।
সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের এ কোম্পানিটি ইতোমধ্যে গ্রাফিন ব্যাটারির প্রি-অর্ডার নেওয়া শুরু করেছে এবং বৈদ্যুতিক যানবাহন, কম্পিউটার এবং এমনকি সামরিক কাজের জন্যও এ ব্যাতারি কাস্টোমাইজ করা যাবে।
গ্রাফিন ব্যাটারির ভবিষ্যৎ
সম্প্রতি টেসলা জানিয়েছে তাদের উৎপাদিত মডেল-৩ ব্যাটারির শক্তি ঘনত্ব প্রায় ২৬০ ওয়াট আওয়ার পার কেজির কাছাকাছি। তবে অতিরিক্ত উত্তপ্ত হওয়া প্রতিরোধে এটির একটি জটিল কুলিং সিস্টেমের প্রয়োজন। যার ফলে এর জন্য অনেক স্পেসের প্রয়োজন। অন্যদিকে, গ্রাফিন ব্যাটারিগুলো অতিরিক্ত উত্তপ্ত এবং বিস্ফোরিত হয় না। ফলে এ ব্যাটারিতে কুলিং সিস্টেমের কোনো প্রয়োজন নেই এবং বেঁচে যাওয়া স্পেসটিকে বৈদ্যুতিক গাড়িতে এনার্জি সর্টিং ব্যাটারির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
গ্যাক (GAC) মোটর লিমিটেড নামে চীনের একটি অটোমোবাইল কোম্পানি আইয়ন ভি গাড়ি লঞ্চ করে। এ গাড়িটিতে রয়েছে ১,০০০ কিলোমিটার রেঞ্জের একটি ব্যাটারি যেটি আট মিনিটের মধ্যে ৮০ শতাংশ চার্জ নিতে সক্ষম। এটিই ছিল গ্রাফিন ব্যাটারির ইতিহাসে একটি বড় মাইলফলক। যেভাবে বাণিজ্যিকিকরণ চলছে, তাতে করে গ্রহণযোগ্যতার দিক দিয়ে গ্রাফিন ব্যাটারিগুলো প্রচলিত ব্যাটারিকে ছাড়িয়ে যাবে বলেই আশা করছে প্রযুক্তিবিদরা।
- সূত্র: অ্যাজো ন্যানো