বৈদ্যুতিক গাড়ির রেকর্ড বিক্রি! তবে জ্বালানি তেলের গাড়ির দৌরাত্ম্য চলবে আরো অনেক দিন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রেতাদের মাঝে বেড়েছে বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার প্রবণতা। বর্তমানে এই হার পূর্ববর্তী যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। মার্কিন কোম্পানি কক্স অটোমোবাইলের গাড়ি বিক্রি সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট পর্যালোচনা করে এই তথ্য জানা গিয়েছে।
মূলত যুক্তরাষ্ট্রে বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার প্রতি যে ঝোঁক; সেটি গত কয়েক বছর আগে থেকেই উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কক্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা চলতি বছরের দ্বিতীয় চতুর্থাংশে প্রায় ৩ লাখ ব্যাটারিচালিত বৈদ্যুতিক গাড়ি কিনেছেন। যা দেশটির ইতিহাসে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রিত ক্ষেত্রে রেকর্ড।
চলতি বছরের বৈদ্যুতিক গাড়ির এই বিক্রির পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় শতকরা ৪৮ ভাগ বেশি। একইসাথে দেশটিতে এই তিন মাসে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির সংখ্যা পুরো ২০১৯ সালে বিক্রি হওয়া মোট বৈদ্যুতিক গাড়ির চেয়েও বেশি।
কক্সের রিপোর্টে ৩ লাখ বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির যে সংখ্যাটি উঠে এসেছে, সেখানে হাইব্রিড বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির সংখ্যাটি বিবেচনায় আনা হয়নি। অর্থাৎ বৈদ্যুতিক কিংবা জ্বালানি উভয় সুবিধা থাকা হাইব্রিড মডেলের বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত করা হলে রিপোর্টে বিক্রির সংখ্যা আরও বেশি হতো।
কক্স অটোমোবাইলের পক্ষ থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে, চলতি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির সংখ্যা ১০ লাখ অতিক্রম করবে। ইতোমধ্যেই চলতি বছরের দ্বিতীয় চতুর্থাংশের শেষ নাগাদ মোট ৫ লাখ ৫৭ হাজার বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টর জড়িত। এক্ষেত্রে গাড়িগুলোতে পূর্বের তুলনায় মূল্য হ্রাস, মডেলে বৈচিত্র্য ও উৎপাদনে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি অন্যতম কারণ।
এ বিষয়ে কক্স অটোমোবাইলের ইন্ডাস্ট্রি ইনসাইটের ডিরেক্টর স্টেফানি ভালদেজ-স্ট্রেটি বলেন, "সবগুলো ফ্যাক্টরের সম্মলিত কারণেই বৈদ্যুতিক গাড়ির বিক্রির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ইনফ্ল্যাশন রিডাকশন অ্যাক্টও (আইআরএ) বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখছে।"
ইনফ্ল্যাশন রিডাকশন অ্যাক্ট জারির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার ক্ষেত্রবিশেষে বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর ৭,৫০০ ডলার পর্যন্ত ট্যাক্স ছাড় দিয়েছে। এক্ষেত্রে যেখানে বৈদ্যুতিক গাড়ির যন্ত্রপাতিগুলো তৈরি ও একত্র করা হয় সেসব ক্ষেত্রকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে সকল বৈদ্যুতিক গাড়ির মডেলের ক্ষেত্রে এই ট্যাক্স ছাড় প্রযোজ্য হয়নি।
অলাভজনক ট্রেড এসোসিয়েশন অ্যালায়েন্স ফর অটোমোটিভ ইনোভেশনের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে থাকা বৈদ্যুতিক গাড়ির ৯৭ টি মডেলের মধ্যে বর্তমানে শুধু ১৮ টি মডেলের গাড়িতে এই ট্যাক্স ছাড়ের সুবিধা প্রযোজ্য হচ্ছে।
চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বৈদ্যুতিক গাড়ি হিসেবে টেসলা মডেল ৩, টেসলা মডেল ওয়াই, ফোক্সভাগেন আইডি.৪, রিভিয়ান আর১টি ইত্যাদি মডেলগুলো সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে। আর এই মডেলগুলোতে অল্প পরিমাণে হলেও ট্যাক্স মওকুফ সুবিধা প্রযোজ্য হচ্ছে।
স্টেফানি ভালদেজ মনে করেন, বৈদ্যুতিক গাড়ির মার্কেট বেশ পরিবর্তনশীল অবস্থায় রয়েছে। জুলাইয়ে কক্স অটোমোবাইলের প্রকাশিত সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেকেরও বেশি গ্রাহক নতুন কিংবা পুরাতন ব্যাটারিচালিত বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার কথা ভাবছে। যদিও ২০২১ সালেও এই হার ছিল মাত্র ৩৯ ভাগ।
এ বিষয়ে স্টেফানি ভালদেজ বলেন, "বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে যারা একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পছন্দ করে,তাদের কাছে ইতোমধ্যেই পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এখন অন্যদের কাছেও বৈদ্যুতিক গাড়িকে পৌঁছে দিতে হবে। এর বিক্রি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে যারা বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনার কথা ভাবছে, তাদেরকে ক্রেতায় পরিণত করার বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে হবে।"
তবে খুব শীঘ্রই হয়তো খুব বড় পরিসরে সেটি করা সম্ভব হচ্ছে না। কেননা মার্কিন এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) সেলস প্রজেকশন থেকে দেখা যায়, বৈদ্যুতিক গাড়িতে আগ্রহী ক্রেতাদের বড় আকারে গাড়িটির ব্যবহার পর্যন্ত নিয়ে আসতে আরও কয়েক দশক পর্যন্ত সময় লেগে যাবে।
ইআইএ এর প্রজেকশন অনুযায়ী, যদি বর্তমানের আইন ও রেগুলেশনই বিদ্যমান থাকে তবে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার ২০৫০ সাল পর্যন্তও অনেক বেশি যে বৃদ্ধি পাবে এমনটা নয়। বৈশ্বিক বাজারে তেলে দাম যদি বৃদ্ধিও পায়, তবুও যুক্তরাষ্ট্রে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈদ্যুতিক গাড়ি ও ট্রাকের বিক্রির পরিমাণ এক তৃতীয়াংশেরও কম হবে।
এ সম্পর্কে স্টেফানি ভালদেজ মনে করেন, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রথম বাধা হচ্ছে, এর অপেক্ষাকৃত চড়া দাম। যদিও টেসলা কিংবা ফোর্ডের মতো গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিগুলো বৈদ্যুতিক গাড়িতে উল্লেখযোগ্য হারে মূল্য ছাড় দিয়েছে। তবুও এখনো গ্যাস কিংবা তেলের গাড়ির পরিবর্তে বৈদ্যুতিক গাড়ি কেনা বেশ ব্যয়বহুল বলে বিবেচিত হচ্ছে।
কেলে ব্লু বুকের হিসেব মতে, গত জুলাইয়ের হিসেবে বৈদ্যুতিক গাড়ির গড় মূল্য ছিল ৫৩,৪৬৯ মার্কিন ডলার। এর পরিপ্রেক্ষিতে তেল কিংবা গ্যাসে চালিত অন্যান্য সাধারণ গাড়ির গড় মূল্য ছিল ৪৮,৩৩৪ ডলার।
কক্সের কনজিউমার সার্ভে অনুযায়ী, বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বাধা হচ্ছে, চার্জিং স্টেশনের অপ্রতুলতা।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অধিক সক্ষমতার ব্যাটারি সম্পন্ন গাড়ির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন এনার্জি ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ২০২১ সালে ৩০০ মাইল দূরত্ব যেতে পারে এমন ক্ষমতাসম্পন্ন বৈদ্যুতিক গাড়ির মডেলের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩ টি। কিন্তু ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ টিতে।
তবে যুক্তরাস্ট্রে বৈদ্যুতিক গাড়িগুলোর ব্যাটারির সক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে চার্জিং স্টেশনের সংখ্যা খুব বেশি বৃদ্ধি পায়নি। ফলে দেশজুড়ে বৃহৎ পরিসরে বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সেটি অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।
অ্যালায়েন্স ফর অটোমোটিভ ইনোভেশনের বৈদ্যুতিক গাড়ি সম্পর্কিত কোয়াটারলি রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২৩ সালের প্রথম চতুর্থাংশে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১ লাখ ৩৪ হাজার চার্জিং স্টেশন ছিল। আর এর বিপরীতে বৈদ্যুতিক গাড়ি ছিল ৩৩ লাখ ৩৪ হাজার।
তবে ক্যালিফোর্নিয়ার এনার্জি কমিশনের রিপোর্ট মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে রাজ্যেটিতে বৈদ্যুতিক গাড়ির সংখ্যা হবে ৫০ লাখ । সে হিসেবে তাদের গাড়ি ও স্টেশনে চার্জারের অনুপাত ৭:১ ধরে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
ঠিক এই অনুপাতটিকে বিবেচনা করলে যুক্তরাষ্ট্রে চার্জিং স্টেশনের পরিমাণ এখনো বহু কম। সেক্ষেত্রে ঘাটতি পূরণে দেশজুড়ে চার্জিং স্টেশনের পরিমাণ প্রায় আড়াই গুণ বৃদ্ধি করতে হবে৷
এছাড়াও বৈদ্যুতিক গাড়ির ক্ষেত্রে ভৌগলিক ভিন্নতাও ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। রিপোর্ট মতে, যুক্তরাষ্ট্রে মোট চার্জিং স্টেশনের প্রায় ৩০ ভাগ পাবলিক চার্জিং স্টেশনই ক্যালিফোর্নিয়াতে অবস্থিত।
এমনকি বৈদ্যুতিক গাড়ির মার্কেট শেয়ারও ক্যালিফোর্নিয়াতে সবচেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে গাড়ির বিক্রি বৃদ্ধি পেলেও যুক্তরাষ্ট্রে এক রাজ্য অপেক্ষা অন্য রাজ্যে মার্কেট শেয়ারের মধ্যে বহু ভিন্নতা রয়েছে। একইসাথে দেশটির ২৪ টি রাজ্যে মোট বিক্রিত গাড়ির মধ্যে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির পরিমাণ ৫ ভাগেরও কম।
এ সম্পর্কে স্টেফানি ভালদেজ বলেন, বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য নতুন চার্জিং স্টেশন স্থাপন ও পরিচালনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একইসাথে রাজ্যভিত্তিক ও জাতীয় পর্যায়ে প্রণোদনার ব্যবস্থাও করতে হবে।
গত বছর ক্যালিফোর্নিয়ার এয়ার রিসোর্সেস বোর্ড জ্বালানি তেলের নতুন গাড়ি বিক্রি ২০৩৫ সালের মধ্যে বন্ধ করতে ভোট দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত আরও ১৭ টি রাজ্য জ্বালানি তেলের গাড়ির ক্ষেত্রে ক্যালিফোর্নিয়ার মতো একই পথে হাটবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে স্টেফানি ভালদেজ বলেন, "বহু রাজ্যই কার্বন রেগুলেশনের ব্যাপারটি বেশ গুরুত্বের সহকারে বিবেচনা করছে । সেইসব রাজ্যগুলোতে আগামী বছরগুলোতে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির পরিমাণ কতটা বৃদ্ধি পাবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।"