শিশুরা যেখানে সারা বছর মাস্ক পরে স্কুলে যায়!
নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ মহাসড়ক। একের পর এক কনটেইনার ট্রাক সগর্জনে ছুটে যাচ্ছে মহাসড়কের ওপর দিয়ে, পেছনে রেখে যাচ্ছে ধুলোর মেঘ। আশপাশের গোটা এলাকা ঢাকা পড়ছে সেই ধুলোর মেঘের আড়ালে।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার গোগনগরের চর সৈয়দপুর এলাকাটি অবস্থিত শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীর মাঝখানে। এই এলাকায় আছে কিছু লাল ক্যাটাগরির শিল্প।
এখানকার ধুলোর ঘনত্ব আন্দাজ করা কঠিন। তবে ধলেশ্বরীর ওপরে মুক্তারপুর ব্রিজে দাঁড়িয়ে গোটা এলাকার ওপর নজর বোলালে দেখতে পাবেন, পুরু ধোঁয়াশা গোটা চর সৈয়দপুরকে ঘিরে রেখেছে।
এই ধুলোর কারণে চর সৈয়দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির বর্তমান শিক্ষার্থীসংখ্যা ৬৬০ জন।
স্কুলটির দুই শিক্ষক দুলালী আক্তার ও সোহেল রানা বলেন, 'আমরা সারাক্ষণই নিশ্বাসের সঙ্গে ধুলা নিচ্ছি। ছাত্রছাত্রীরা কোনোমতে শব্দ দূষণের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে। কিন্তু ক্লাস করার সময়ও ওদের মাস্ক পরে থাকতে হয়। শ্রেণিকক্ষের ভেতরে সবকিছু ধুলায় ঢাকা পড়ে। কয়বার ঝাড়ু দেব বলুন?'
উদ্বিগ্ন এই শিক্ষক দুজন অবশ্য ব্যতিক্রম। মোটের ওপর গোগনগরের বেশিরভাগ বাসিন্দাই তীব্র বায়ুদূষণের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন না।
কিন্তু তারা এই দূষণের প্রভাব বুঝবে কী করে? দূষক—বিজ্ঞানীরা যেগুলোকে বস্তুকণা বা পিএম২.৫ বলেন—অত্যন্ত সূক্ষ্ম কণা। এদের ব্যাস ২.৫ মাইক্রোমিটার বা তারচেয়েও কম। খালি চোখে এসব বস্তুকণা দেখা যায় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল কেমিস্ট্রি রিসার্চ ল্যাবের একটি দল নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার গোগনগর ও সিমরাইল এলাকার বাতাস পর্যবেক্ষণ করেছে। তাদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সেখানকার বাতাসে পিএম২.৫-এর স্তর আশঙ্কাজনকভাবে বেশি।
এই এলাকা দুটির বায়ুদূষণের মাত্রা প্রায়ই পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর অন্যতম ঢাকার দূষণের হারকে ছাড়িয়ে যায়। এই এলাকা দুটিতে প্রায় ৪০০ শিল্প রয়েছে।
বাতাসের মান নিয়ে এই গবেষণাটি ঢাকা ও ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ যৌথভাবে করেছে।
গবেষণাটি করার জন্য দলটি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার চারপাশে ৩৯টি সেন্সর স্থাপন করে। লেজারের সেন্সরগুলো যুগপৎ সূক্ষ্ম কণা, তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা পরিমাপ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের শিক্ষক ও প্রধান গবেষক অধ্যাপক আব্দুস সালাম টিবিএসকে বলেন, 'সার্বিকভাবে ঢাকার বায়ুদূষণের বেজলাইন দেশে সর্বোচ্চ। কিন্তু আমরা লক্ষ করেছি, গোগনগর ও সিমরাইলের বাতাস প্রায়ই ঢাকার চেয়ে বেশি দূষিত থাকে।
'গোগনগরের বাতাস দূষিত হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী সিমেন্ট কারখানাগুলো। এছাড়া কিছু রি-রোলিং শিল্প ও লেড-ব্যাটারি ভাঙার কারখানা এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহনের ব্যস্ত যাতায়াতও বায়ুদূষণের জন্য দায়ী।'
চলতি বছরের জানুয়ারিতে গোগনগরের বাতাসে পিএম২.৫-এর মাসিক গড় ঘনত্ব ছিল প্রতি ঘনমিটারে ২২৯.৫১৫ মাইক্রোগ্রাম (µgm-3), যা এখন পর্যন্ত এলাকাটির সর্বোচ্চ। জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই এলাকার বাতাসে সূক্ষ্ম বস্তুকণার পরিমাণ ছিল গড়ে ৮৪ µgm-3.
২০২১-এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত সিমরাইলের বাতাসে পিএম২.৫-এর গড় ঘনত্ব ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৭২.৩ মাইক্রোগ্রাম। ল্যাবের গবেষণা সহকারী শহীদ উজ জামানের তথ্য অনুসারে, জানুয়ারিতে পিএম২.৫-এর ঘনত্ব ছিল ১৫৭.৩ µgm-3.
বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যামবিয়েন্ট এয়ার কোয়ালিটি গাইডলাইনস অনুসারে, পিএম২.৫-এর ঘনত্ব ১৫ µgm-3 বা তারচেয়ে কম্র থাকলে বাতাস স্বাস্থ্যকর থাকে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে, স্বাস্থ্যকর বাতাসে পিএম২.৫-এর ঘনত্ব ৫ µgm-3 বা তারচেয়ে কম থাকে।
নারায়ণগঞ্জ পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গোগনগরে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ও সিমরাইলে প্রায় ১২ হাজার মানুষ বাস করে।
পিএম২.৫ ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করে। তাই দীর্ঘদিন এসব সূক্ষ্ম বস্তুকণা ফুসফুসে প্রবেশ করলে সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ), কার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং ফুসফুসের ক্যান্সার হতে পারে। বায়ুদূষণ বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি।
নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. এএফএম মশিউর রহমান বলেন, তীব্র শিল্পায়ন ও অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে নারায়ণগঞ্জে বায়ুদূষণের হার ঢাকার চেয়ে বেশি।
তিনি বলেন, জেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে নবজাতকের শ্বাসকষ্ট ও কার্ডিওভাসকুলার রোগের চিকিৎসা করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় অনেকসময় বেসরকারি ক্লিনিকে রোগীর সংখ্যা বেশি থাকে।
'জেলাটির সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ খুব ভালো হওয়ায় বেশিরভাগ গুরুতর কেসের ক্ষেত্রে রোগীদের ঢাকার হাসপাতালে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এ কারণে নারায়ণগঞ্জে বায়ুদূষণজনিত রোগীদের প্রকৃত পরিসংখ্যান বের করা যায় না,' বলেন তিনি।
গত তিন বছর ধরে সিমরাইলে শীতলক্ষ্যাপাড়ের কাছেই ফার্মেসি চালাচ্ছেন মধ্যবয়সী মাসুম বিল্লাহ। ওয়াপদা কলোনি থেকে ডেমরার সারুলিয়া পর্যন্ত নদীটির তীরে প্রায় শতাধিক ব্যবসায়ী বালু ও পাথরের মতো নির্মাণসামগ্রীর পৃথক ডিপো স্থাপন করেছেন।
মাসুম জানান, তারা যখন ক্রাশার চালায়, তখন নদীর তীরবর্তী এলাকার বাতাস ধোঁয়াশায় ঢেকে যায়। এছাড়া নির্মাণসামগ্রী বহনকারী ট্রাকগুলো চলাচল করলেও ধুলো ছড়ায়।
মাসুম বলেন, 'এলাকার বাতাসের মান খারাপ। বৃষ্টি হলেই শুধু অবস্থার একটু উন্নতি হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা, বিশেষ করে বয়োজ্যেষ্ঠরা প্রায়ই আমার কাছে কার্ডিওভাসকুলার ওষুধের জন্য আসেন।'
সিমরাইল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর উদ্দিন মিয়া টিবিএসকে বলেন, সিমরাইল মূলত শিল্প এলাকা।
নূর বলেন, কাঁচপুর সেতু কখনোই যানজটমুক্ত থাকে না। যানজটে আটকে থাকা যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া কারণেও বায়ুদূষণ হয়।
জনপ্রতিনিধি কিংবা সিমরাইলের বাসিন্দাদের কেউই শিল্প দূষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন না। তুলবেনই বা কীভাবে? এই এলাকায় বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষই নারায়ণগঞ্জের বাইরে থেকে আসা শ্রমিক।
তবে সিমরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিরূপ পরিণতির আশঙ্কায় তিনি নাম না প্রকাশের অনুরোধ করে বলেন, 'শিল্প বিস্তারের কারণে আমাদের স্কুল দিন দিন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন বায়ু ও শব্দ দূষণের কবলে পড়ছে।'
১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ২৯০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।
সিমেন্ট কারখানাগুলো যে গোগনগরের বায়ুদূষণের জন্য দায়ী, এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুনও একমত।
সিমরাইলে লেড-ব্যাটারি ভাঙার কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে সিসা ভাটা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। অপারেটররা সাধারণত ঘন ঘন জায়গা বদলায় এবং প্রত্যন্ত এলাকায় সিসা ভাটা স্থাপন করে।
'তারা রাতের আঁধারে সিসা তৈরি করে। ওই সময় নির্গমনের উৎস খুঁজে বের করা কঠিন। কোনো খবর পেলেই আমরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাই।'
গত মাসে তারা বেশ কয়েকটি সিসা ব্যাটারি কারখানার ভেঙে দিয়েছেন বলে জানান আবদুল্লাহ আল মামুন।
'নারায়ণগঞ্জের কেন্দ্রে একটি কন্টিনিউয়াস এয়ার মনিটরিং স্টেশন [ক্যামস] আছে। আমরা নিয়মিত বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ করি,' বলেন তিনি।
তবে অধিদপ্তরের সংরক্ষিত একিউআই সূচক বলছে, অনেক সময় নারায়ণগঞ্জ ক্যামস কোনো তথ্য দিতে পারে না।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান মো. শহীদুল্লাহ বলেন, সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা তাদের উৎপাদন ইউনিটগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত করছে। তিনি আরও জানান, সিমেন্ট প্রস্তুতকারকরা ব্যাগ ফিল্টার ও অন্যান্য উন্নত ফিল্টার ব্যবহার করছে।
'তবে একটি সিমেন্ট কারখানাকে শতভাগ পরিবেশবান্ধব করা খুবই চ্যালেঞ্জিং,' বলেন তিনি।
শহীদুল্লাহ বলেন, নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে যখন সিমেন্ট কারখানা গড়ে ওঠে, তখন কারখানাগুলোর আশপাশে কোনো জনবসতি ছিল না। এর পরের তিন দশকে ধীরে ধীরে এসব এলাকায় আবাসিক প্লট গড়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, 'বস্তুত এসব জায়গায় কোনো বাড়ি থাকা উচিত নয়। তাই সরকারের উচিত এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা এবং শিল্প ও মানুষের বসতবাড়ির জন্য আলাদা প্লট ঠিক করে দেওয়া।'