বখতিয়ারী সম্প্রদায়: শত প্রতিকূলতাতেও যাযাবর জীবনকেই সঙ্গী করেছেন যারা!
ইরানের জাগরোস পাহাড়ে বসতি স্থাপনকারী বখতিয়ারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আদি নিবাস ঠিক কোথায় ছিল তা আজও কেউ জানে না। কিন্তু বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে ইরানের পশ্চিম ও দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের এই বিস্তীর্ণ ভূমিতেই তাদের শেকড় প্রোথিত রয়েছে... ঠিক যেমনটা রয়েছে দেশীয় ওক গাছের, যেগুলো তাদের টিকে থাকার একটি প্রধান উৎস। আধুনিক সভ্যতার ডামাডোলের মুখে আজও নিজেদের হাজার বছর পুরনো প্রথা ও রীতিনীতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে এই যাযাবর সম্প্রদায়।
প্রায় এক শতাব্দী আগে এ অঞ্চলে নগরায়ণের ছোঁয়া লাগতে শুরু করে এবং বিগত বছরগুলোতে অধিকাংশ বখতিয়ারী পরিবার এর সাথে মানিয়েও নিয়েছে। অনেকেই ইরানের অভিজাতদের মধ্যে প্রবেশ করে শিক্ষাবিদ, অভিনেতা, রাষ্ট্রদূত ও ক্রীড়াবিদ হয়ে উঠেছে। এমনকি ইরানের জাতীয় ফুটবল লিগেও রয়েছেন একজন বখতিয়ারি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়- গ্রিন বে প্যাকারস'র ডেভিড বখতিয়ারী।
কিন্তু তারপরেও কিছু বখতিয়ারী গোষ্ঠী রয়েই গেছে যারা এখনো পশুপালন ও বার্লি উৎপাদনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে এবং প্রতি মৌসুমে বিভিন্ন চারণভূমিতে ঘুরে বেড়ায়। আর এ কাজগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে করে আসছেন তারা, বলেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর আরব অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজের আল সালেহ। তিনি বলেন, "তারা (বখতিয়ারীদের) এখনো নিজেদের সেসব পুরনো অভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং জীবনধারা বজায় রেখেছে। তারা যদি এভাবে জীবনযাপন না করে তাহলে হয়তো তাদের আর অস্তিত্বই থাকবে না। যারা এখনো ওই অঞ্চলে টিকে আছেন... যদিও সংখ্যাটা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে... তারা নিজস্ব পরিচয় বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।"
একটিমাত্র নামে নিজের পরিচয় দিয়ে বখতিয়ারী রোস্তম বলেন, "আমার বয়স এখন ৪০ বছর। আমি এই জীবনযাপনেই অভ্যস্ত, অন্য কোনোভাবে আমি বেঁচে থাকতে পারবো না। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো, পশু চরানো আর ছাগলের ঘণ্টির শব্দই আমার কাছে আনন্দের। ছেলেবেলা থেকেই আমি এসব কাজ করে আসছি এবং আমার সন্তানদেরও আমি এগুলো (জীবনধারণের পন্থা) শেখাবো।"
বখতিয়ারী সম্প্রদায়ে নারীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা রীতিনীতিগুলো মেনে চলেন এবং পরিবারকে একত্রিত রাখতে সাহায্য করেন। সালেহ বলেন, "তাদের কঠোর জীবনযাপন পদ্ধতির কারণেই নারীদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জড়িত থাকতে হয়। এ সম্প্রদায়ের নারীরা লড়াইয়ে অংশগ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রম করার পাশাপাশি মা ও স্ত্রীর ভূমিকাও পালন করেন। এখানে নারীদেরকে অনেক শক্তিশালী হতে হয়।" আর এ গল্প বানোয়াট কিছু মোটেও নয়, বখতিয়ারীদের পুরো ইতিহাসজুড়ে এ ধরনের ক্ষমতাবান নারী চরিত্র রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বিপ্লবী সামরিক কমান্ডার, সরদার বিবি মরিয়ম বখতিয়ারীর কথা উল্লেখ করা যায়, যিনি ১৯০৯ সালে আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোকে তেহরান দখল করতে সাহায্য করেছিলেন।
'বখতিয়ারী' নামের অর্থ 'সৌভাগ্য বয়ে আনেন যিনি' হলেও, সম্প্রদায়ের নারীদের বর্তমান অবস্থা তা তুলে ধরছে না। বরং প্রায়ই তাদেরকে বাল্যবিবাহ, গৃহ-সহিংসতা ও দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে জর্জরিত হতে হচ্ছে।
আর তাদের দৈনন্দিন জীবনও সুখে কাটছে না। যাযাবর সম্প্রদায়গুলোর অধিকাংশই আধুনিক চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শুষ্ক বাতাস ও ধুলাবালি এবং গবাদি পশুর জন্য পানির অভাবে তারা প্রতি মৌসুমে সমতল থেকে পাহাড়ে চলে আসতে এবং দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করতে বাধ্য হন। প্রচন্ড দাবদাহ ও খরার ফলে সৃষ্ট দাবানল তাদের চারণভূমি পুড়িয়ে ফেলে।
(ছবি কৃতিত্ব: এনায়াত আসাদী। তিনি ইরানের একজন ফটোসাংবাদিক। ২০২০ সালে 'হার্ড ল্যান্ড' নামক একটি প্রকল্পের আওতায় তিনি ইরানের বখতিয়ারি সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। সেখানকার যাযাবর গোষ্ঠীগুলোর সাথে তিনি ২০২০ সালে এক মাস এবং ২০২১ সালের বসন্ত ও গ্রীষ্মে মোট তিন মাস বসবাস করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, বখতিয়ারিদের জীবনধারা, সংস্কৃতি ও তাদের সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরা।
ভিকি হ্যালেট একজন ফ্রিল্যান্স লেখক যিনি এনপিআর-এ নিয়মিত লেখালেখি করে থাকেন।)