ঢাকা ১১০০, তুষখালী ৮৫৬১, খুলনা ৯০০০: পোস্টকোড সংগ্রাহক এক ইফতেখার লস্করের গল্প
মোজাম্মেল হককে ওস্তাদ মানেন লস্কর ইফতেখার হোসেন। ইফতেখারের বয়স এখন ৫৫। ক্লাস ফোরে পড়তেন '৭৬ সালে। বাবা ছিলেন পিডব্লিউডির প্রকৌশলী। অনেক চিঠি আসত বাবার কাছে। সেগুলোর ওপরে থাকা ডাকটিকিট দিয়ে তাঁর সংগ্রহ শুরু।
শান্তিবাগের বাসা গুটিয়ে তেজকুনিপাড়ায় যখন তাঁরা উঠে এলেন বছর দুই পরে, তখন ফার্মগেট হয়ে গেল হাঁটা দূরত্বে। ফার্মগেটে যেখানে বিমানের অফিস তাঁর পাশেই ছিল হাজী সালামের সালাম স্ট্যাম্প সেন্টার। হাতে কিছু পয়সা জমলেই ইফতেখার সালাম সাহেবের দোকানে গিয়ে স্ট্যাম্প কিনে এনে খাতায় লাগিয়ে রাখত। তখন স্ট্যাম্প তাঁর কাছে এক চকমকে দুনিয়া। নানান দেশের নানান কিছুতে ভরা ওই দুনিয়া।
সালাম সাহেব অবশ্য দু-একবার বলেছেন, এমন যেনতেন সংগ্রহ বাড়িয়ে ফায়দা নেই কিছু, যদি সংগ্রহের একটা দিক ঠিক করে না নাও। কিন্তু ইফতেখার বিষয়টি ভালো করে বোঝেননি তখন। শান্তিনগরের সিদ্ধেশ্বরী বুক হাউজেও স্ট্যাম্প পাওয়া যেত, চার আনা করে প্রতিটি। আবার ঢাকা কলেজের কাছে ছিল প্যাসিফিক স্ট্যাম্প সেন্টার। চীন-জাপানের ছোট ছোট সুন্দর সুন্দর স্ট্যাম্প পাওয়া যেত তখন।
শাকিল, রাশেদ ও আরো কয়েকজন কালেক্টর বন্ধু পেলেন ইফতেখার। কিছুকাল পরে মৌচাকেও দি মিডিয়া নামের একটি দোকান হলো যারা স্ট্যাম্প বিক্রি করত। সেখান থেকে দোয়েল পাখির ছবিওয়ালা অনেকগুলো স্ট্যাম্প সংগ্রহ করেছিলেন ইফতেখার।
বলছিলেন, 'দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পোস্টকার্ড ও খামের ওপর ছাপা ছিল শাপলা ফুল, তারপর দোয়েল পাখি, তারপর অনেকদিন ধরে ছিল বাহাদুর শাহ পার্কের ছবি। ১৫, ২০, ২৫, ৩০, ৫০, ৪০,৮০ পয়সা দাম ছিল। পরে আট আনা হয়ে এক টাকায় উঠল। শেষে ২ টাকা আর এখন ৫টাকা লাগে চিঠি পাঠাতে। স্মৃতিসৌধ ছাপা হতো ২ টাকার খামে। আনারসের ছবি ছিল ১৫ পয়সার স্ট্যাম্পে। ধানের শীষ ও গ্যাস ফিল্ড ছিল ২০ পয়সার স্ট্যাম্পে। ৪০ পয়সার স্ট্যাম্পে শের-ই-বাংলা ফজলুল হক, ৫০ পয়সার স্ট্যাম্পে ভ্রাম্যমাণ ডাকঘর এবং ৮০ পয়সার স্ট্যাম্পে ছিল মহাস্থানগড়। ১ টাকার এয়ারমেইল খামে শিল্পী সফিউদ্দিন আহমেদের আঁকা মাছ ধরার জাল ছবিটিও ছিল।'
মোজাম্মেল হকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা
ছিয়াশি সালে শিশু একাডেমিতে স্ট্যাম্পের একটি প্রদর্শনী হলো, তাতে ইফতেখারও অংশ নিয়েছিলেন। ওই একই বছর ইফতেখাররা উঠে গেলেন তাদের শাহজাহানপুরের বাড়িতে।
সাতাশি সালে প্রতিষ্ঠা হলো বাংলাদেশ ফিলাটেলিস্টস অ্যাসোসিয়েশন। ততদিনে ইফতেখার কলেজে উঠে গেছেন, দি মিডিয়ার মোশাররফ ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কও হয়েছে ভালো। মিডিয়ায় সন্ধ্যার পর আড্ডা জমত ফিলাটেলিস্টদের।
সংগ্রাহকদের সংগ্রহ অভিযানের গল্প শুনতে ভালো লাগত ইফতেখারের। মোশাররফ ভাই তাঁকে ফিলাটেলিস্ট অ্যাসোসিয়েশনেও নিয়ে যেতে থাকলেন আর জানাতে থাকলেন, এলোমেলো সংগ্রহ আসলে কোনো গুরুত্ব রাখে না। কোনো নির্দিষ্ট থিমের ওপর যখন একটা দেখানোর মতো ভান্ডার তৈরি হয় তখন সেটার ঐতিহাসিক বা সামাজিক গুরুত্ব তৈরি হয়।
এর মধ্যে '৯২ সালে ডাক বিভাগ আয়োজন করল বাংলা পেক্স নামের ডাকটিকিট, স্মারক ও স্টেশনারি প্রদর্শনী। সেটি দেখেও ইফতেখারের মধ্যে নতুন নতুন ভাবনা সঞ্চারিত হলো। মোজাম্মেল ভাইয়ের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছে মিডিয়ায় যেতে যেতেই। উঁচু দরের সংগ্রাহক হিসাবে তাঁর সুনাম ছিল।
মোজাম্মেল হক তখন নরসিংদীর পলাশে পশুসম্পদ কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত। ঢাকায় বাসা ছিল বাসাবোতে। তিন-চারদিনের ছুটি যখন পেতেন তখন ঢাকায় আসার আগেই ইফতেখারকে খবর পাঠাতেন, রেডি থেকো।
মোজাম্মেল ভাইয়ের পরামর্শেই ততদিনে ইফতেখার দিক খুঁজে পেয়েছেন। ফ্রাঙ্কিং মেশিনকে (মূলত ফ্রাংকিং মেশিনে ছাপ দেওয়া খাম) করেছেন সংগ্রহের থিম। বিশেষ করে বিদেশে চিঠি পাঠাতে গেলে ৫০, ৬০ বা ১০০ টাকার ডাকটিকিট লেগে যেত।
কিন্তু ১ টাকা দামের স্ট্যাম্প দিয়ে ৫০ টাকা পুরাতে গোটা খামেও কুলাত না। তখনই খোঁজ পড়ত ফ্রাঙ্কিং মেশিনের। এ মেশিন দিয়ে প্রয়োজনীয় পরিমাণ টাকার অংক বসানো যেত। শর্ত পূরণ করতে পারলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বা ব্যক্তিকেও মেশিনটি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হতো। এখনকার মোবাইল রিচার্জ যেমন হয়, তেমন ধরনেই ফ্রাঙ্কিং মেশিন রিচার্জ করা যেত।
রেডি থেকোর মানে
মোজাম্মেল ভাই ঢাকায় আসবেন মানে হলো ছুটবেন। ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ বা ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল যাবেন। এক দফায় একটি জেলায় যেতেন সাধারণত। ইফতেখার অনেকবারই তাঁর সঙ্গী হয়েছেন।
সফরগুলোয় মোজাম্মেল ভাইয়ের সঙ্গের হ্যান্ডব্যাগটায় থাকত কেরোসিন তেলের বোতল, ব্রাশ, পিন, স্ট্যাম্প প্যাড, ব্লেড, সিল ইত্যাদি। ইফতেখার বলছিলেন, 'আমরা কোনো একটা জেলায় গিয়ে সেখানকার সদর পোস্ট অফিসে যেতাম প্রথম। মোজাম্মেল ভাই একটা খাম কিনতেন, পোস্টমাস্টারকে অনুরোধ করতেন খামের ওপর "পোস্ট কোড ব্যবহার করুন বা আপনাদের ডাকঘরের পোস্ট কোড নম্বর ব্যবহার করিতে প্রেরককে জানাইয়া দিন অথবা আপনার পোস্টকোড নম্বর আত্মীয়-স্বজনকে জানাইয়া দিন" লেখা সিলের ছাপ মেরে দিতে।
'তারপর খামের ওপর নিজের পলাশের ঠিকানা লিখে একটা চিঠি পোস্ট করে দিতেন। এতে পোস্ট কোড ক্যাম্পেইন বিষয়ক একটি খাম তাঁর ভান্ডারে জমা হতো।
'আশপাশের থানা পোস্ট অফিস, সাব পোস্ট অফিসে গিয়েও আমরা একইভাবে চিঠি পোস্ট করতাম। একদিনে দু-তিনটার বেশি পারা যেত না। একে তো যাতায়াত সহজ ছিল না তখন, তাছাড়া পোস্টমাস্টারকে কনভিন্স করতেও সময় লাগত।
'কোনো কোনো পোস্ট অফিসে সিলটি দীর্ঘদিনের অব্যবহারে দীনহীন হয়ে থাকত। তখন মোজাম্মেল ভাই সেটির ধুলো ঝেড়ে, পিন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ময়লা বের করে, কেরোসিন তেল মেখে চকচকে করতেন, তারপর তা প্যাডে চেপে ধরে ঠিকমতো কালি লাগিয়ে খামের ওপর বসাতেন।
'অনেক পোস্ট অফিসে এই সিলটি থাকতও না। তখন মাস্টারকে দিয়ে মোজাম্মেল ভাই হাতে লিখিয়ে নিতেন—"এখানে পোস্ট কোড সিল নাই, কোড নং ৪২০৫"। নিচে পোস্টমাস্টারের স্বাক্ষর থাকত।
'রাজবাড়ি গোয়ালন্দ উপজেলা পোস্ট অফিসেই পোস্ট কোড নম্বর সংবলিত সিল ছিল না, তখন পোস্ট কোড-৭৭১০ লিখে মাস্টার সই দিয়ে দেন।
'এটা সাতাশি সালের ঘটনা। তখন পর্যন্ত ১ টাকা ছিল ডাকমাশুল। গোলাকার যে সিলটি দিয়ে স্ট্যাম্পটির পুনরায় ব্যবহারযোগ্যতা বাতিল করা হতো তাতে পাঠানোর তারিখ, পোস্ট অফিসের স্ট্যাটাস আর স্থানের নাম উল্লেখ থাকত।
'একবার খুব ভিন্ন একটি সিল মিলল, সেটা নব্বই সালে। নরসিংদী জেলার সান্তানপাড়া ইডিএসওকে (এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল সাব পোস্ট অফিস) দেখানো হয়েছিল গাজীপুর জেলায়। পরে ভুল সংশোধন করা হলে খামের ওপর সিল পড়ত এই বলে যে, "আপনার পোস্ট কোড নম্বর পরিবর্তিত হইয়াছে, ১৭২২-এর পরিবর্তে ১৬১৪ লিখুন"।
'প্রথম দুটি সংখ্যা দিয়ে বোঝা গেল গাজীপুর জেলার পোস্ট কোড শুরু হয় ১৭ দিয়ে আর নরসিংদীর ১৬ দিয়ে। এভাবে অঞ্চলভিত্তিক, জেলাভিত্তিক, থানা বা উপজেলা ভিত্তিককোড বরাদ্দ হয়েছে। জুন ২০০৬-এর হিসাব মতে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ মোটমাট ১৩৫৯টি পোস্ট কোড বরাদ্দ করেছে।'
পোস্ট কোডের ইতিবৃত্ত
মোজাম্মেল হকের লেখা এক নিবন্ধে পাওয়া যাচ্ছে, ডাকবিভাগ কর্তৃক অনুমোদিত বিশেষ কোনো সংখ্যা বা প্রতীক দ্বারা কোনো ডাকঘরকে চিহ্নিত করার পদ্ধতিকে পোস্ট কোড বলা হয়। সময়কে সংক্ষিপ্ত করার জন্য আধুনিক ডাক ব্যবস্থায় পোস্ট কোডের ব্যবহার একটি উন্নততর পদ্ধতি। এর মাধ্যমে ডাক বাছাই ও চলাচল সহজ হয়, ঠিকানাকে সংক্ষিপ্ত করা যায় এবং পত্র প্রেরকের অনেক সময় বাঁচে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা বা অক্ষর দিয়ে একটি দেশের ডাকঘরগুলোকে বিন্যস্ত করা হয়। দেশের বিভিন্ন ডাকঘরের জন্য কোনো বিশেষ সংখ্যা বা অক্ষর অথবা দুটি মিলিয়েই পোস্টকোড তৈরি হতে পারে।
ভারতবর্ষে ডাকটিকিটের প্রচলন ঘটে ১৮৫৪ সালে। এক পয়সা দাম দিয়ে তখন ভারতের যেকোনো জায়গায় পোস্টকার্ড বা খামে ভরে চিঠি পাঠানো যেত। পরের চার বছরে ১৮টি ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়। তারপর রানী ভিক্টোরিয়ার আমলে (১৮৫৮- ১৮৮২) ১৯টি, রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের (১৮৮২-১৯১১) আমলে ২৪টি, রাজা পঞ্চম জর্জের (১৯১১-১৯৩৫) আমলে ৬৭টি এবং রাজা ষষ্ঠ জর্জের (১৯৩৫-১৯৪৭) আমলে ৫২টি মিলিয়ে মোট ১৮০টি ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়।
প্রথম পোস্টকোডের ব্যবহার লক্ষ করা যায় ১৮৭০ সালে। তবে তখন পর্যন্ত গোটা ভারতে ডাকঘরের সংখ্যা ২ হাজারের বেশি ছিল না। ডাকঘরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পোস্ট কোড ব্যবহারের পদ্ধতি জটিল হয়ে ওঠে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোডের পরিবর্তে ডাকঘরের নাম ব্যবহৃত হতে থাকে। তবে ভিক্টোরিয়ার আমলের অগোছালো পোস্টকোডকেই আধুনিক পোস্টকোড পদ্ধতির জনক বলা যেতে পারে।
যুদ্ধকালীন সময়ে অথবা জরুরি অবস্থায় কোনো কোনো ডাকঘরের নাম, অবস্থান ইত্যাদির ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষার জন্য বিশেষ সংখ্যা প্রদান করা হয়—যেমন ব্রিটিশ ফিল্ড মেইল-৪০, অ্যাডভান্সড বেইজড পোস্ট অফিস-৬ ইত্যাদি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও মুজিবনগর সরকার বেশ কয়েকটি ফিল্ড পোস্ট অফিস চালু করেছিল। ১৯৭১ সালের জুনে বিমান মল্লিক আটটি ডাকটিকিট ডিজাইন করেন এবং মুজিব নগর সরকারের কাছে পাঠান। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য সেগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল ১৪টি ডাকটিকিটের একটি সেট প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশে পোস্ট কোডের প্রচলন শুরু হয় ১৯৮৬ সালে (তবে সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে দুই ডিজিটের এরিয়া কোড চালু ছিল বাংলাদেশে)। দেশের সব জিপিও, প্রধান ডাকঘর এবং ডেলিভারি সাব পোস্ট অফিসগুলোকে চার ডিজিটের পোস্ট কোড প্রদান করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ৬৪টি জেলাকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে এবং প্রতিটি অঞ্চলের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক পোস্ট কোড বরাদ্দ করা হয়েছে। যেমন ঢাকা অঞ্চল: ১০০০ – ২৯৯৯; চট্টগ্রাম অঞ্চল : ৩০০০-৪৯৯৯; রাজশাহী অঞ্চল: ৫০০০-৬৯৯৯; খুলনা অঞ্চল: ৭০০০-৯৯৯৯। এক্ষেত্রে শুধু জেনারেল পোস্ট অফিস বা জিপিওর জন্য বরাদ্দ পোস্ট কোড একটি সংখ্যা দিয়ে শুরু হয়ে পরে তিনটি শূন্য বসে। যেমন ঢাকা জিপিও-১০০০; খুলনা জিপিও-৯০০০।
এরপর জেলা সদরের হেড অফিস, মেট্রোপলিটন এলাকার হেড অফিস এবং সমতুল্য হেড অফিসগুলোর জন্য প্রথমে দুটি সংখ্যা পরে দুটি শূন্য। যেমন ঢাকা সদর হেড অফিস-১১০০, ঢাকা মেট্রোপলিটন-১২০০, নারায়ণগঞ্জ হেড অফিস-১৪০০, চট্টগ্রাম বন্দর হেড অফিস-৪১০০।
এরপর আসে জেলার পোস্ট কোড, নরসিংদী সদরের জন্য যেমন ১৬০০। আর একই জেলার অধীন সকল উপজেলা বা থানা পোস্ট অফিসের জন্য শূন্যের আগে তিনটি সংখ্যা বরাদ্দ করা হয়। যেমন নরসিংদীর পলাশ উপজেলার জন্য ১৬১০ আবার রায়পুরের জন্য ১৬৩০।
এরপর চতুর্থ ডিজিটটি বরাদ্দ করা হয়েছে সাব পোস্ট অফিসের জন্য যেমন ইউরিয়া ফ্যাক্টরি সাব অফিসের জন্য ১৬১১ বা চরসিন্দুর এক্সট্রা ডিভিশনাল সাব অফিসের (ইডিএসও) জন্য ১৬১২।
ইফতেখার বলছিলেন, 'এছাড়াও কিছু পোস্ট অফিস আছে যেগুলোকে অবিলিকারি সাব অফিস বলা হয়। এগুলো থেকে চিঠি বিলি করা হয় না। লোকে বরং এখানে এসে চিঠি নিয়ে ও দিয়ে যায়। সারা দেশে এমন পোস্ট অফিসের সংখ্যা কয়েক হাজার হয়ে যেতে পারে।
'এসব পোস্ট অফিস স্থানীয় কোনো প্রভাবশালী পরিবার বা সামাজিক সংগঠন নিজেদের দায়িত্বে পরিচালনা করত। এখানে পোস্টমাস্টার ও একজন পিয়ন থাকত। সাধারণত স্থানীয়ভাবেই এদের সম্মানী বা ভাতা প্রদান করা হতো। এখন অবশ্য ডাক বিভাগ তাঁদের সম্মানী প্রদান করে থাকে।
'ঝালকাঠিতে আমাদের পরিবারও এমন একটি পোস্ট অফিস পরিচালনা করত। এর পরিচিতি ছিল লাটিম শাহের পোস্ট অফিস নামে। এমনও দেখছি, কোনো একজন বাজার বা হাটের দিন নির্দিষ্ট জায়গায় চিঠিগুলো নিয়ে বসত আর ডেকে ডেকে বলত, ও ছমির মিয়া তোমার ভাই চিঠি দিছে, নিয়া যাও ইত্যাদি। এটা একটা সমাজসেবামূলক কার্যক্রম ছিল আর সম্মানেরও ব্যাপার ছিল।'
'পোস্ট কোড ছাড়াও পদ্ধতিটিকে জিপ কোড আর পিনকোডও বলা হয়। ভারতেই যেমন বলা হয় পিন কোড। আমাদের এখানে ২০০২ সালে ৬ ডিজিটের পোস্ট কোড চালু করা হয়েছিল সম্ভবত অবিলিকারী ডাকঘরগুলোকে কোড বরাদ্দ করতেই। তবে পরে আবার ৪ ডিজিটই অব্যাহত রাখা হয়েছে।
'ডাক বিভাগ পোস্ট কোডের ব্যবহার ত্বরান্বিত করতে বিভিন্ন সময় পুস্তিকা প্রকাশ করেছে বাংলাতে তো বটেই ইংরেজিতেও। এছাড়া প্রায় সব ডাকঘরেই পোস্ট কোড ব্যবহার উৎসাহিত করার রাবার স্ট্যাম্প ছিল। প্রায় সব চিঠির খামের ওপর "পোস্ট কোড ব্যবহার করুন" ধরনের প্রচার বাক্যের সিল মারা হতো।"
পোস্ট কোড সংগ্রহ অভিযান
দুটি ছিল মূল চ্যালেঞ্জ পোস্ট কোড সংগ্রহ অভিযানের—ডাকঘরের সংখ্যাবৃদ্ধি ও বাক্য বৈচিত্র্য। সব ডাকঘর একই প্রচার বাক্য ব্যবহার করত না। যেমন ইফতেখারের সংগ্রহে থাকা একটি খামের ওপর 'আপনার ডাকঘরের পোস্ট কোড নম্বর মানিকগঞ্জ ১৮৪০ ব্যবহার করিতে প্রেরককে জানাইয়া দিন' লেখা সিল দেখতে পেলাম। এই প্রচারবাক্যে এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল আছে। প্রাপক নিজে যেমন তাঁর এলাকার পোস্ট কোড জানলেন আবার প্রেরককে তা জানানোর তাগিদও পেলেন।
আবার রমনা শাখার (ঢাকা) সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপককে লেখা একটি চিঠির খামে ইংরেজিতে শুধু এটুকু লেখা, পোস্ট কোড নং ১৩১৩। এখানে কোনো আহ্বান নেই, কিন্তু রমনা অঞ্চলের পোস্ট কোডটি অবগত করা হয়েছে।
ইফতেখার দেখেছেন, মোজাম্মেল ভাই দূরবর্তী এলাকায় (টেকনাফ, ঠাকুরগাঁও বা নওগাঁ) থাকা তাঁর আত্মীয় স্বজন বা বন্ধুবান্ধব অথবা সহকর্মীকে খামে ভরে নিজের ঠিকানা লেখা আরো খাম পাঠাতেন। অনুরোধ করতেন, উক্ত ঠিকানায় পোস্ট কোড সিল মারা একটি চিঠি যেন পাঠায়। অথবা কেউ যদি ভেড়ামারা বা বাউফল বা নাইক্ষংছড়ি বেড়াতে যেত, তাকে সেখান থেকে একটি চিঠি পাঠানোর জন্য খাম কিনে দিতেন।
আরেকটি উপায় ছিল। সরকারি কোনো কর্মকর্তা যার কাছে অফিস প্রয়োজনেই অনেক চিঠি আসে, তার কাছ থেকে খাম জোগাড় করা সপ্তাহ বা মাসভিত্তিতে। এভাবেই মোজাম্মেল ভাইয়ের সংগ্রহ বড় হয়েছিল।
ওস্তাদের ভান্ডার শিষ্যের কাছে
মোজাম্মেল ভাই আমেরিকায় চলে গেলেন চাকুরির মেয়াদ ফুরালে। কিন্তু তাঁর পোস্টকোড ভান্ডার রয়ে গেল দেশেই। ইফতেখারকে আগেও কিছু পোস্টকোড খাম উপহার দিয়েছিলেন মোজাম্মেল ভাই। ফ্রাঙ্কিং মেশিনের সঙ্গে সেগুলোর সংগ্রহও কিছু কিছু বাড়াচ্ছিলেন ইফতেখার।
পরে মোজাম্মেল ভাই যখন ২০১৫ সালে দেশে এলেন, ইফতেখার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। ড্রইং টেবিলের নিচের তাকে পোস্ট কোড কালেকশন অ্যালবামটি রাখা ছিল।
ইফতেখার ওস্তাদের সংগ্রহ এক নজরে দেখার সুযোগ পেয়ে গেলেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন, মোজাম্মেল ভাই আপনি একদিন আমার বাসায় আসুন। আমার সংগ্রহ আপনাকে দেখাব। আপনার থেকে যা পেয়েছি সেগুলো আমি আরো সমৃদ্ধ করেছি। মোজাম্মেল ভাই বললেন, আমার শরীরের যা অবস্থা খুব বেশি মুভমেন্টের ধকল নিতে পারি না। তুমি নিয়ে এসে আমাকে দেখিয়ে যেও।
সেমতো ইফতেখার তাঁর সংগ্রহ নিয়ে গেলেন। মোজাম্মেল ভাই শিষ্যের আন্তরিকতা দেখে খুশি হলেন। তারপর আসল কথাটি পাড়লেন ইফতেখার, আপনার পোস্ট কোড অ্যালবাম আমাকে দিয়ে যান, আমি যত্নে রাখব।
মোজাম্মেল ভাই বিশ্বাস করেছিলেন ইফতেখারকে। পুরো অ্যালবামই দিয়ে দিয়েছিলেন। সবকিছু বাসায় এনে এবং আগের কিছু সংগ্রহ যোগ করে ১৮০টি পোস্ট কোড কালেকশনের একটি সেট দাঁড় করালেন ইফতেখার যা এখন অনেক সংগ্রাহকেরই ঈর্ষার কারণ। তবে সেটটিতে সত্তরের দশক ও আশির দশকের এরিয়া কোড কালেকশন রাখেননি ইফতেখার। সেটটির শিরোনাম দিয়েছেন, পোস্ট কোড সিস্টেম অ্যান্ড স্লোগান অভ বাংলাদেশ ১৯৮৬-১৯৯২। প্রথম পৃষ্ঠায় পোস্টকোডের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন, পরের পৃষ্ঠায় বলেছেন, অঞ্চলভেদে কীভাবে পোস্টকোডের ব্যবহার ভিন্ন হয়।
তৃতীয় পৃষ্ঠা থেকে সংগ্রহ শুরু। প্রতিটি সংগ্রহের (খাম) নিচে প্রয়োজনীয় বিবরণ দিয়েছেন। প্রথমটিতে যেমন—মেহেরপুর হেড অফিস ৭১০০ থেকে বরিশাল হেড অফিস ৮২০০ (রুট)। ডাকমাশুল ১ টাকা (৫০প.+৫০প.)। সবশেষে আছে ব্যবহারের তারিখ: ২৭ মার্চ ১৯৯০।
ইফতেখারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, পোস্ট বক্স নং কি পোস্ট কোডের মতোই কিছু?
ইফতেখার: হাঁ এটা পোস্ট কোডের মতোই ব্যাপার, তবে অনেকটা ব্যক্তিগত পর্যায়ের। পোস্ট বক্স নং হলো ব্যাংকের লকারের মতো। ধরা যাক, দৈনিক ইত্তেফাক কোনো কুইজ প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছে। অনেক লোক তাতে অংশগ্রহণ করছে। প্রচুর চিঠি আসছে। ইত্তেফাক কর্তৃপক্ষ জিপিও থেকে নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে একটি পোস্ট বক্স নং নিল যা কুইজে অংশগ্রহণকারীদের চিঠি রাখার জন্য নির্ধারিত। ওই নম্বরের বক্স খোলার সুযোগ কেবল ইত্তেফাক কর্তৃপক্ষেরই থাকে। এমন বক্স আগের দিনে সাহিত্যিকরাও (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বা নিমাই ভট্টাচার্য) ব্যবহার করতেন। তাতে তাদের ঠিকানা গোপন থাকত আবার চিঠি পেতেও কোনো অসুবিধা হতো না।
প্রশ্ন: আপনার পোস্ট কোড সংগ্রহ নিয়ে কি আপনি গর্বিত?
ইফতেখার: ফ্রাঙ্কিং মেশিনের সংগ্রহ নিয়েই আমার উৎসাহ বেশি। এতে শ্রম, অর্থ ও সময় ব্যয় হয়েছে অনেক বেশি। তবে পোস্ট কোড সংগ্রহটা ব্যতিক্রমী সন্দেহ নেই।