রিপন মিয়া: সাদাসিধে গ্রামীণ জীবন আর ছন্দময় ‘ক্রিঞ্জ' ভিডিওতে যেভাবে সবার মন জয় করছেন
গত বছরের সরকার পতনের পর তখনও নানা রকমের দাবি নিয়ে মানুষ রাস্তায়। অটোপাশের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিল এইচএসসি পরীক্ষার্থীরাও। তাদের উদ্দেশ্যে ফেসবুকে একটি ভিডিও ছাড়েন নেত্রকোনার রিপন মিয়া।
পেশায় কাঠমিস্ত্রি রিপন মিয়া ভিডিওতে বলেন, 'যারা এইচএসসি পরীক্ষা দিতে চাইতাছো না, তারা আমার কাছে চলে আসো কাঠমিস্ত্রির কাম হিকাইদিতাম, দৈনিক ৫০০ টাকা রোজ পাইবা, নেট এন্ড ক্লিয়ার, হাহাহা…. এটাই বাস্তব'।
শিক্ষার্থীদের সেই সময়ের অযৌক্তিক এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রিপন মিয়ার কথা যথেষ্ট যুক্তিসংগত মনে হয়েছিল। সরকার শেষ পর্যন্ত বিশৃঙ্খলা এড়াতে শিক্ষার্থীদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে।
গত কয়েক মাসে রিপন মিয়া তার বাস্তবধর্মী ও জীবনমুখী কথাবার্তার কারণে নেটিজেনদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।
কাঠমিস্ত্রির কাজ করতে করতে গ্রীষ্মের তপ্ত রোদে ঘাম ঝরানো, উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি, সাইকেল চালিয়ে কাজে যাওয়া, নিজের রান্না করা খাবার পরিবেশন কিংবা মজার ছলে ইংরেজি সংবাদপত্র পড়ার ভান করার মতো সাধারণ দৃশ্যগুলোই তার ভিডিওর মূল বিষয়বস্তু।
কোনো জাঁকজমক কিংবা 'স্পেশাল অ্যাফেক্ট' নেই তার ভিডিও ও রিলসে। কিন্তু তারপরও এ সরল জীবনচিত্র দর্শকদের মন জয় করেছে। গত দুই মাসে তার ভিডিওগুলো ২ কোটি বারেরও বেশি দেখা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রয়েছে তার এক মিলিয়নেরও বেশি অনুসারী। বেড়েই চলেছে এ সংখ্যা ।
এর কারণ কী? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন।
উমেদ ইবনে মুস্তাফা, একটি পোস্টে এই অনুভূতি তুলে ধরে লেখেন, 'কখনো কখনো মনে হয়, জীবন যদি রিপন মিয়ার মতো সহজ সরল হতো! আমি চট্টগ্রাম যেতে চাই, চায়ের দোকানে এক কাপ চা খেতে চাই, একটা খাবার খেয়ে ময়মনসিংহের মুকতাগাছায় ফিরে আসতে চাই—শুধু যা ইচ্ছে তাই করতে চাই! তার জীবনে কোনো আড়ম্বর নেই, তবু সেই জীবনটাই মনে হয় আমরা গোপনে কামনা করি। তিনি নিজের শর্তে বাঁচেন, যা খুশি তাই করেন!'
প্রায় ৪০ হাজার ব্যবহারকারী এই মন্তব্যে লাইক দিয়েছেন।
রিপনের সরল গ্রামীণ জীবনের প্রতি নেটিজেনদের এই মুগ্ধতা দীর্ঘদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন রূপে ও মাত্রায় দেখা গেছে।
রিপন মিয়ার গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় তার কৈশোরজীবনে শুরু, হৃদয়ভাঙার অভিজ্ঞতা তাকে সৃজনশীলতার পথে নিয়ে যায়। তখন এমন কিছু ভিডিও তৈরি শুরু করেন যা অনেকেই হয়ত ওই সময় 'ক্রিঞ্জ ভিডিও' বলে আখ্যা দেন।
শুরুতে ইন্টারনেটে কিছুটা জনপ্রিয়তা পেলেও তা কাজে লাগাতে পারেননি তিনি। ফিরে যান আবারও সাধারণ কাঠমিস্ত্রির জীবনে।
তবে কিছুদিন পর তিনি আবার ফিরে আসেন, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে একজন জনপ্রিয় গ্রামীণ কনটেন্ট নির্মাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
এই যাত্রায় রিপন মিয়া তার ব্যক্তিত্ব ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এনেছেন । নিজেকে উন্নত করার জন্য তার আন্তরিক প্রচেষ্টা স্পষ্ট।
শুরু কীভাবে?
অসচ্ছল পরিবারের সন্তান রিপন মিয়া তৃতীয় শ্রেণির পর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। ২০১৬ সালে, কৈশোর বয়সে একটি প্রেমের সম্পর্ক ভাঙে তার।
'অনেকেই ভালোবাসা হারিয়ে আত্মহত্যা করে বা অদ্ভুত কাজ করে। আমি সেটা করিনি, আমি ভিডিও বানানো শুরু করি,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন রিপন মিয়া।
রিপন মিয়ার ভিডিওগুলো মূলত ছন্দে ছন্দে বলা এক-দুই লাইনের কবিতা, যদিও এর আগে কখনও কবিতা চর্চা করেননি তিনি।
প্রথম ভিডিওটিতে তিনি তার প্রিয়জনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'বন্ধু তিনি একা হলে আমায় দিও ডাক, তোমার সঙ্গে গল্প করব আমি সারারাত'।
ভিডিওটি শেষ হয় তার স্বভাবসুলভ হাসি এবং বিখ্যাত ক্যাচ ফ্রেজ 'আই লাভ ইউ' বলে।
ভাঙা সম্পর্কের বেদনা সামলানোর এটাই ছিল তার এক ধরনের সৃজনশীল বহিঃপ্রকাশ।
রিপনের এই ছোট্ট ছন্দময় বাক্যটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, উৎসাহ পেয়ে আরও এমন ভিডিও বানাতে শুরু করেন তিনি।
তিনি বলেন, 'আমি বলতাম, 'হাই ফ্রেন্ডস, আমি রিপন ভিডিও। তারপর ছন্দ করতাম, যেমন- বন্ধু তুমি পাখি হলে, আমি হব নীড়, তোমার আমার প্রেম দেখতে লেগে যাবে ভিড়'।
তার পুরোনো কিছু ভিডিওতে হয়ত এখনো কিছু আপত্তিকর বা অশালীন শব্দ চোখে পড়তে পারে। তবে সময়ের সঙ্গে তিনি নিজেকে পরিবর্তন করেছেন এবং আরও পরিণত হয়েছেন, যা তাকে আরও বেশি দর্শকের মনোযোগ এনে দিয়েছে।
'জরাজীর্ণ বাড়ির ভেতরে থাকি'
ওই সময়ের অন্যান্য কনটেন্ট ক্রিয়েটর যেমন- হিরো আলম, অপু ভাই, এবং প্রিন্স মামুনেরা, তাদের খ্যাতি থেকে বেশ ভালো টাকা পয়সা উপার্জন করেছেন। তবে রিপন, তাদের মতো তার ভাইরাল কনটেন্ট থেকে অর্থকড়ি আয় করতে পারেননি। কারণ একের পর এক হ্যাক হয়েছে তার অনেকগুলো চ্যানেলে।
২০১৯ সালের দিকে ভিডিও বানানোই ছেড়ে দেবেন বলে ভেবেছিলেন। তখন পুরো সময় কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন এবং দারিদ্র্য ছিল তার সঙ্গী।
'এক সময় তো ভিডিও বানানোর জন্য ফোনও ছিল না,' বলেন রিপন।
তিনি আরও বলেন, 'লোকেরা আমার কনটেন্ট দিয়ে প্রচুর টাকা বানিয়েছে, কিন্তু আমি এক টাকাও উপার্জন করতে পারলাম না। আমি এখনও একটি জরাজীর্ণ বাড়িতেই থাকি, বাড়ির ভেতর দিয়ে কুকুর হাঁটাচলা করে'।
পরে এক মিডিয়া ম্যানেজারের সাথে পরিচয় হয় রিপন মিয়ার, যিনি তাকে আবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেন।
দুজন মিলে এখন পঞ্চাশ-পঞ্চাশ ভাগে লাভ ভাগাভাগি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো পরিচালনা করছেন।
নাম প্রকাশ করতে না চাওয়া ওই ম্যানেজার টিবিএসকে বলেন, 'রিপন ভাই খুবই সহজ সরল মানুষ। মানুষ তার কাছে এসেছিল, কথা বলেছিল, আর কোনোভাবে তার পেজগুলো হ্যাক করে ফেলেছিল, যেগুলোতে ছিল মিলিয়নেরও বেশি অনুসারী'।
রিপন ২.০
তার এখনকার ভিডিওগুলোতে রোমান্টিক ছন্দ কম দেখা যাবে। বরং এখন তিনি যেমন আছেন, ঠিক তেমনভাবেই কাজ করেন, খাওয়া-দাওয়া করেন এবং এদিক সেদিক ঘুরেন—কিছুই তার অভিনয় নয়। তিনি এখন পুরোদমে একজন কাঠমিস্ত্রি এবং সেই কাজের ভিডিওই তৈরি করেন।
এক ফেসবুক রিল ভিডিওতে রিপন বলেন, আমি গরমে কাজ করছি। যারা পড়াশোনা করেছে কিন্তু চাকরি পায় না, তারা আমার সাথে যোগাযোগ করুক। আমি তাদের ব্যবসা শিখিয়ে দেব, আর তারা দিনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা উপার্জন করতে পারবে। ভিডিও শেষ করেন তার পরিচিত হাসি আর 'এটাই বাস্তব' বলে।
আরেকটি ভিডিওতে তাকে গরমে রান্না করতে দেখা যায়। আঞ্চলিক ভাষায় তিনি বলেন, আমাদের মা-বোনেরা এমন কষ্টে রান্না করেন, কিন্তু আমরা তাদের কষ্ট বুঝতে চাই না। একটি ভিডিওতে তাকে চশমা পরে সাইকেল চালিয়ে যৌতুক বিরোধী ক্যাম্পেইন চালাতেও দেখা যায়।
ছন্দে ছন্দে বলাটা পুরোপুরি ত্যাগ করেননি এখনও। কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার—তার মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন লক্ষণীয়।
ম্যানেজারের পরামর্শে সমসাময়িক বিষয় নিয়েও এখন ভিডিও বানান তিনি। যেমন, গত বছরের জুন মাসে পিএসসি ড্রাইভার আবেদ আলীর অবৈধ সম্পদের খবর দেশজুড়ে আলোচনা তৈরি করে। রিপন এনিয়ে একটি ভিডিওতে বলেন, 'আবেদ আলীর মতো আমিও ড্রাইভার হতে চাই, কিন্তু তোমার মনের, আই লাভ ইউ'।
যখন এক ইসলামি বক্তা 'মেসেজ ড্রপ' শব্দটি অদ্ভুতভাবে ব্যবহার করে ভাইরাল হন, রিপন তাকে অনুসরণ করে তার চিরচেনা হাসি দিয়ে বলেন, 'সকাল সকাল তোমাকে একটা মেসেজ ড্রপ করতে চাই— আই লাভ ইউ'।
রিপন মিয়া এখন বেশ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেল পরিচালনা করেন। ফেসবুকে তার বর্তমানে পেজ দুটি—'খাদক রিপন' এবং 'রিপন মিয়া'। ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রামে তার এক মিলিয়নেরও বেশি অনুসারী হয়েছে।
কিছুদিন হলো, রিপন ও তার ম্যানেজার চ্যানেলগুলো থেকে আয় করা শুরু করতে পেরেছেন, যা আগে কিছু সমস্যার কারণে সম্ভব হয়নি।
খ্যাতি এবং কিছু টাকা আসলেও, রিপন এখনও তার গ্রামীণ কাঠমিস্ত্রির জীবনকেই বেশি উপভোগ করেন। তার ভাষ্যে, আমরা গ্রামের মানুষ, কাজ ছাড়া থাকতে পারি না।
সাধারণ জীবনযাপন আর নিজের মনের খেয়ালে এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ানোই রিপন মিয়ার পছন্দ। তার ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, শহরের সুউচ্চ অট্টালিকা দেখে তিনি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, যেন প্রথমবার এই দৃশ্য দেখছেন। তার এই সরল, গ্রামীণ জীবনযাপনই দর্শকের আনন্দের খোরাক।
মূল লেখা থেকে অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন