তিন ঘণ্টার সিনেমা ২০ মিনিটে! বিদেশি সিনেমা বাংলায়
বন্ধুদের আড্ডায় কথার ঝড় উঠেছে- কে কয়টা সিনেমা দেখেছে! একজন বলে উঠলো মাত্র একমাসে তিনি ৯০টি কোরিয়ান সিনেমা দেখেছেন। বাকিরা বেশ অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তারপর আবার গল্প শুরু হলো। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন, সুমাইয়া জাহান তামান্না। তামান্না তার বন্ধুদের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে দেখা কোরিয়ান ড্রামা 'আইস ফ্যান্টাসি' নিয়ে আলাপ জুড়িয়ে দিলো। ড্রামার কাহিনী ও মূল চরিত্রগুলোকে নিয়ে অকপটে আড্ডা চলতে থাকলো। হরহামেশাই তাদের বন্ধুদের দলে সিনেমা ও সিরিজ কেন্দ্রিক আলাপ-আলোচনা চলে। ক্লাস নাইনে পড়ুয়া এই শিক্ষার্থীরা একেকজন সিনেমাবোদ্ধা না হলেও- এই আলোচনায় হারতে রাজি নন কেউই। শখ ও ভালোলাগার জায়গা থেকে অবসর সময়ে তারা সিনেমা, সিরিজ দেখে থাকেন। কিন্তু সেগুলো সিনেমা বা সিরিজের মূল ভাষায় নয়, দেখে থাকেন বাংলা ভাষায়।
এই বিষয়ে তামান্না ও তার বন্ধুদের মত হলো, ক্লাস, কোচিং ও অন্যান্য কাজের ভিড়ে এতো দীর্ঘ সময় ধরে তাদের পক্ষে সিনেমা দেখা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে কী ভালোলাগার সিনেমা, সিরিজ দেখা বন্ধ থাকবে? না, তারা তাদের স্বল্প সময়ের মধ্যেই সিনেমা ও সিরিজের মূল কাহিনী জানতে ইউটিউবে থাকা বাংলা ব্যাখ্যায় ভিডিও দেখে থাকেন। ইউটিউবে কয়েকটি চ্যানেল রয়েছে যেগুলো হলিউড, বলিউড, কোরিয়ান, জাপানিজ, মালালায়াম থেকে সবরকম ভাষার সিনেমা বা সিরিজের মূল কাহিনী বাংলায় বর্ণনা করে থাকে। অনেকেই আছেন কোনো সিনেমার কাহিনী জানতে আগ্রহী- কিন্তু সিনেমা দেখে ৩ ঘণ্টা ব্যয় করতে চান না বা সে সময়টুকু তাদের ব্যস্ত জীবনে হয়ে উঠে না। তখন তারা ইউটিউবের এই চ্যানেলগুলো থেকে সিনেমার কাহিনীর সারসংক্ষেপ ভিডিও দেখে তা সেরে নেন। ইংরেজী, হিন্দি, কোরিয়ান, জাপানিজ, তুর্কি ভাষা না জানা মানুষদের জন্যে এই চ্যানেলগুলো সিনেমা দেখার প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। চ্যানেলগুলোর সাবস্ত্রিপশন ও ভিউয়ের সংখ্যা দেখে তা সহজেই বোঝা যায়।
নেই বাড়তি ঝামেলা
সিনেমা ও সিরিজ দেখার জন্যে কয়েকটি স্ট্রিমিং সাইট রয়েছে- যেগুলোর বেশিরভাগই সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে দেখতে হয়। কিছু স্ট্রিমিং সাইটে ফ্রি তে দেখার সুযোগ মিললে, কীভাবে সেগুলো ব্যবহার করতে হয় তা অনেকের জানা নেই। তাই সিনেমা দেখার সহজ মাধ্যম হিসেবে তরুণদের কাছে ইউটিউব চ্যালেনগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। সিনেমার কাহিনী বাংলায় বর্ণনা করা হয়, ফলে সাবটাইটেল খুঁজে পাওয়া নিয়ে ঝক্কি পোহাতে হয় না। একদিকে চ্যানেলগুলো থাকায় সিনেমাপ্রেমীরা উপকৃত হচ্ছে, তাদের সময় বেঁচে যাচ্ছে। অন্যদিকে চ্যানেলের এডমিন ও পরিচালনাকারীরা সিনেমা, সিরিজ দেখাকে সহজ করে দিয়ে এখান থেকে সন্তোষজনক অর্থ উপার্জন করছে। ভিডিওতে ভিউয়ের সংখ্যা ও চ্যানেলের সাবস্ক্রিপশনের ওপর অর্থের পরিমাণ নির্ভর করে।
'সিনেমহল' (Cinemohol) নামের ইউটিউব চ্যানেলটি কোরিয়ান, চায়নিজ, জাপানিজ, ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় নির্মিত সিনেমা ও সিরিজকে কাটছাঁট করে মূল অংশের ভিডিও সমেত বাংলায় কাহিনী বর্ণনা করে থাকে। সিনেমার সংক্ষিপ্ত বাংলা বিবরণ সংবলিত প্রতিটি ভিডিওতে প্রায় ১০ লাখের ওপর ভিউ হয়েছে। কোনটিতে সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৪০-৫০ লাখের কোটায়। ৯ মাস আগে খোলা চ্যানেলটিতে এযাবৎকালে মোট ৪২টি ভিডিও আপলোড করা হয়েছে। প্রথমদিকে আপলোডকৃত কয়েকটি ভিডিওতে ভিউয়ের সংখ্যা কম থাকলেও চ্যানেলের সাবস্ক্রিপশন বাড়ার পর ভিউয়ের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে।
'Be With You' নামক কোরিয়ান সিনেমাটির বাংলা ব্যাখ্যা করা ভিডিওটি সবচেয়ে বেশি লোক দেখেছেন। যেটির ভিউ দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ। 'সিনেমহল' চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১ লাখ ৫৯ হাজার।
চ্যানেলটির মালিক ও এডমিন আরাফাত মুনতাসীর শামীমের বাড়ি বরিশালের ভোলা জেলায়। সেখান থেকেই তিনি ইউটিউবের ভিডিওগুলো এডিট ও আপলোড করে থাকেন। তার চ্যানেল চালুর পেছনের গল্প বলতে গিয়ে জানান, "সরকারি পলিটেকটিক থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে আমি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করা শুরু করি। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে ইউটিউব চ্যানেল সম্পর্কে জানতে পারি। ফুড ব্লগিং ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের মতো ক্যামেরার সামনে আসতে চাইছিলাম না। আমি চেয়েছিলাম নিজেকে আড়ালে রেখে-ক্যামেরার সামনে না এসে কী ধরণের ভিডিও বানানো যায় সেটা করতে। সিনেমা দেখতে ভালোবাসতাম, আর সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত নিলাম বিদেশী সিনেমার কাহিনীকে বাংলায় ব্যাখ্যা করবো। এখন পর্যন্ত ভিডিও এডিট ও ভয়েস ওভারের কাজ একাই করে যাচ্ছি। মাসে ২/৩টা ভিডিও আপলোড করি। আপলোড করার ১ মাসের মধ্যে যদি ১০ লাখ মানুষ ভিডিওটি দেখে থাকেন, তবে ভালো অঙ্কের অর্থ পাওয়া যায়। যা ১৫-২০ হাজার টাকার কাছাকাছি। আর ৩০-৪০ লাখ ভিউ পড়লে ৭০-৮০ হাজার টাকা আয় করা যায় একটি ভিডিও থেকে। কেউ বিজ্ঞাপন দিতে চাইলে সেক্ষেত্রে ১৫-২৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়। এটা স্পন্সরদের সাথে কথা বলে ঠিক করে নেওয়া হয়।"
বাড়ছে ইউটিউবে চ্যানেলের সংখ্যা
'হন্টিং বাংলা (Haunting Bangla)' নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে চ্যানেলটি-তে কী ধরণের সিনেমার ভিডিওর দেখা মিলবে। হ্যাঁ, হরর বা ভৌতিক সিনেমা দেখতে যারা ভালোবাসেন তাদের জন্যেই এই চ্যানেলটি খোলা হয়েছিল। চ্যানেলের স্বত্বাধিকারী কারিমা আরহী কথা নিজেই ভৌতিক সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন। নিজের ভালোলাগা থেকেই ২০১৯ সালে চ্যানেলটি খুলেছিলেন। কলেজে থাকাকালীন তিনি শখের বশে নিজের হাতে থাকা মোবাইল ফোন দিয়ে ভিডিও এডিট করা শুরু করেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে জোরে জোরে সিনেমার বাংলা স্ক্রিপ্ট পড়ে ভয়েস দিতেন ভিডিওগুলো-তে। প্রথমদিকে ভিডিওগুলো নিজস্ব চেনাজানা লোক ছাড়া তেমন কেউ দেখতো না। পরিবারের সাপোর্ট থাকায় শুরু থেকে এই কাজে লেগে ছিলেন কথা। বর্তমানে তার মোট ৪টি ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। 'Haunting Bangla' চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ৮ লাখ ৩ হাজার।
কারিমা আরহী কথা জানান, "২টা চ্যানেলে সিনেমা ও বাকি ২টা থেকে সিরিজের বাংলা ভিডিও আপলোড করা হয়। আমার প্রথম চ্যানেলটি ছিলো 'Haunting Bangla'। চ্যানেলটি তে মোটামুটি সাবস্ক্রাইবার হতে ২ বছর সময় লেগে গেছে। শুরু থেকে আমি একা সবকিছু করতাম। কারণ তখনো আমার চ্যানেলগুলোর রিচ তেমন ছিল না। বর্তমানে আমার স্বামী ও সাথে আরও ৬জন টিম মেম্বার রয়েছে। আমাদের ৪টি চ্যানেলেই প্রতিদিন ১টি করে ভিডিও আপলোড করা হয়। প্রতিটি ভিডিও'র জন্যে স্ক্রিপ্ট লেখা, ভয়েস রেকর্ড, এডিটিং ও আপলোডের পেছেনে প্রায় ১৩-১৪ ঘণ্টা লেগে যায়।"
"ভিডিও এডিট করার জন্য এডোবে অডিশন, এডোবে প্রিমিয়ার প্রো, এডোবে আফটার এফেক্টস- এর মতো কয়েকটি অ্যাপ ও সফটওয়্যার রয়েছে। মূলত আমাদের চ্যানেলগুলো যারা দেখেন তাদের বেশিরভাগই স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী। কয়েকজন আছেন যারা মধ্যবয়সী, অন্য ভাষা বোঝেন কম-তাই বাংলা ভাষায় সিনেমা দেখতে ভিডিওগুলো দেখেন। কোরিয়ান সিনেমার জন্য 'Korean Movie Lovers' নামে যে চ্যানেলটি আছে ওটার বেশিরভাগ অনুসারীই অল্পবয়সী তরুণী", যোগ করেন কথা।
'Toukir Universe' নামের আরও একটি ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ৪ লাখের অধিক। ২০২১ সালে সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তৌকির চ্যানেলটি নিজ নামে খোলেন। অন্যদের মতো তিনিও সিনেমাপ্রেমী, সেখান থেকেই এই চ্যানেল খোলা। এক্ষেত্রে বাংলায় সিনেমা ব্যাখ্যা করার জন্য আইএমডিবি ও রটেন টমেটোজ মতো ওয়েবসাইট থেকে রেটিং দেখে নির্বাচন করেন। তিনি একাই শুরু থেকে চ্যানেলের যাবতীয় সবকিছু পরিচালনা করে আসছেন।
এছাড়াও Random Video Channel, Movie Review Channel, The World Of Keya, ASD Story, Our Cine Ghor সহ আরও বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। এই চ্যানেলগুলোর প্রতিটির সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা ও ভিউয়ের সংখ্যা এতো বেশি-যে প্রতিমাসে চ্যানেলের ভিডিও থেকে তাদের ভালো পরিমাণ আয় আসে। তাই অনেকে এই কাজকে বর্তমানে ফুলটাইম পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
তবু আছে প্রতিবন্ধকতা
ইউটিউব থেকে বিদেশী ভাষার সিনেমা, সিরিজের বাংলায় ব্যাখ্যা করার ভিডিও সার্চ বাটন চেপে সহজে পাওয়া গেলেও-যারা এই কাজটি করছেন তাদের জন্যে ব্যাপারটি মোটেও সহজ না। প্রতিটি চ্যানেলের স্বত্বাধিকারী জানিয়েছেন, তাদের কে এই কাজটি করতে যেয়ে ইউটিউব কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে কপিরাইটের ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। কারও কারও জন্যে সেটা আরও ভয়ংকর ছিলো। কেননা তাদের ভিডিওতে স্ট্রাইক পড়েছিল। স্ট্রাইকের মুখে পড়ে কয়েকজনের চ্যানেল 'ডাউন' হয়ে যায়। ফলে তাদেরকে আবার নতুন করে চ্যানেল খুলতে হয়েছিল। এমনকি কপিরাইট ইস্যুতে পড়লে ভিডিও থেকে অর্জিত অর্থের পরিমাণ কমে যায়।
'Haunting Bangla' চ্যানেলের স্বত্বাধিকারী কারিমা আরবী কথা বলেন, "আমার ২টা চ্যানেলে এখনো স্ট্রাইক রয়েছে। কপিরাইট ও স্ট্রাইকে পড়ার মূল বিষয়টি হচ্ছে সিনেমা ও সিরিজের ফুটেজগুলো আমাদের নিজস্ব নয়। তাই সিনেমা থেকে কয়েকটি অংশ নিয়ে আমরা যে ভিডিওগুলো বানিয়ে থাকি-সেক্ষেত্রে ফুটেজ আগপিছ করে দিতে হয়। কোনো কোনো সময় দৃশ্যকে ডানবাম করে দেওয়া হয় কপিরাইট ঝামেলা এড়াতে। তবুও সবসময় কাজে লাগে না। স্ট্রাইক পাওয়ার পর ১ সপ্তাহ চ্যানেলে কোন ভিডিও আপলোড করা সম্ভব হয় না। স্ট্রাইকের পরিমাণ বেড়ে গেলে চ্যানেল ডাউন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।"
ইউটিউব চ্যানেলগুলোতে বাংলা ভাষায় সিনেমা, সিরিজ দেখতে গিয়ে কী ধরণের সমস্যা হয় তা জানাতে সুমাইয়া তামান্না বলেন, "আমরা কোনো সিরিজের ডাবিং দেখার সময় দেখি প্রতিটি চরিত্রের জন্য আলাদা ভয়েস রয়েছে। কিন্তু বাংলায় ব্যাখ্যা করা ভিডিওগুলোতে একজন ব্যক্তি পুরো কাহিনীর বর্ণনা করে। এটা কিছুটা বিরিক্তিকর, আবার অনেক সময় বোঝা যায় না কোন চরিত্রের ডায়লগ কোনটা। তবুও ভালো ব্যাপার হচ্ছে ১৫-২০ মিনিটের ভিডিও দেখে সহজেই একটি মুভি বা সিরিজের মূল অংশ ও কাহিনী জানা যায়। যারা ভালো ইংরেজী বোঝে না এবং কোরিয়ান ভাষা জানে না, তাদের জন্যে এই ভিডিওগুলো বেশ উপকারী।"
দিনদিন মানুষ শখের বশে যেমন পেশা বেছে নিচ্ছে, তেমনি ঘরে বসে আয় করা যায় এমন কাজের প্রতি ঝুঁকছেন। আর এভাবেই বাড়ছে বিদেশী সিনেমাকে বাংলায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার ইউটিউব চ্যানেলের সংখ্যা। তবে তরুণরা এই ধরণের কাজে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। বেশিরভাগ চ্যানেলের স্বত্বাধিকারী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী। যারা পড়াশোনার পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেল খুলে প্রতিমাসে ভালো একটা অংকের অর্থ উপার্জন করছেন।