প্রাণী প্রেমে দিওয়ানা রাফিদ- যার আছে চিল, প্যাঁচা, শজারু...
নাজিরাবাজারের ১৪ নম্বর কাজী আলাউদ্দিন রোডে ২৭ অক্টোবরের বিকালটিকে বেশি ঝলমলে দেখাল। চকবাজার থেকে সাদাত থেকে এসেছে; বংশাল থেকে ইশরাক আর অনীক, বেচারাম দেউড়ি থেকে এসেছে স্বাধীন। দলের নেতা রাফিদ হক সোয়াদ বাবা-মাকেও ছাদে ডেকে এনেছেন। আজ সত্যি বিশেষ দিন, কারণ ১৫টি চিলকে আকাশে ছেড়ে দেওয়া হবে। দু'দিন আগে সিত্রাং ঝড়ের দাপটে পাখিগুলো কাহিল হয়ে পড়েছিল শহীদ মিনার চত্বরে। শতাধিক চিল ওই ঝড়ে নাকাল হয়েছিল। ভিজে গিয়েছিল তাদের পাখা, খাবার জোটাতে পারেনি, বাতাসের তোড়ে হয়েছে গাছ ছাড়া; পড়েছে ধপ করে চত্বরে।
তাই দেখে পথচারীরা আফসোস করেছিল এই বলে যে, আহা এতগুলো পাখি মারা গেল! পরে খবর পেয়ে বনবিভাগ অনেকগুলো পাখি নিয়ে যায়, কিছু নিয়ে আসে রাফিদও। পাখিগুলো আসলে মারা যায়নি, কাহিল হয়ে পড়েছিল কেবল। রাফিদের চিলবন্ধু হিসাবে সুনাম চার বছর ধরে। প্রতি বিকালেই চিলদের সে খাবার দেয়। এ উপলক্ষে রাফিদের বাড়ির আশপাশে শত শত চিল জড়ো হয় নির্দিষ্ট সময়ে। সাড়ে চার থেকে ৫টার মধ্যে রাফিদ মুরগির মাংসের ছাঁট আকাশে ছুঁড়ে দিতে থাকে, আর চিলগুলো তা ধরতে ডাইভ দিতে থাকে। হৃদয়কাড়া সে দৃশ্যের সাক্ষী হতে পেরে- নিজেকে ভাগ্যবান ভাবলাম। আজকে তার ওপর সুনীল আকাশে মুক্ত করা হচ্ছে আহত পাখিগুলোকে।
'স্কার' তড়িতাহত হয়েছিল
ছাদের ওপরে নেট দিয়ে ঘেরাও করা বড় একটা জায়গায় পাখিগুলোকে রাখা হয়েছে। আগে থেকেই আরো প্রায় আধা ডজন উদ্ধার করা চিল ছিল এখানে। রাফিদ প্রথম একটি আহত চিলের সন্ধান পায়- বংশালের একটি বাড়িতে। সেটা ২০১৮ সালে। বিদ্যুতের তারে তড়িতাহত হয়ে চিলটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। কাউকে দেখলেই আক্রমণ করতে উদ্যত হতো। ধরের ওপর মাথাটি স্থির রাখতে পারত না। রাফিদ দেখতে গিয়ে খুব খারাপ বোধ করে, কিন্তু চিলের মালিক সেটি বিনা পয়সায় দিয়ে দিতে রাজি হচ্ছিল না। অথচ এখনই যত্ন না নিলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে বলে মনে হচ্ছিল রাফিদের। শেষে মায়ের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা চেয়ে নিয়ে পাখিটি বাড়ি নিয়ে এলো।
রাফিদ পাখিটিকে উন্নতমানের খাবার দিল, আর তার আপন হওয়ার চেষ্টা চালালো। চিলের ঠোঁট আর নখ খুব ধারালো। আঁচড়ায়ও বাজেভাবে। একদিন রাফিদের হাতে ক্ষত-ও তৈরি করে ফেলল। তাই পাখিটির নাম সে রাখল- 'স্কার'। ক্রমে ক্রমে পাখিটি রাফিদকে বিশ্বাস করল, তার আক্রমণ করার প্রবণতা কমল। স্কার এখনো বেঁচে আছে, কিন্তু মাথাটি প্রায় সময়ই ঘুরতে থাকে। তারপর আরেকটি চিল রেসকিউ করে এনেছিল– রাফিদের বাল্যবন্ধু ইশরাক। ঘুড়ি ওড়ানোর সুতার সঙ্গে লেগে পাখিটির একটি পাখার প্রায় সবটাই আলাদা হয়ে গিয়েছিল। রাফিদ দেখে বুঝেছিল, এটি আর উড়তে পারবে না; নিরাপদ জায়গায় না রাখলে মানুষের বা কুকুর-বিড়ালের আক্রমণের শিকার হয়ে বেঘোরে প্রাণ হারাবে। রাফিদ নিজের কাছে রেখে শুশ্রুষা দিতে থাকল চিলটিকে। সুস্থও হয়ে উঠেছে, তবে ওড়ার ক্ষমতা হারিয়েছে চিরতরে।
রাফিদের দুঃখ, উপকারী এই পাখিটিকে মানুষ ভালো করে চিনলই না। চিল মরা-পচা সব রকম খাবার গিলতে পারে। ময়লার ভাগাড় পরিস্কার করে। পাখিটি কোনো কিছুর কেয়ার করে না; থাকার জায়গার জন্য হন্যে হয় না, খাবারের জন্য চিন্তিত হয় না, কোনো কিছুকে ভয় পায় না। একে বন্ধু বানালে মানুষের উপকার বই কোনো ক্ষতি নেই।
একবার একটা সদ্য ফোটা চিলের বাচ্চা পেয়েছিল রাফিদ। লক্ষ্মীবাজারের কোনো উঁচু গাছ থেকে পড়ে গিয়ে ভিতরে ধ্বসে গিয়েছিল। একজন রেসকিউ করে রাফিদের বাড়ি পৌছে দিতেও বেশি দেরী করেনি। কিন্তু, যখন পাখিটা রাফিদ নিজের হাতের ওপর পেল তার অল্পক্ষণের মধ্যেই মারা গেল। রাফিদ সেদিন কান্না আটকে রাখতে পারেনি।
প্রতিবেদক: সিত্রাংয়ে আহত পাখিগুলোকে কি কি শুশ্রুষা দিয়েছেন?
রাফিদ: আমি বেশি কিছু করিনি। ওদের একটা শেল্টার দিয়েছি, খাবার দিয়েছি ভালো ভালো। আর ওরা পাখায় রোদ লাগিয়েছে। চিল খুবই শক্তিশালী পাখি। নিজেই বাঁচার উপায় খুঁজে নিতে পারে। আটচল্লিশ ঘন্টাও যায়নি, দেখুন কেমন টগবগে হয়ে গেছে।
প্রতিবেদক: চিল খাওয়াচ্ছেন কবে থেকে?
রাফিদ: চার বছর হয়ে গেল সন্ধ্যার আগে আগে চিলদের খাবার দিই। আড়াই কেজি মুরগির ছাঁট (পা, চামড়া, গিলা-কলিজা ইত্যাদি) দিই প্রতিদিন। চিলদের সঙ্গে ভালোবাসা এমন হয়েছে যে, একদিনও মিস দিতে পারি না। কিছু চিল দেখেন আমার আশপাশেই ঘোরাঘুরি করে। আরেকটা চিল আছে, নাম দিয়েছি তুফান, আমার হাতের ওপর এসে বসে। আমি শিস দিলে, শুনতে পাওয়ামাত্র তুফান পাল্টা ডাক ছোড়ে। আমার ফলোয়ারদের মধ্যে তুফানের অনেক ভক্ত আছে।
'এই বাবু শোন, আর পাগলামি করিস না বাবা, তোকে কালই গোশত এনে দিব' – দূর থেকে শুনলে মনে হবে পিতা তার সন্তানের সঙ্গে আলাপ করছেন। রাফিদ ও তার প্রাণীগুলোর মধ্যে সম্পর্কটা– আসলেই পিতা-পুত্রের। দুই বছর হয়ে গেল, রাফিদ কোনো ছুটিতে যায়নি। শেষ যেবার শ্রীমঙ্গল গিয়েছিল, ১৭ ঘণ্টাও টিকতে পারেনি। বলছিল, 'প্রাণীগুলোর জন্য উদ্বেগ তৈরি হয়। আমি সকাল ৮টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত ওদের সঙ্গেই থাকি। ইশরাক, সাদাত প্রায়ই আসে। ওরাও প্রাণীগুলোকে ভালোবাসে।'
প্রতিবেদক: প্রাণীপ্রেম আপনার কবে থেকে শুরু হলো?
রাফিদ: ছোটবেলা থেকেই। আমাদের বাড়িতে গরু পালা হতো। আমার যখন কুকুর ছিল না– তখনও আমি পড়শিদের কুকুরকে গোসল করিয়ে দিতাম, খাবার খাওয়াতাম।
প্রতিবেদক: আপনার এখন কয়টি কুকুর আছে?
রাফিদ: চারটি। এর বেশি রাখার জায়গা আমার নেই। কুকুর দিয়েই কিন্তু আমার রেসকিউ প্রোগ্রাম শুরু হয়। ২০১৬ সালে একবার কাঁটাবন গিয়েছিলাম। সেখানে একটা দোকানে ২ ফুট বাই ২ ফুটের একটা খাঁচায় একটা কুকুরকে ঝিমোতে দেখলাম। দোকানীর সঙ্গে কথা বলে জানলাম, মিক্সড ব্রিডের এই কুকুরটার পেছনের দুই পা অবশ। আমি কিনে বাড়ি নিয়ে এলাম। টাওয়াল জড়িয়ে গরম পানির ওম দিতে থাকলাম, আর খাবার খাওয়াতে থাকলাম নিয়মিত। মাঝেমধ্যে হাঁটিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা চালাতাম। তিন মাস যাওয়ার পর কুকুরটা বেশ শক্তি ফিরে পেল। আমার কথাবার্তা সব বুঝতে পারছিল।
আমি যে ওকে হাঁটাতে চাই– সেটা বোঝার পর নিজে থেকেই মাঝে মধ্যে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চেষ্টা করতে থাকল। আরো তিন মাস যাওয়ার পর দেখি 'স্নুপি' (কুকুরটার নাম) সত্যি সত্যি হাঁটতে পারছে। আসলে 'উইল পাওয়ার' থাকলে অনেক কিছুই যে সম্ভব স্নুপি তা আবার প্রমাণ করল।
ভালোবাসা পেয়ে খুশি
সাদা রঙের বেশ লম্বা একটা কুকুর দেখলাম রাফিদের সংগ্রহে। নাম জানলাম ল্যাব্রাডর। কুকুরটি বেশ উঁচু স্বরে ডাকতে পারে। রাফিদ জানাল, কুকুরটিকে সে এনেছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাড়ি থেকে। মাথা গরম কুকুর বলে এর কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। আসলে কুকুরটি 'মিসট্রিটেড' বা 'মিস আন্ডারস্টুড'। মানে মালিক চাইছিল, কুকুরটি আক্রমণাত্মক হোক। তাই একে অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল দিনের পর দিন। খাবারও দেওয়া হচ্ছিল না ঠিকমতো। কুকুরটি সত্যি সত্যিই এক সময় ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল, যা মালিকেরও সহ্য হচ্ছিল না।
রাফিদ নিয়ে এসে এটিকে আদর ভালোবাসা দিতে থাকে। অল্পদিনে ল্যাব্রাডর বুঝেও ফেলে– সে এমন কাউকে পেয়েছে যে তাকে ভালোবাসে। আর তাতে তার আচরণ বদলাতে থাকে। এখন সে উঁচু গলায় হৈ চৈ করে বটে, তবে কাউকে আহত করেছে এমন রেকর্ড নেই। হৈ চৈ-ও করে আদর পাওয়ার জন্যই।
রাফিদের একটি বিড়াল 'মিউনি'-ও ব্যতিক্রমী। সে মোটেও সামাজিক নয়, কারুর সঙ্গ পছন্দ করে না। একা থাকতেই ভালোবাসে। মিউনির মালিক তাই তাকে মারধোরও করত। মিউনিও একসময় মাথা গরম বিড়াল হয়ে ওঠে। রাফিদ তাকে নিয়ে এসে বুঝিয়েশুনিয়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করছে। মিউনি এর মধ্যে একটি বাচ্চাও দিয়েছে। বাচ্চাটি দেখতে দারুণ সুন্দর। আরেকটি বিড়ালকে রাফিদ তুলে এনেছে রাস্তা থেকে। দিন কয়েকের না খাওয়া বিড়ালটি ধুঁকছিল রাস্তার ধারে। রাফিদ তার আশ্রয়কেন্দ্রে এনে রেখেছে বিড়ালটিকে। খেয়ে-ঘুমিয়ে সুখেই আছে।
রাফিদের সাত তলার ছাদ, আর তার ওপরের মিনি ছাদের পুরোটাই পশুপাখির শেল্টার হোম। তার আশ্রয়কেন্দ্রে মুরগি, কবুতর, টিয়া, খরগোশ, ছাগল, ভেড়াও আছে। সকালে ছাদে উঠেই দুই ঘন্টা ছাগলগুলোকে ছেড়ে রাখে। তারপর বিড়ালগুলোর জন্য বরাদ্দ করে অনেকটা সময়। তারা হাঁটে, খেলে, দৌড়ায়। রাতের বেলার পুরোটাই কুকুররা খোলামেলা থাকে। রাফিদ শখ করে একটি পিগমি শজারুও পোষে।
লাখো লোকের সঙ্গে চলাফেরা
রাফিদের রেসকিউ বিষয়ক একটি পেইজ আছে ফেসবুকে, নাম 'ডগ্গো সেজ' বা জ্ঞানী কুকুর। এর ফলোয়ারের সংখ্যা ৫৪ হাজার। আর নিজের নামে যে পেইজ আছে, তাতে ফলোয়ার আছে আরো তেতাল্লিশ হাজার। সব মিলিয়ে লাখো লোকের সংসার তার। দিনে দুই-আড়াইশ ফোন পায় রাফিদ ও তার বন্ধুরা। কেউ দেয় আহত প্রাণীর খবর, কেউ জানতে চায় আহত প্রাণীকে সুস্থ করার উপায়।
রাফিদ এখন ইউল্যাবে বিবিএ পড়ে। জানতে চেয়েছিলাম, আপনাকে যদি কোনো কোম্পানি বড় চাকরির অফার দেয়, তখন প্রাণীগুলোকে তো সময় দিতে পারবেন না, তখন কি করবেন?
রাফিদ: চাকরি করব না। আমি উদ্যোক্তা হতে চাই। কৃষি বিষয়ক কোনো একটা ব্যবসার উদ্যোক্তা হতে চাই। আমি আমার বেবিদের (পশুপাখি) ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না, যেতে পারবও না।
পেইজে যেসব কথাবার্তা চলে
যেদিন শহীদ মিনারের আহত পাখিগুলোকে মুক্ত করলেন, সেদিনকারেএকটি পোস্টে স্যালুট দিয়েছে কেউ কেউ; রেসপেক্ট বলেছে অনেকে।
মোঃ মিন্টু শেখ নামের একজন লিখেছেন, ভাইয়া আমার বাসা রায়েরবাগ, আমার বাসার পাশেই একটি খাবারের হোটেলে একটি দেশীয় টিয়াপাখি বন্দি অবস্থায় আছে। আমি আপনাদের সহযোগিতা নিয়ে সেটিকে আকাশে ফিরিয়ে দিতে চাই।
শহীদ মিনার থেকে আহত চিলগুলো রিকশায় করে নিয়ে আসার ছবিটি পোস্ট দেওয়ার পর সাইফুল্লাহ সাইফুল লিখেছেন, সকালে পাখিগুলোকে পড়ে থাকতে দেখে আপনার কথাই মনে মনে চিন্তা করছিলাম, দোয়া রইল।
শামসুন্নাহার তাপসী নামে আরেকজন লিখেছেন, আমি সঙ্গেসঙ্গেই আপনার পেইজ নেমটা কমেন্টে মেনশন করেছিলাম। আরো অনেকেই দেখলাম মেনশন করেছেন। মনে মনে ভেবেছিলাম, আপনি ঠিক যাবেন চিলগুলোকে উদ্ধার করতে। অনেক অনেক দোয়া আপনার জন্য।
নাবিল আহমেদ নামে একজন জানিয়েছেন, কিছুদিন আগে আমাদের বাসার সামনে কিছু কুকুর একটা চিলকে মারাত্মকভাবে জখম করেছিল। পাখিটার একটা ডানা সম্পূর্ণ ভেঙে গিয়েছিল, অনেক চেষ্টা করেছি, বাট শেষ রক্ষা হয়নি, পাখিটা মারা গেল।
রাফিদের করা প্রায় পোস্টেই দেড়-দুইশ কমেন্ট পাওয়া যায়। ইদানীং রাস্তায় তাকে দেখলে অনেকে ভিড়ও করে। তার বাড়ি আসতে চেয়ে– ঠিকানা জানতে চায়। তবে রাফিদের ভক্ত বাড়ানোর চেয়ে পশুপাখির জন্য প্রেমময় একটি পৃথিবী বানানোর আগ্রহ বেশি। রাফিদ চায় কুকুর-বিড়াল-মুরগি-ছাগল-চিল সবাই মিলেমিশে বাস করুক। সবাই সব খাবার, সবার সঙ্গে ভাগ করে খাক। এটা সে তার নিজের ছাদে পরীক্ষা করে দেখতে চায়। চায় বিশ্বজুড়ে প্রাণী ও মানুষের ভালোবাসার যৌথ খামার।