চোখের ৬ লক্ষণ আপনার স্বাস্থ্যের অবস্থা বলে দেবে!
চোখ আমাদের মনের জানালা। শুধু তা-ই নয়, আমাদের স্বাস্থ্যের জানালাও হতে পারে চোখ। চোখের দৃষ্টিতে পরিবর্তন আপনার স্বাস্থ্যঝুঁকির সংকেত হতে পারে। এমনকি স্ট্রোক এবং ডায়াবেটিসের উপসর্গও হতে পারে সেগুলো। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমরা প্রায়শই আমাদের চোখের সমস্যাগুলোকে উপেক্ষা করি।
লন্ডনভিত্তিক সেন্ট্রাল ভিশন অপটিশিয়ানস-এর অপ্টোমেট্রিস্ট ভবিন শাহ বলেন, 'আমাদের চোখের পেছনের অংশই (রেটিনা) একমাত্র জায়গা যেখানে শরীরে কোনো ছেদ না দিয়ে আমরা রক্তনালী দেখতে পারি।'
এর মানে হলো, আমাদের চোখ কিন্তু ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র থেকে শুরু করে উচ্চ রক্তচাপসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যার উপসর্গ প্রকাশ করতে পারে। অথচ শেষ কবে চোখের পরীক্ষা করেছি তা আমরা অনেকেই মনে করতে পারি না।
চোখের পরিবর্তন কী কী রোগের লক্ষণ হতে পারে তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ।
ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ
চোখের কোনো বয়স না থাকলেও কিছু রোগ বয়সের সাথে সাথে চলে আসে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের চোখে ছানি পড়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। তবে শুধু আমাদের দৃষ্টিশক্তিই যে ঝুঁকিতে থাকে তা নয়, বয়োবৃদ্ধির সাথে ডিমনেশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশেরও সংযোগ থাকে।
গত বছর পরিচালিত ও ব্রিটিশ জার্নাল অভ অফথ্যালমলোজিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, যাদের চোখ সুস্থ তাদের তুলনায় ছানিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ডিমেনশিয়া হওয়ার ঝুঁকি ১১ শতাংশ বেশি। অন্য আরেকটি সমীক্ষায় দেখা যায়, চোখের ছানিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মাঝে যারা অস্ত্রোপচার করেছেন তাদের ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা, যারা করেননি তাদের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম।
এমন ফলাফলের সম্ভাব্য কারণ ব্যাখ্যা করে ভবিন শাহ বলেন, 'ইন্দ্রিয়ের ক্ষতি অবধারণগত (মানুষ যা জানে বা বিশ্বাস করে সে সম্পর্কিত জ্ঞান) হ্রাসের সৃষ্টি করতে পারে বলে এ আশঙ্কা থাকতে পারে। আবার, চোখে ছানি পড়া আমাদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেয়। তাছাড়া যারা ছানির অস্ত্রোপচার করেছেন তারা হয়তো অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে যান।'
আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে চোখের ছানি পড়া শুরু হয়, লেন্সগুলো আর আগের মতো ভালোভাবে কাজ করে না। আমরা যখন ষাটে পদার্পণ করি, আমাদের চোখের লেন্স স্বচ্ছতা হারিয়ে ঝাপসা হয়ে যেতে পারে। আশেপাশের জিনিসগুলো তখন অস্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন, পাশাপাশি কিছু লাইট এক মনে হওয়া।
তবে, ছানি অস্ত্রোপচারের সাফল্যের হার বেশ উচ্চ। প্রাথমিক পর্যায়ের ছানি তেমন গুরুতর না হলেও লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্রই এই অস্ত্রোপচার করা উচিত।
ভবিন শাহ মনে করেন, অস্ত্রোপচারের সর্বোত্তম সময় হলো যখন ছানির লক্ষণগুলো দেখা দেওয়া শুরু করে এবং সেগুলো যখন আপনার দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করা শুরু করে। যত বেশি সময় ধরে এই লক্ষণগুলোকে উপেক্ষা করবেন, অস্ত্রোপচার করা ততই কঠিন হয়ে পড়বে।
ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র
ডায়াবেটিস শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে চোখের পরীক্ষা করানো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক ধাপ হতে পারে। যদিও এই রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে উপসর্গবিহীন হয়ে থাকে, তবে এক্ষেত্রে চোখে কিছু পরিবর্তন ধরা দিতে পারে।
ব্লাড সুগার লেভেল রক্তনালীকে প্রভাবিত করে। ফলে রক্তনালীগুলো ছিদ্রময় হয়ে যায় এবং এই ছিদ্রগুলোর মাধ্যমে রক্তক্ষরণ ঘটে। এর ফলে রোগীর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতে পারে।
চোখ কিংবা কিডনির মতো অঙ্গগুলোর ক্ষতি হওয়ার আগেই ডায়াবেটিস ধরা পড়া জরুরি। কারণ তা না হলে এই ক্ষতি প্রতিকার করা প্রায় অসম্ভব।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে রেটিনার রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয় যা দীর্ঘদিন চিকিৎসা না করা হলে রোগী শেষ পর্যন্ত দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারে।
আবার, ডায়াবেটিস রোগীদের গ্লুকোমা হওয়ার আশঙ্কা দ্বিগুণ এবং তাদের অল্প বয়সে চোখে ছানিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ডায়াবেটিস থেকে সৃষ্ট চোখের সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি ৬০ শতাংশ বেশি থাকে।
তবে আশার কথা হলো, চোখের যেকোনো পরিবর্তন আগেভাগে ধরা পড়লে তার প্রতিকার করা সম্ভব। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ব্লাড সুগার লেভেল, রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরোল নিয়ন্ত্রণে রাখা উচিত। এছাড়াও ডাক্তারের নির্ধারণ করে দেওয়া ওষুধ নিয়মিতভাবে গ্রহণ করার পাশাপাশি বার্ষিক ডায়াবেটিক চোখের স্ক্রিনিং টেস্ট করিয়ে নেওয়া উচিত।
উচ্চ রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপ ছোট রক্তনালীগুলোর ক্ষতি করতে পারে। তাই চোখের পরীক্ষাতে এই রোগটি ধরা পড়তে পারে।
ভবিন বলেন, 'আপনার রক্তচাপ যদি উচ্চ হয়, তবে তা আপনার পুরো শরীরের রক্তনালীগুলোকে প্রভাবিত করবে।'
উচ্চ রক্তচাপ যে হ্রদপিণ্ড বা কিডনির মতো অঙ্গগুলোকে প্রভাবিত করছে, চোখের ক্ষতি তারই একটি সতর্কতা সংকেত।
উচ্চ কোলেস্টেরল
উচ্চ কোলেস্টেরল হৃদরোগের ঝুঁকির কারণ। এছাড়াও এটি জ্যান্থেলাজমা সৃষ্টি করতে পারে যা চোখের আশেপাশে কিংবা চোখের পাতায় কমলা রঙের প্লেক হিসেবে ধরা দিতে পারে। এই কমলা রঙের প্লেক বা জ্যান্থেলাজমা হলো কোলেস্টেরল জমার লক্ষণ। এটি লেজার সার্জারি কিংবা লিকুইড নাইট্রোজেন দিয়ে দূর করা সম্ভব।
শুষ্ক চোখ হওয়া এবং দৃষ্টিক্ষীণতা
শুষ্ক চোখের একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে মোবাইল ফোন বা কম্পিউটার ইত্যাদি ডিভাইসের স্ক্রিনে অতিরিক্ত সময় ব্যয়।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমাদের অশ্রু গ্রন্থি শুকিয়ে যায় এবং এগুলোতে ব্যাক্টেরিয়া জন্মায়। এ অবস্থায় চোখে কিছু আছে এমন অনুভূত হয় যা খুবই বিরক্তিকর। এটি মূলত বয়োবৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত হলেও, অনেক শিশু এতে ভুগে থাকে।
তাছাড়া ডিভাইস ব্যবহারের সময় স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকাকালে আমরা চোখের পলক তুলনামূলকভাবে কম ফেলি যা সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
ভবিন উদ্বেগের সাথে জানান, ২০ বছর আগের সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ শিশু এখন দৃষ্টিক্ষীণতায় ভুগছে।
অনেক সময় আমরা দৃষ্টিক্ষীণতার জন্য কেবল আমাদের বংশানুক্রমিক জিনকে দায়ী করি। কিন্তু এর জন্য আমাদের জীবনযাত্রার ধরণ যেমন অতিরিক্ত ডিভাইস ব্যবহার, বহিরাঙ্গনে ব্যায়াম না করা এবং সূর্যরশ্মির সংস্পর্শে না আসাও দায়ী।
'রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে থাকাকালীন নির্ণয় করতে পারাটাই গুরুত্বপূর্ণ', বলেন ভবিন শাহ।
মৃত্যুঝুঁকি
কখনো কখনো মৃত্যুঝুঁকি কিংবা আমাদের জীবনের হুমকিস্বরূপ অবস্থা কেবল একটি চোখের পরীক্ষাতেই ধরা পড়তে পারে। বিশেষ করে এমন কোনো রোগ যার উপসর্গ হঠাৎ করে ধরা পড়ে (যেমন স্ট্রোক), সেসব রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে চোখের পরীক্ষা।
ভবিন শাহ বলেন, 'সম্প্রতি আমাকে একজন রোগী এক চোখে দৃষ্টিশক্তি কিছুটা হারিয়েছেন বলে জানান। পরীক্ষা করে দেখা যায় তিনি দুটো চোখেই তা হারিয়েছেন যা স্ট্রোকের একটি লক্ষণ। স্ট্রোকের উপসর্গগুলোই তিনি অনুভব করছিলেন।'
চোখ নড়াচড়া করতে যন্ত্রণা অনুভূত হওয়া, ব্লাইন্ড স্পট, দ্বৈত দৃষ্টি অথবা চোখের অনিচ্ছাকৃত নড়াচড়ার মতো উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (এমএস) পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে বলে জানান তিনি।