৩০ বছর ধরে নিভৃতেই যে হাসপাতাল চোখের সেবা দিয়ে যাচ্ছে
'চোখটা সবসময় কড়কড় করত, কিছুই ঠাওর করতে পারতাম না। একটা সময় সবজি বেচাও বন্ধ হয়ে গেল। পোলা-মাইয়ারা দূর-দূর করত…দেখতে চাইত না। তখন খবর পাইলাম সাত মসজিদ রোডের দিকে নাকি ম্যালা সস্তায় চোখ দেখে ডাক্তররা। ভাবলাম যাইয়া দেখি। দেখি ৫০ টাকায় চোখ দেইখ্যা দিল। এরপর আরও কয়েকটা টেস্ট করতে কইল। কী একটা অপারেশনও করল। এরপর থেইকাই ভালো দেখি। আবার ব্যবসা শুরু করছি।'
বলছিলাম কিশোরগঞ্জের ভৈরবের শাহ আলমের কথা। থাকেন ফার্মগেট। ফার্মগেট থেকে হলিক্রস স্কুলের দিকে যে রাস্তা চলে গেছে, সেখানে গেলেই দেখা মিলবে এ সবজি বিক্রেতার। অনেক বছর ধরে চোখে কম দেখতেন। পাড়ার সবার কাছে 'কানাবুড়া' হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন।
অশীতিপর এ বৃদ্ধের ভাষ্য, 'চোখের অপারেশনের পর আল্লাহর রহমতে এখন ভালোই আছি।' এখন প্রতিদিন ভোররাত ৩টার দিকে চলে যান রাজধানীর সবচেয়ে বড় সবজি বিক্রির আড়ত কারওয়ান বাজারে। এরপর টুকটাক যা পান, 'হস্তায়' (সস্তা) তাই কিনে নেন। সারাদিন ভালোই চলে বিক্রিবাট্টা। অন্তত এখন আর খাওয়াপরার জন্য কারো মুখের দিকে তাকিয়ে তো থাকতে হচ্ছে না।
১৩ বছরের শান্তা। মা-বাবা আর ৫ ভাইবোনের সঙ্গে থাকে রাজধানীর শংকরে। সারাদিনই মাথাব্যথা আর চোখে ঘোলা দেখা যেন পরিবারের সবচেয়ে ছোট এ সদস্যের নিত্যদিনের সঙ্গী। এ সমস্যার কথা বাসায় জানিয়েও লাভ নেই। শান্তার বাবার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। নুন আনতে যেখানে পান্তা ফুরায়, সেখানে মেয়ের চোখ নিয়ে ভাবার সময় আর কই?
এরকম সময়ই এক প্রতিবেশীর কাছে খবর পেয়ে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বোনের সঙ্গে আল-নূর হাসপাতালে যায় শান্তা। চিকিৎসক দুই ধরনের ড্রপ দিয়েছেন, চশমা ব্যবহার করতে বলেছেন। চোখ দেখানো থেকে শুরু করে চশমা নেওয়া—সবকিছু মিলে খরচ হয়েছে ১,২০০ টাকার মতো, খরচ নাগালের মধ্যে থাকায় অনেকটা স্বস্তির সুর শান্তার বোনের কণ্ঠে।
খুকুমণি, বয়স ২৩ থেকে ২৪ হবে। বাঁ চোখটা লাল হয়ে থাকায় কিছুদিন হলো বেশ অস্বস্তিতে আছেন। চোখ বন্ধ বা খোলা, কোনোভাবেই শান্তি মিলছে না। তাই ক্লাস শেষেই এসে পড়েছেন, সাত মসজিদ রোডের আল-নূর চক্ষু হাসপাতালে, উদ্দেশ্য চক্ষু বিশেষজ্ঞ দেখানো।
বৃদ্ধ শাহ আলম, শান্তা কিংবা খুকুমণি থেকে শুরু করে প্রতিদিন হাজারো মানুষের চোখে ব্যথা কি চোখ দিয়ে পানি পড়া বা ছানির মতো ছোট-বড় যাবতীয় সমস্যা নিয়ে রাজধানীর আল-নূর চক্ষু হাসপাতালের কারবার। সাত মসজিদ রোড দিয়ে শংকর যাওয়ার পথে হাতের বাঁয়ে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল আর বড় বড় অট্টালিকার মাঝে লাল ইটের চারতলা এ ভবনটিতে গত ৩০ বছর ধরে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত দেখা যাবে একই চিত্র।
হাসপাতালটির ব্যস্ততার ছোট্ট একটি প্রমাণ মিলল রিসেপশনিস্ট হালিমার কথাতেই। ঘড়ির কাঁটায় তখন একটা বেজে মিনিট দশেক হবে। জানালেন, সেই যে সকাল ৮টার দিকে বসেছেন, টানা ১টা পর্যন্ত চেয়ার ছেড়ে ওঠার কোনো ফুরসত মেলেনি।
তার কথার সত্যতা মিলল চিকিৎসকের অপেক্ষায় হাসপাতাল লাউঞ্জের ওয়েটিংরুমে বসা খুকুমণির কথাতেই। ভিড়ের কারণে প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবৎ বসে আছেন, এখনও চিকিৎসক দেখাতে পারেননি তিনি।
জানালেন, 'সকালের দিকে এলে বেশ দ্রুত দেখানো যায়, তবে একটু বেলা হয়ে গেলে প্রচুর মানুষের ভিড় লেগেই থাকে।'
কথায় কথায় জানা গেল, প্রায় ১০ বছর ধরে হাসপাতালটিতে চোখ দেখান খুকুমণি। অল্প খরচ আর চিকিৎসকদের আন্তরিক ব্যবহারের কারণেই প্রতি ৬ মাস অন্তর অন্তর হাসপাতালটিতে আসেন তিনি।
৩০ বছর ধরে সেবা!
সৌদি আরবের আল-বাশার ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত এ হাসপাতালটি ১৯৯২ সাল থেকে ৩০ বছর ধরে একইভাবে সেবা দিচ্ছে। দিনে দেড়শ থেকে দুইশজনের মতো মানুষ প্রতিদিন এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।
কখনও একদম বিনামূল্যে চোখ দেখানোর ক্যাম্পেইন, কখনও ফ্রিতে অপারেশনের ব্যবস্থা করে দিয়ে মন জয় করে নিয়েছে আশপাশের সব এলাকার মানুষের। শুধুই সহায়সম্বলহীন এমন মানুষেরই পছন্দ আল-নূর চক্ষু হাসপাতাল? অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ব্যক্তি থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষের বেশ পছন্দের এই হাসপাতাল—এমনটি দাবি হাসপাতালটির হেড অভ অ্যাকাউন্টস এন্ড ফিন্যান্স মোহাম্মদ মফিজুল ইসলামের। হাসপাতালটিতে প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চাকরি করছেন তিনি।
জানতে চাইলাম, এত বছর ধরে হাসপাতালের সেবার একই মান ধরে রাখার রহস্য কী? উত্তরে স্মিত হাসি মফিজুলের। জানালেন, রোগী ধরে রাখার চেয়ে সেবার মান নিশ্চিত করার ওপরই বেশি জোর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। এমনকি চিকিৎসকদের পরিচয়ও রোগীদের আগে থেকে জানার সুযোগ নেই। ফলে রোগীদের কাছে কোন চিকিৎসকের থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন, এরচেয়েও মুখ্য চিকিৎসার মান।
আল-নূর চক্ষু হাসপাতালের হাসপাতালের সিনিয়র কনসাল্টেন্ট ডা. শেখ আনিসুজ্জামানও বলেন, সেবা বা মানের বিষয়ে কোনো আপস করে না তাদের হাসপাতাল। ১৯৯৫ সাল থেকে হাসপাতালটির সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। সেইসময় থেকে এখন পর্যন্ত একই মানের সেবা দিয়ে আসছে আল-নূর চক্ষু হাসপাতাল। সব চিকিৎসকরাই খুব সচেতনভাবে মানসম্মত সেবা দেন বলে দাবি তার।
আল-নূরে চিকিৎসা নিতে এসে ধনী-গরিব যে-ই আসুক না কেন, কোনো রোগী যাতে ফেরত না যায়, সেদিকে সবসময় লক্ষ্য রাখা হয় বলেও জানালেন আনিসুজ্জামান।
মফিজুলের কাছ থেকে জানতে পারলাম, হাসপাতালটিতে দুই শিফটে মোট ১৪ জন চিকিৎসক বসেন। মোট সাড়ে ৬ ঘণ্টা করে সেবা দিতে হয় একেকজনকে। রোগীদের সেবা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল ভবনটির দুটো বিল্ডিং পরে, আল মানার হাসপাতালের পঞ্চমতলায় আরেকটি ইউনিট রয়েছে। সেখানেও রোগী দেখানোর পদ্ধতি একই। প্রথমে ডেস্কে রোগীর নাম-পরিচয় জানিয়ে, টাকা জমা দিয়ে চিকিৎসকের জন্য অপেক্ষা।
রাজধানীর উত্তরায় একইভাবে পরিচালিত হচ্ছে হাসপাতালটি। ঢাকার বাইরে টাংগাইল, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাটেও রয়েছে হাসপাতালটির কার্যক্রম। লালমাটিয়া ছাড়া বাকিসব জোনেই আল মক্কা চক্ষু হাসপাতাল নামে পরিচিত হাসপাতালটি। বিশ্বের মোট ৪২টি দেশে একইভাবে হাসপাতালটির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
আড়াইশ টাকায় মিলবে সেবা
আবার সেই বৃদ্ধ শাহ আলমের কথাই বলি, কম খরচের কথা শুনে যখন হাসপাতালে আসেন, সেই সময় সঙ্গে আসা শরীফ নামে তার এক প্রতিবেশী তাকে হাসপাতালে ঝোলানো একটি নোটিশের কথা জানান। সেই নোটিশ অনুযায়ী সে যাত্রায় কেবল ৫০ টাকা দিয়েই চোখ দেখান তিনি। এরপর তার কথা শুনে চিকিৎসকরা ফ্রিতেই অপারেশনের ব্যবস্থা করে দেন।
এভাবেই প্রতি মাসে কমপক্ষে ২০০ রোগী আসেন যাদের চিকিৎসা হয় বিনামূল্যেই। আবারও মফিজুল জানালেন, মানুষের সেবাই তাদের পরম ধর্ম। টাকা নিয়ে ভাবেন না চিকিৎসক বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেউই।
তবে উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে সবার জন্য আড়াইশ টাকায় মিলবে সেবা। আর বিভিন্ন অপারেশনের জন্য শুধু যে অর্থটুকু প্রয়োজন সেইটুকুই রাখা হয়। ৪ হাজার থেকে শুরু হয় সাধারণত চোখে ছানির মতো অপারেশনগুলো। এছাড়া ক্যালিজিয়ন বা ছোট অপারেশনগুলো তাৎক্ষণিকভাবে করে দেওয়া হয়, ৩০০ টাকা থেকে ধরা হয় সাধারণত এসব অপারেশনমূল্য।
আবার এক সপ্তাহ সময়ের ভেতর এলে বা একবার চোখ দেখিয়ে গেলে, চিকিৎসক যদি নিজে আসতে বলেন বা চিকিৎসার পর সমস্যা দেখা গেলে কোনো খরচ ছাড়াই মিলবে চোখ দেখানোর সুবিধা।
বিনামূল্যে চক্ষুসেবা ক্যাম্পেইন
গত ২৩ সেপ্টেম্বর চাঁপাইবনবাবগঞ্জে একটি বিনামূল্যে চক্ষু সেবা কার্যক্রম শুরু হয়। কার্যক্রমটির আয়োজন করে আল-নূর চক্ষু হাসপাতালের চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখা। সৌদি আরবের ১৫ জন চিকিৎসক এসেছিলেন সেখানে। একসপ্তাহে ৪ হাজার ৬১০ জন রোগী দেখেছেন তারা, একইসময়ে ৫১৯টি সার্জারিও করেন। জানা গেল, সেবার মান ঠিক রাখতে প্রতিবছরই বাইরের বিভিন্ন দেশের চক্ষু বিশেষজ্ঞরা এসে ঘুরে যান হাসপাতালগুলো। চলে বিনামূল্যে চক্ষুসেবা দান।
বিকেল ৪টা হবে তখন। আল-নূর চক্ষু হাসপাতালের দ্বিতীয়ত ইউনিট। চিকিৎসকের অপেক্ষায় বসে থাকা আশরাফউদ্দীন নামে সাবেক এক সরকারি কর্মকর্তা জানালেন, খবরের কাগজে প্রথম হাসপাতালটি সম্পর্কে জানতে পারেন, সেটাও প্রায় বছর বিশ আগের কথা। এরপর থেকে এ হাসপাতালটি বেছে নিয়েছেন তিনি। সেবার মান আর খরচ, দুটিই বেশ সন্তোষজনক। জানালেন, সবসময় চেকআপের জন্য এলেও এবার স্ত্রীর দুইচোখের ছানিও অপারেশন করিয়েছেন।
বিনামূল্যে ক্যাম্পেইন নিয়ে আল-নূর হাসপাতাল সম্পর্কে আরেকটি বেশ চমকপ্রদ তথ্য জানালেন মফিজুল ইসলাম। আশেপাশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বিনামূল্যেই চোখ পরীক্ষা করেন, আবার প্রয়োজনে চশমাও হাসপাতালের পক্ষ থেকে দেন তারা।
তবে এরমধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ! বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যাতে শিক্ষার্থীদের চোখ পরীক্ষায় প্রাথমিক ধাপটুকু শিক্ষকরাই দেখে দিতে পারেন। এজন্য প্রত্যেক শ্রেণিতেই ক্লাস ক্যাপ্টেনদের দায়িত্ব দিয়ে রাখা আছে, কেউ ঠিকমতো দেখতে না পারলেই শিক্ষকদের জানায় তারা। এরপর তাদের চশমা লাগলে বা অন্য কোনো সমস্যা থাকলে সেগুলোর জন্য তো আল-নূরের বিশেষজ্ঞরা রয়েছেনই।
এ পর্যন্ত বাংলাদেশেই ৪১ জেলায় এরকম ক্যাম্পেইনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে ৪৬ লাখ মানুষের বিনামূল্যে চোখ পরীক্ষা করা হয়েছে, আর ২১ মানুষের ছোট-বড় বিভিন্ন অপারেশন করা হয়েছে।
গরিবের বন্ধু
আল-বাশার ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে পরিচালিত এ হাসপাতালটি যে প্রকৃত অর্থেই গরিবের বন্ধু, তার প্রমাণ মেলে প্রত্যেক রমজানে। হাসপাতালের নিজের হেঁশেলে নিজেদের রাঁধুনির দিয়ে রান্না করা হয় আশেপাশের এলাকার 'দিন আনি দিন খাই মানুষের' জন্য। রমজানের ৩০ দিনই একেক এলাকায় ইফতারের আয়োজন করে হাসপাতালটি, এমনটি জানালেন মফিজুল।
মফিজুলের দাবি, এভাবেই সুখে-দুঃখে বছরের পর বছর মানুষের পাশে থেকে, কিন্তু প্রচারের বাইরে এভাবেই এগিয়ে যাবে আল-নূর চক্ষু হাসপাতাল।