শিশুদের ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া বেড়েছে, ৮০ শতাংশ রোগীর বয়স ২ বছরের নিচে
প্রতিদিন ডায়রিয়া নিয়ে সাড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ রোগী আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবির) চিকিৎসা নিচ্ছে। যাদের মধ্যে ৮০ শতাংশেরই বয়স দুই বছরের কম। ডায়রিয়ার পাশাপাশি আইসিডিডিআর,বি ও বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নিউমোনিয়া রোগীও বাড়ছে।
ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া থেকে শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে শিশুদের ঠান্ডা না লাগানো, বুকের দুধ খাওয়ানো ও ডায়রিয়া হলে সঠিক নিয়মে স্যালাইন খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালের পরিস্থিতি
আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে অন্যান্যা বছরের তুলনায় এবার শীতে ২০ শতাংশ বেশি রোগী আসছেন।
গতকাল রোববার দুপুরে সরেজমিনে হাসপাতালটিতে দেখা যায়, প্রধান ফটকের কাছেই বড় করে টানানো হয়েছে তাঁবু। যদিও এখনো সেখানে বেড বসানো হয়নি। হাসপাতালের মেইন ভবনের সামনে তিনটি বুথে নার্সরা রোগীর এন্ট্রি নিচ্ছেন এবং চিকিৎসকরা রোগীদের দেখভাল করছেন। বুথের সামনে শিশু কোলে নিয়ে অপেক্ষারত মায়েদের দীর্ঘ লাইন।
কথা হয় লাইনে দাঁড়ানো নাবিলা নামের এক নারীর সঙ্গে। তিনি উত্তরার আজমপুর থেকে ১ বছর ৫ মাস বয়সি মেয়ে নওশিনকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে এসেছেন।
তিনি জানান, পাঁচদিন ধরে বমি ও পাতলা পায়খানা নওশিনের। উত্তরার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে স্যালাইন ও সাপোজিটরি দেওয়ার পরও অবস্থার উন্নতি হয়নি। তাই মেয়েকে আইসিডিডিআর'বি-তে নিয়ে এসেছেন।
হাসপাতালটির চিকিৎসক শোয়েব বিন ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রতিবছর শীতের শুরুতে রোটা ভাইরাসজনিত ডায়রিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। যদিও ২০২২-২০২৩ সালের তুলনায় এ বছর রোগী ২০ শতাংশ বেশি। গত তিন সপ্তাহ থেকে আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৮৫০-৯০০ রোগী হাসপাতালে আসছেন। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকেও রোগী আসছে।
তিনি আরও বলেন, এ ডায়রিয়ায় অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই সমস্যা হয় বেশি। এই ডায়রিয়া ভালো হতে পাঁচ থেকে সাত দিন সময় লাগে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে বর্তমানে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন ১৩৪ জন।
কখন ডাক্তারের কাছে নিতে হবে
যদি দেখা যায় শিশু দুর্বল হয়ে নেতিয়ে পড়েছে, খেতে পারছে না কিংবা পানিশূন্যতা দেখা দিচ্ছে, তীব্র জ্বর, পায়খানার সঙ্গে রক্ত আসছে বা খিচুনি আসছে— তখন শিশুকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।
স্যালাইন বানাতে ও খাওয়াতে ভুল করা যাবে না
চিকিৎসক শোয়েব বলেন, স্যালাইন কোনো খাবার না, এটি একটি ওষুধ। স্যালাইনের গায়ে লেখা থাকে আধা লিটার পানিতে ঠিকমতো গুলিয়ে নিতে হবে। এটি করা না হলে ক্ষতি হয়। প্রতিবার পাতলা পায়খানার পরে প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে তত চামচ (৫ এমএল এর চামচে মেপে) স্যালাইন পানি খাওয়াতে হবে। যেমন- ৫ কেজি ওজনের শিশুকে ৫ চামচ, ১০ কেজির শিশুকে ১০ চামচ স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
এছাড়া শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে, রোটা ভাইরাস ভ্যাকসিন দিতে হবে, ঠান্ডা লাগানো যাবে না। ডায়রিয়া হলে প্যানিক না হয়ে ধৈর্য ধরে স্বাভাবিক খাবার ও স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
নিউমোনিয়া রোগীও বেড়েছে
জানুয়ারি মাসের প্রথম ৫দিনে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ১৩৯ জন, ভর্তি হয়েছে ১৯ জন। হাসপাতালটিতে বর্তমানে ৩১ জন নিউমোনিয়া রোগী ভর্তি আছে। এ মাসে এখন পর্যন্ত হাসপাতালটিতে দুজন রোগী নিউমোনিয়াজনিত রোগে মারা গেছেন।
আইসডিডিআর,বি হাসপাতালের ওয়ার্ড ও আইসিইউতেও নিউমোনিয়া রোগী ভর্তি আছে।
দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। আইসিডিডিআর,বি এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৪ হাজার শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। আর হাসপাতালে ভর্তি হয় অন্তত ছয় লাখ ৭৭ হাজার শিশু।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক ফালমনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কামরুজ্জামান কামরুল টিবিএসকে বলেন, শীতের কারণে নিউমোনিয়া ও কোল্ড ডায়রিয়া রোগী বেড়েছে। অভিভাবকদের নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলো জানতে হবে। নিউমোনিয়া হলে দেরি করা যাবে না, দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এটি মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা, যে কোনো মুহূর্তে রোগী ফ্যাটাল কন্ডিশনে চলে যায়।
নিউমোনিয়ার যেসব লক্ষণ আবহেলা নয়
তিনি বলেন, ০-২ মাসের শিশুর স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের হার প্রতি মিনিটে ৬০ বার, ২-১ বছরের জন্য ৫০-এর নিচে এবং ১-৫ বছরের জন্য ৪০-এর নিচে। কোনো বাচ্চা যদি জ্বর ও শ্বাষকষ্ট থাকে এবং রেসপেরেটরি রেট বেশি থাকে, যা খাচ্ছে সব বমি করে দিচ্ছে বা খাচ্ছে না এবং প্রতিবার শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় যদি বুকের খাচার নিচে দেবে যায়, তাহলে বুঝতে হবে বাচ্চার নিউমোনিয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এসব লক্ষণ দেখা দিলে নিকটবর্তী স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা চিকিৎসকেরা কাছে নিতে হবে। চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেবেন বাচ্চার নিউমোনিয়া হয়েছে কি না, ভর্তির বা অ্যান্টিবায়োটিক দরকার কি না। অপ্রয়োজনে ফার্মেসি দোকানির পরামর্শে শিশুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো যাবে না।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধে যা করতে হবে
ডা কামরুল বলেন, বাচ্চাকে ৬ মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়াতে হবে, ইপিআইয়ের সিডিউল টিকা দিতে হবে। বাইরে থেকে ফিরে শিশুর কাছে গেলে হাত ধুতে হব। অপ্রয়োজনে বাচ্চাদের বাইরে নেওয়া যাবে না।