নেতিবাচক ব্যক্তিত্বের মানুষেরা নিজেদের সহজে বদলাতে চান না কেন?
আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন ধরনের ব্যক্তিত্ব নিজের মধ্যে দেখতে ভালোবাসবেন? নিশ্চয়ই আপনার উত্তর হবে—এমন ব্যক্তিত্ব যা আপনাকে সফল, সুখী এবং অন্যদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। কারণ অন্যরা আপনাকে পছন্দ করলেই তারা আপনার পাশে ভিড়বে এবং আপনার উপর ভরসা করবে।
কিন্তু জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক চেলসি স্লিপ ও তার সহকর্মীরা মনে করেন, এসব তথাকথিত 'ভালো' অভ্যাসের সঙ্গে সফলতার সম্পর্ক আছে এবং তা স্কুল, কর্মক্ষেত্র, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, প্যারেন্টিং, মানসিক স্বাস্থ্য—সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু এই 'ভালো'র বিপরীতে আছে সেসব মানুষ, যাদের ওপর হয়তো ভাগ্য ততটা প্রসন্ন হননি—এবং নেতিবাচক ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলোই হয়েছে তাদের সঙ্গী। আর এর ফলাফলও যে ভালো হয়নি, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের কর্মকাণ্ডে। তাদের মধ্যে দেখা যায় কোনো খারাপ অভ্যাস, আগ্রাসী মনোভাব ও অসামাজিক আচরণ।
এসব বৈশিষ্ট্যর কথা শুনে আপনার মতে হতেই পারে যে, সেসব দুর্ভাগা ব্যক্তিরা নিশ্চয়ই যেকোনো উপায়ে নিজেদের ব্যক্তিত্ব বদলাতে রাজি। কিন্তু না! স্লিপ ও তার সহকর্মীরা বলছেন, কোনো কোনো শ্রেণীর মানুষ কেন নিজের এই সমস্যাযুক্ত স্বভাব বদলাতে আগ্রহী নন, তার কারণ এখনো অস্পষ্ট। এরকমই একটি সমস্যাপূর্ণ বিষয় হলো অ্যান্টাগনিজম বা বৈরীভাব।
অ্যান্টাগনিজমকে বাংলায় বিদ্বেষপূর্ণ অথবা নেতিবাচক আচরণ বলা যায়। অন্য কোনো ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির নিজস্ব বৈরীভাব বা বিরোধ থাকলে তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে অ্যান্টাগনিজম আছে বলে মনে করা হয়। যাদের মধ্যে এই মনোভাব বা ব্যক্তিত্ব দেখা যায়, তাদেরকে অ্যান্টাগনিস্টিক বলা হয়।
ব্যক্তিত্ব পরিবর্তনের পথে বাধা কী কী?
জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষকদের মতে, ৩টি অবস্থা রয়েছে যা বৈরীভাবাপন্ন মানুষদের তাদের এই ব্যক্তিত্ব আঁকড়ে ধরে রাখতে প্রেরণা দেয়। প্রথমত, তারা হয়তো নিজেকে পরিবর্তন করতে চায়ই না, যদিও তারা জানে যে এই মনোভাবের কারণে তারা নানা সমস্যায় পড়ছে। দ্বিতীয়ত, পুরোনো অভ্যাস ঝেড়ে ফেলে নতুন একটি পরিবেশে নতুন আচরণের মধ্যে জড়াতে হবে—এই ভেবে তারা নিজেদের বদলাতে চায় না। যদিও তারা এটাও জানেন যে নিজেকে বদলে ফেললে তারা আরো লাভবান হবেন।
উচ্চমাত্রায় বৈরী মনোভাবসম্পন্ন, আপনার পরিচিত কারো কথা ভাবুন। তারা সবসময়ই সবকিছুর নেতিবাচক দিকটি আগে খুঁজে বের করবে এবং যৌথ কাজে হাত লাগাতে অস্বীকৃতি জানাবে। হয়তো দেখা গেল, আপনারা দুজনে মিলে একটা প্রকল্পে কাজ করছেন এবং ওই ব্যক্তি শুধুই সমালোচনা ছাড়া আর কিছুই করছেন না; বরং আপনার সামনে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছেন! আপনি যতই তাকে বোঝানোর বা তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, তার কাছ থেকে শুধু অবমাননাকর ও বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যই পাবেন। এমনকি এক পর্যায়ে আপনি তার কাছে কোনো সাহায্য চাওয়াও বন্ধ করে দেবেন।
কিন্তু কোনোরকমে বিরক্তিকে পাশ কাটিয়ে আপনি কৌতূহলী হয়ে ভাবতেও পারেন, আচ্ছা, ঠিক কী কারণে ব্যক্তিটি নিজেকে বদলাতে চাইছেন না? তিনি কি বুঝতে পারছেন না যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে শত্রুভাবাপন্ন আচরণ করলে কার্যক্ষমতা অনেক কমে যায়? তারা কি বৈরী মনোভাব কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারেন না?
এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন স্লিপ ও তার সহকর্মীরা। অ্যান্টাগনিস্ট মনোভাব কমানোর ফলে কী কী লাভ ও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, তা সরাসরি খতিয়ে দেখেছেন তারা।
লাভ বনাম ব্যক্তিত্ব পরিবর্তনের বাধা
৭১৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, যাদের মধ্যে ৬৮৬ জনই প্রশ্নোত্তর পর্ব পার হয়েছেন, তাদের নমুনা নিয়ে কাজ করেছে জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক দল। তারা এদের মধ্য থেকে ২৫২ জনকে খুঁজে বের করেন, যাদের স্কোর তাদেরকে 'টেন আইটেম পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার'-এর শেষ প্রান্তে দাঁড় করিয়েছে। এই ২৫২ জনকে বলা হয়, ২৫টি আচরণগত বৈশিষ্ট্যের আলোকে (যেসব বৈশিষ্ট্য সমস্যাযুক্ত) নিজেদের বর্তমান আসল ব্যক্তিত্ব ও আকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিত্বের মাত্রাকে ১ থেকে ১০০-র মধ্যে রেটিং দিতে। প্রতিটি ডোমেইনে অংশগ্রহণকারীরা রেটিংয়ের মাধ্যমে জানান প্রতিটি বৈশিষ্ট্য কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনে সমস্যা তৈরি করছে। সেই সঙ্গে এসব বৈশিষ্ট্য বদলে ফেললে কী লাভ হবে এবং বদলানোর আগ্রহও পেয়েছে ১০-এর বেশি রেটিং।
এরপর তাদেরকে বলা হয় নিচের বিবৃতিগুলোকে রেটিং করতে:
১। আমার নিজের আচরণ বদলানোর মতো অনুপ্রেরণা নেই
২। আমি জানিনা কীভাবে বদলাতে হবে
৩। আমার মনে হয় আমি বদলাতে পারব না
৪। বদলানো খুবই কঠিন হবে
৫। বদলানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি
সবশেষে অংশগ্রহণকারীদের নিজের মুখের বক্তব্য শোনার পর গবেষকরা তাদেরকে কিছু ওপেন-এন্ডেড প্রশ্ন করেন, যেগুলোর বিস্তারিত জবাব দিতে পারবে অংশগ্রহণকারী।
রেটিং পর্বের ফলাফলে দেখা যায়, মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন যে তারা সত্যিই কম শত্রুভাবাপন্ন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে চান। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ২৩ শতাংশ লোক জানিয়েছেন যে তারা আরো বেশি বৈরী হতে চান মানুষের প্রতি! অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনে এই আচরণের ক্ষতিকর প্রভাব থাকা সত্ত্বেও তারা এর মধ্যে লাভ খুঁজে পেয়েছেন।
এবার ওপেন-এন্ডেড প্রশ্নোত্তর পর্বে আসা যাক। মানুষের প্রতি বৈরী আচরণের মাধ্যমে কীভাবে লাভবান হয়েছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে নেতিবাচক ব্যক্তিত্বের মানুষেরা জানিয়েছেন, এর মাধ্যমে তারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পেরেছেন। সামাজিকভাবে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন। নিজেকে সুরক্ষা দিতে পেরেছেন। এবং বৈরী আচরণের জন্য তাদের মধ্যে অপরাধবোধ কমেছে। সেইসঙ্গে নেতিবাচক আচরণের মাধ্যমে তারা অন্যের চিন্তা ও কাজে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন।
আগেই বলা হয়েছে যে অ্যান্টাগনিস্টিক মানুষেরা সবসময় সবকিছুর বিরোধী অবস্থান নিতে পছন্দ করেন, কারণ তাদের ধারণা এটি তাদেরকে পুরস্কৃত করবে। স্লিপ ও তার সহকর্মীরা দেখেছেন, এমন পরিস্থিতিতে তারা নিজেকে ক্ষমতাধর ভেবে আনন্দ পায়। তাদের আত্মবিশ্বাস অনেকগুণ বেড়ে যায়, কারণ তখন তারা অনেক বেশি লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ ও মনোযোগ আকর্ষণ করে।
তাহলে কি অ্যান্টাগনিস্টিক বা বৈরীভাবাপন্ন মানুষেরা কখনোই নিজেদের বদলাবে না?
স্লিপ ও তার সহকর্মীদের গবেষণা থেকে বলা যায়, খুব একটা আশা নেই এক্ষেত্রে। তবে গবেষকরা এখনো বিশ্বাস করেন, ব্যক্তিবিশেষে তাদের বৈরী আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে যখন তা ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে চলে যায়।
অ্যান্টাগনিস্টিক মানুষেরা নিয়ন্ত্রণ ও মনোযোগ আকর্ষণকে কতখানি গুরুত্ব দেয় তা থেকে পরামর্শ দেওয়া যায়, এ ধরনের মানুষের নেতিবাচক সমালোচনাকে নিজের মনের মধ্যে না নেওয়াই ভালো। তারা যখন সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করবে, তখন সঙ্গে সঙ্গে তাদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং উৎসাহ দিতে হবে। এর ফলে তারা বুঝতে পারবে যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েও মানুষের প্রশংসা পাওয়া যায় এবং মনে প্রশান্তি আসে।
এককথায় বলা যায়, ব্যক্তিত্ব পরিবর্তনের বিষয়টি যদি লাভ বনাম ক্ষতির হিসেবে দেখা হয়, তাহলে যৌক্তিকতা দিয়ে বিষয়টি দেখা উচিত। উচ্চমাত্রায় বিরোধী স্বভাবের মানুষেরা হয়তো আগের মতোই থাকতে চাইবে, কিন্তু আশেপাশের মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে তাদেরকে এখান থেকে উত্তরণের উপায় শিখতেই হবে।
- সূত্র: সাইকোলজি টুডে