রূপালী পর্দায় তলস্তয়ের শেষ দিনগুলো
বিশ্ব সাহিত্যের সবচেয়ে সার্থক উপন্যাস হিসেবে জনগণমনে আসন করে নিয়েছে ওয়ার অ্যান্ড পিস, সেই সাথে জনপ্রিয়তম লেখক হিসেবে পৃথিবীর কোটি কোটি সাহিত্যপ্রেমীর মনে চিরস্থায়ী সাহিত্যদেবতার আসন অলংকরণ করে নিয়েছেন লিও তলস্তয়, যার পোশাকি নাম ছিল কাউন্ট লিয়েফ নিকোলিয়েভিচ তলস্তয়। যদিও সেই নীল রক্তের রাজকীয় উপাধি তিনি মনেপ্রাণে ত্যাগ করতেই চেয়েছেন সর্বদা, কাউন্ট নন, সমাজের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই খুঁজতে-বুঝতে চেয়েছেন অন্যদের এই নশ্বর জীবনের ক্ষুদে ক্ষুদে আনন্দ-বেদনার কাব্য, অমর করে রেখেছেন তার পর্বতপ্রমাণ লেখনী শক্তি দিয়ে, যার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে তার মহাবিশ্বসম উপন্যাসগুলোতে, অমর ছোট গল্পগুলোয়, নাটক-প্রহসনে, দার্শনিক তত্ত্বে আর সাহিত্যজগতের সবচেয়ে রোমান্টিক উপন্যাস আন্না কারেনিনায়।
এমন সুবিশাল নাক্ষত্রিক জীবনকে কি রূপোলী ফিতের ফ্রেমে পুরোটা বাঁধা যায় না বোঝা যায়! তাই তো পরিচালক মাইকেল হফম্যান সেই বৃথা চেষ্টায় না যেয়ে তলস্তয়ের সুদীর্ঘ ঘটনাবহুল জীবনের শেষকটি দিন বেছে নিয়েছেন তার দ্য লাস্ট স্টেশন চলচ্চিত্রের জন্য, যেখানে মহান লেখক অতিবাহিত করেছেন তার জন্মস্থান, পারিবারিক সম্পত্তি ইয়াসনায়া পলিয়ানায়।
সাহিত্য জীবন শুরুর পর থেকেই শান্তিবাদী জীবনের দিকে আকৃষ্ট হওয়া তলস্তয় চেষ্টা করেছেন কি করে গণমানুষের কল্যাণ সাধন করা যায়। সমগ্র বিশ্বের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কাছে কুক্ষিগত সমস্ত সম্পদ আর অন্যদিকে বিকট দারিদ্রের করাল রূপ তাকে করে বিহ্বল তুলত সর্বদাই, যার পরিণতিতে এক শান্তিবাদী নবদর্শনের জন্ম দেন তিনি, যার অনুসারীরা পরিচিত ছিলেন তলস্তয়ান নামে, যাদের অন্যতম নেতা ছিল তলস্তয়ের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ভ্লাদিমির চের্তকভ।
এই নিয়েই সিনেমার ঘটনা পরিক্রমা শুরু- চের্তকভের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এক তরুণ তলস্তয়ান ভ্যালেন্তিন বুলগাকভ আসেন ইয়াসানা পলিয়ানায় তলস্তয়ের সেক্রেটারি হিসেবে হিসেবে, মহান সাহিত্যিকের মহানতর হৃদয়ের সত্যিকারের পরিচয় পেয়ে অভিভূত তরুণ চেষ্টা করে তার কাজে মনপ্রাণ ঢেলে দিতে সহযোগিতার। সেই খামারবাড়িরই এক প্রান্তে অন্যান্য অনুসারীদের সাথে থাকার নির্দেশ জোটে তার, সেই সাথে তলস্তয়ের জীবনের খুঁটিনাটি লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব বর্তায় নতুন কাজের অংশ হিসেবে।
আর তার জীবনে ঝড়ের মত প্রবল বেগে আসে প্রথম প্রেম, তলস্তয়ান দর্শনের এক অনুসারিণী মাশা (মারিয়া নামের রাশান সংস্করণ)।
এদিকে ঘটতে শুরু করে ঘটনা, ভ্যালেন্তিন বুলগাকভ অতি সহসাই বুঝতে পারেন মহামতি তলস্তয়ের দীর্ঘ জীবনের সহধর্মিণী কাউন্টেস সোফিয়া আন্দ্রেয়েভনা (তাদের দীর্ঘ ৪৮ বছরের দাম্পত্য জীবনে ১৩ সন্তানের জননী হন সোফিয়া, যদিও তাদের পাঁচজন শিশুকালেই মৃত্যুবরণ করে) তার স্বামীর এই সর্বমানুষের কল্যাণময় চিন্তাধারা তাদের ব্যক্তিগত সম্পদে প্রয়োগের ক্ষেত্রে চরম বিরোধী ছিলেন।
তলস্তয়ের মতধারা ছিল, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ মানুষের জন্য মন্দভাগ্যই ডেকে আনে, সমস্ত সম্পদই গরীব মানুষের সাথে সুষম বন্টন হওয়া উচিত। তার এই সাম্যবাদী চিন্তাধারা অনুপ্রাণিত করেছিল বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা মানবতাবাদীদের, যাদের অন্যতম ছিলেন সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত এক তরুণ আইনজীবী মোহন দাস গান্ধী। তলস্তয়ের সাথে তার ছিল পত্রযোগাযোগ, হয়ত সেই অনুপ্রেরণায়ই ঐ আইনজীবী পরিণত হত শান্তিবাদী আন্দোলনের প্রতীকে, পরিণত হন মহাত্মা গান্ধীতে (উল্লেখ্য, দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজীর আশ্রমের নাম ছিল তলস্তয় ফার্ম)।
যদি দার্শনিক স্বামী তাদের বিপুল সম্পত্তি, বিশেষ করে তার পাণ্ডুলিপিগুলোর স্বত্ত্ব অন্যদের দান করে দেন এই দুশ্চিন্তায় বৃদ্ধা সোফিয়া উদভ্রান্ত হয়ে যান, এই দুঃসহ চিন্তা কুরে কুরে খেতে থাকে তার সমগ্র অস্তিত্বকে। পরিণতিতে প্রায়শই ঋষিপ্রতিম জীবনসঙ্গীর সাথে অবতারণা ঘটে সংঘর্ষময় পরিস্থিতির।
সেলুলয়েডের পর্দায় বিশ্ব সেরা সাহিত্যিকের এই অশান্তিময় শেষ জীবনের গৃহদাহ পর্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সাথে, বিশেষ করে যেখানে তিক্ত-বিরক্ত, হতক্লান্ত তলস্তয় প্রায়ই স্ত্রীকে বলছেন- আমি কিন্তু তোমার এই সমস্ত কথার জ্বালায় আসল কাজ করতে পারছি না কিছুই! যদিও তলস্তয় বারংবার বলেছেন তার জীবনে প্রেমময়ী স্ত্রীর অনস্বীকার্য ভূমিকার কথা, জানিয়েছেন তাদের অসম্ভব সুখী যৌবনকালের কথা।
ভ্লাদিমির চের্তকভের আবির্ভাবে ঘটনা মোড় নিতে থাকে অন্যদিকে। নতুন উইল করে মহান জনসেবী লেখক তার সমস্ত সম্পত্তি দান করে দেন জনগণের কল্যাণের নিমিত্তে, কিন্তু কাউন্টেস সোফিয়া গোপনে স্বামীর রোজনামচা পাঠ করে জেনে যান এই গোপন ঘটনা! মুহূর্তে যেন বারুদের স্তূপে পড়ল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, কদর্য ভাষায় তলস্তয়কে আক্রমণ করেন সোফিয়া।
অবশেষে জীবনের শেষ দিনগুলোয় নিরিবিলিতে লেখালেখি ও অন্যান্য কাজের জন্য এক নীরব শেষ রাতে নিজের জন্মস্থান ছেড়ে অজ্ঞাত গন্তব্যে রওনা দেন আমাদের গ্রহের সেরা লেখক, সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধু তার ডাক্তার।
পরদিন প্রত্যুষে এই খবর পেয়েই জলে ডুবে আত্নহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা চালান কাউন্টেস, সেখান থেকে শেষ মুহূর্তে উদ্ধার পেলেও তার ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় স্বামীকে যে কোন মতে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আনা। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের কন্যা আনাও চুপিসারে বাড়ী ছেড়ে যোগ দেন বাবার সাথে। কাউন্টেস সোফিয়ার সাথে কেবলমাত্র রয়ে যান কেবল ভ্যালেন্তিন।
কিন্তু পরিকল্পনা মোতাবেক শেষ দিনগুলো আর অতিবাহিত হল না লেখকের, হয়ত যাত্রাপথের ধকলে, হয়ত মানসিক চাঞ্চল্য- নানা কারণে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি, আশ্রয় নিতে বাধ্য হতেন আস্তাপোভা নামের এক নাম না জানা অতি খুদে রেলস্টেশনে। খবর ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যুৎগতিতে, নির্জন স্টেশন হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ আর সাংবাদিকদের ভিড়ে লোকারণ্য।
শেষ মুহূর্তে প্রেক্ষাপটে উপস্থিত হতে দেখা যায় তার স্ত্রী সোফিয়াকেও, সাথে এক ধর্মের লেবাসধারী দামি জোব্বাওয়ালা ধর্মযাজক (প্রথাগত ধর্মের সাথে বিরোধ ছিল তলস্তয়ের মহান মানবতাবাদী দর্শনের, যে কারণে যাজকদের চক্ষুশূল ছিলেন তিনি। আবার ১৯০১ সালে দেওয়া প্রথম নোবেল সাহিত্য পুরস্কারটি তিনিই পাচ্ছেন এমনটি সমগ্র সাহিত্যজগৎ ধারণা করলেও তার লেখনী খ্রিষ্টীয় ধারণার পরিপন্থী- এই হাস্যকর কারণে যোগ্যতম লেখককে বঞ্চিত করা হয়। যদিও তলস্তয় বলেছিলেন এই পুরস্কারের অর্থ হয়ত তাকে কেবল অপব্যয়ী হতেই ইন্ধন যোগাত !)
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সম্ভবত স্বামী-স্ত্রীর থাকা সম্ভব হলো না মৃত্যুর শীতল স্পর্শে। তলস্তয়ের মৃত্যুর সাথে সাথে যবনিকা ঘটে সম্ভবত শেষ লিটারেচার জায়ান্টের, তার শেষ নিঃশ্বাস স্থান হিসেবে আস্তাপোভা হয়ে পড়ে বিশ্বখ্যাত, ঠিক তলস্তয়ের মহাপ্রস্থানের মুহূর্তটিতে সেই স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের ঘড়িটি বন্ধ করে দেওয়া হয় পরবর্তীতে, আজ পর্যন্ত সেটি সেই সময়ই দেখাচ্ছে। এই কারণে চলচ্চিত্রটির নাম 'দ্য লাস্ট স্টেশন' যেমন জীবনের শেষ দিনগুলির রূপকার্থে সার্থক তেমনি সার্থক বাস্তবিক অর্থে।
২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রের মূল আকর্ষণ তলস্তয়ের ভূমিকায় ক্রিস্টোফার প্লামার এবং তার স্ত্রী সোফিয়ার ভূমিকায় রূপদানকারী অস্কারজয়ী হেলেন মিরেনের অনবদ্য অভিনয়, দুজনেই সেরা অভিনয়ের অস্কার মনোনয়ন লাভ করেন সেবার।
সেই সাথে রুশ দেশের অবারিত প্রকৃতির খানিকটে ছোঁয়া, মুক্ত বনভূমি আর দিগন্ত ছোঁয়া শস্যক্ষেত্রের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করা হয়েছে আবেগ মোড়া দক্ষতার সাথে। সেই সাথে দর্শকের চোখ ও মন আটকে রাখে অসংখ্য তীক্ষ সংলাপ, যখন তলস্তয় নিজেই বলেন তিনি স্বয়ং একজন সঠিক তলস্তয়ান না, যখন তার স্ত্রী লেখকের যৌবনের উশৃঙ্খল দিনগুলির কথা বলেন আলতো অভিমানে, বৃদ্ধ দম্পতি শিশুতোষ আবেগ নিয়ে খুনসুটিতে মেতে ওঠেন।
আবেগ, ক্ষোভ, রাগ, শোক, ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ, সবকিছুর সন্নিবেশনেই দ্য লাস্ট স্টেশন হয়ে উঠেছে সাহিত্যপ্রেমীদের জন্যও এক অবশ্য দর্শনীয় চলচ্চিত্রে।
(আজ এই মহান সাহিত্যিকের মৃত্যুদিন)