কলকাতার ইংরেজি বইয়ের শেষ বিক্রেতা
পশ্চিম পাকিস্তানের দেরা গাজি খানে ছিল প্রেম প্রকাশের আদি বাড়ি। মা-বাবা ও দুই ভাই ভারতে চলে আসেন ১৯৪৬ সালে। ভারতে তাদের প্রথম ঠিকানা ছিল আগ্রা।
আগ্রাতেই প্রেম প্রকাশের বাবা তার প্রথম বইয়ের দোকান খুলেছিলেন। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের শিলংয়ে তিনি দ্বিতীয় দোকানটি শুরু করেন ১৯৪৯ সালে।
প্রেম প্রকাশের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৭১ সালে, তার বইয়ের দোকানে (আমি নিজেই একজন শরণার্থী হিসেবে ভারতে এসেছিলাম)। তার ইংরেজি বইয়ের দোকানটির নাম দ্য মডার্ন বুক ডিপো। কলকাতার বিখ্যাত সিনেমা হল লাইট হাউজের বিপরীতে ও নিউ মার্কেটের পাশেই দোকানটির অবস্থান।
গত সপ্তাহে কলকাতায় গিয়েছিলাম। তখন একবার ঢুঁ মেরে যাই ওদিকে প্রেম প্রকাশের খোঁজ নিতে। ভেবেছিলাম এতদিন পরে হয়তো তার আর সন্ধান পাওয়া যাবে না। কিন্তু গিয়ে দেখলাম এখনো দিব্যি দোকান সামলাচ্ছেন ভদ্রলোক।
দোকানের চেহারা সেই ১৯৭১ সালের মতোই আছে। এতদিন পরে তাকে খুঁজে পেয়ে বেশ আনন্দ হলো। অনেকক্ষণ আলাপ করলাম। আমাদের আলাপের একটা বিশেষ অংশ জুড়ে ছিল হাল সময়ে কলকাতার ইংরেজি বইয়ের বাজার পরিস্থিতি।
প্রেম প্রকাশের দুই সন্তান। তবে কারোরই বইয়ের ব্যবসায় আসার আগ্রহ নেই। একজন এখন যুক্তরাষ্ট্রে, অপরজন পশ্চিমবঙ্গের বাইরে। নিজে এখনো প্রতিদিন দোকানে আসেন। ব্যবসার চেয়েও দোকানে এখন সময় কাটানোটাই মুখ্য হয়ে গেছে তার জন্য।
প্রেম প্রকাশ জানালেন, পরিবারের সদস্য, ভবনের মালিক, আশপাশের হকার; সবার কাছ থেকে চাপ আসছে বইয়ের দোকান উঠিয়ে দিয়ে জায়গাটা অন্য ব্যবসার জন্য বিক্রি করে দিতে। দোকান থেকে এখন আর কোনো আয় হয় না তার। আজকাল খুব কম মানুষই দোকানে আসেন বই কিনতে।
বইয়ের দোকানের চেয়ে অনলাইন ব্যবসাতেই এখন লাভ বেশি। 'অরিয়েন্ট লংম্যান'-এর মতো ইংরেজি বইয়ের দোকানগুলো এখন কলকাতা থেকে ব্যবসায় গুটিয়ে নিচ্ছে। পুস্তকশিল্পের এ পরিণতির জন্য প্রেম প্রকাশ দায়ী করছেন বাংলার শাসকদল আর দিল্লিতে যারা ক্ষমতায় আছে তাদেরকে।
প্রেম প্রকাশ বলেন, 'কমিউনিস্ট ও তৃণমূলসহ সব শাসকদল বুদ্ধিজীবী, পেশাদারত্ব ও পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সব দলেরই লক্ষ্য কেবল নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করা। খবরের কাগজগুলোও এখন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রপাগান্ডা লিফলেটে পরিণত হয়েছে।'
তিনি বলেন, একসময় কলকাতার গর্ব ছিল 'স্টেটসম্যান'-এর মতো খবরের কাগজ। কিন্তু এখন কোনো পত্রিকাকেই বিশ্বাস করা যায় না, কোনোটিই আর জনগণের কথা ভাবে না।
প্রেম প্রকাশ মনে করেন, বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিই এমন যে, স্বৈরাচারী ও নকল গণতন্ত্রের ধারক শাসকেরা যেকোনো মূল্যে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। আর এটা করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো প্রথমে শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করা।
অভীক সরকার মমতাকে নিঃশর্ত সমর্থন দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় ক্ষমতায় আসার পর মমতার প্রথম কাজ ছিল আনন্দবাজার প্রকাশনীকে আক্রমণ করা। প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলো আজ ক্ষমতাসীন দলের শিক্ষার্থীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এগুলোতে স্বাধীনভাবে ছাত্ররাজনীতি বা বাকস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার সুযোগ নেই।
রাজনৈতিক সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস কয়েক দশকের অপশাসনকেই নির্দেশ করে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির একটা পুরো প্রজন্ম বাধ্য হয়ে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে অন্য রাজ্যে, এমনকি দেশের বাইরেও চলে গেছে।
কমিউনিস্টরা তাদের ৩৪ বছরের শাসনে প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে ও বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ভাগিয়ে দিয়েছে। বস্তুতপক্ষে পশ্চিমবঙ্গ মরিয়া ভাব থেকে অন্ধকারে চলে গেছে। এটি আদর্শের নামে খুব হিসাবনিকাশ করে চালানো পশ্চিমবঙ্গকে ধ্বংসের ভয়ংকর আখ্যান।
বিজেপির মোদিও দিল্লির মসনদে বসার পর গণমাধ্যমকে নিয়ে একই কাজ করেছে। বর্তমানে ভারতের বেশিরভাগ গণমাধ্যমই বিজেপির সমর্থক ও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকদের নিয়ন্ত্রণে। ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে কোনো মতামত প্রকাশ করা বা লেখা এখন প্রায় অসম্ভব।
আবেগাক্রান্ত প্রেম প্রকাশ আর তার দোকানের খালি তাকগুলো দেখে আমারও মন খারাপ হয়ে গেল। এ বয়সে এসে তিনি আর কলকাতায় ইংরেজি বইয়ের বাজারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হতে পারেন না।
তবে প্রেম প্রকাশ প্রতিজ্ঞা করেছেন, কলকাতার কেন্দ্রে অবস্থিত এ ইংরেজি বইটির দোকান তিনি নিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে যাবেন।
- সজল গুপ্ত: ইউএনএইচসিআর-এর সাবেক কর্মকর্তা