শারাবন তহুরা ৩৫ হাজার টাকা, অপরিণত পাপ ২২ হাজার- দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য বইয়ের এক ভাণ্ডারের খবর!
নতুন বই হাতে পেয়ে উল্টেপাল্টে সেটির পৃষ্ঠার ঘ্রাণ নেন না, এমন বইপ্রেমী লোকের সংখ্যা খুব কমই আছে। বইপ্রেমীদের কাছে পুরোনো বইয়ের ঘ্রাণও আরেক নেশার মতো। তাইতো এই তারা হন্যে হয়ে কয়েক দশক পুরোনো, মোটা লাল পৃষ্ঠার ধুলোজমা বই ও পত্রিকা খুঁজে বেড়ান। আর সেগুলো কোথাও খুঁজে পেলেই ছুটে যান তা সংগ্রহ করতে।
এই কাজটি করতে গিয়ে কেউ কেউ জমানো কষ্টের টাকা খরচ করতেও দু'বার ভাবেন না। কদরহীনের কাছে এসব বইপত্রের মুড়ির ঠোঙা বানানোর কাজে লাগানো ছাড়া অন্য কোনো উপযোগ না থাকলেও; বইপ্রেমীদের কাছে এগুলো যেন অমূল্য সম্পদ। পুরোনো, ধুলোপড়া, ছেঁড়া-ফাটা মলাটের এই বইগুলো কিছু লোকের কাছের যেন অমাবস্যার চাঁদের মতো। কারণ এগুলোর একটি করেই মূল কপি পাওয়া যায় যা প্রথম সংস্করণের, তাই পাওয়াই দুষ্কর একাধিক কপি।
প্রায় ৫/৬ বছর আগের কথা। নাটোরের বাসিন্দা এসএম শরিফুল ইসলাম (শরীফ) কিশোরগঞ্জ গিয়েছেন শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে। সময়টা বর্ষাকাল, হাওর অঞ্চলের চারিদিক তখন পানিতে থৈথৈ করছে। আর ঠিক পাশেই রয়েছে মিঠামইন হাওর। তিনি সেখানে বসবাসকালীন লক্ষ করলেন মুদি, চা ও পানের দোকানে লোকে আড্ডার পাশাপাশি এক ধরনের পুরোনো কাগজ কেনাবেচা করছে। কয়েকবছর পুরোনো পত্রিকারগুলোর মাত্র দুই পৃষ্ঠার দাম হাঁকানো হচ্ছে ২০ টাকা করে। যেখানে বর্তমানে পুরো পত্রিকার দাম মাত্র ১০ টাকা বা তার কম।
সেখান থেকেই শরীফুল ইসলামের আগ্রহ জাগে—তিনি এর পেছনের কারণ জানবেন। দোকানে আগত ক্রেতা-বিক্রেতাদের থেকে জানতে পারলেন এগুলো বাঁশের তৈরি কাগজ, যা পাকশী মিলে উৎপাদিত হতো। বহুবছর আগে পত্রিকা ও সরকারি গেজেট প্রকাশের জন্য এই কাগজ ব্যবহার করা হতো। লোকে আগে এগুলোকে পচা কাগজ বলে গণ্য করতো। বাঁশের তৈরি এই কাগজকে হাত দিয়ে মুড়িয়ে গ্রামের লোকে বিড়ি বানিয়ে খায়, তাই দুই ভাগের চার পৃষ্ঠার এই কাগজগুলো বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকা দরে। গ্রামের দোকানগুলো থেকে শরীফ ৩৫০ টাকা কেজি দরে পুরোনো পত্রিকা সংগ্রহ করা শুরু করলেন।
আগ্রহ থেকে সংগ্রাহক হয়ে ওঠা
শরীফুল ইসলাম আগ্রহ থেকে পুরোনো বই ও পত্রিকা সংগ্রহ করা শুরু করেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, দেশের সব জায়গায় পুরোনো বই কেনাবেচার জন্য নির্দিষ্ট কিছু লোক রয়েছে। তারপর নিজের সংগ্রহের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে ছুটে যান দেশের প্রতিটি জেলা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম আর মফস্বলে।
কিশোরগঞ্জ সদরের পাগলা মসজিদের পাশে অবস্থিত গোডাউনের মতো তার ছোট্ট দোকানটিতে আছে অসংখ্য মূল্যবান পুরোনো বই ও পত্রিকা। কালক্রমে এই বই ও পত্রিকাগুলো কেবল সে সময়কার ইতিহাসের কথাই বলছে না, ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের দলিল হয়ে যেন সাক্ষী দিচ্ছে।
অনেক অনেক ইতিহাস, ক্ষমতার রদবদল ও সময়ের সাথে বিকৃত হয়ে বর্তমান প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই সে সময় কী ঘটেছিল, তার সঠিক ইতিহাস জানতে-লেখক, গবেষক বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী ও বিশিষ্ট লোকজনেরা প্রতিনিয়ত সংগ্রাহক শরীফের সাথে যোগাযোগ করেন।
শরীফ বলেন, "আমি আগ্রহ থেকে পুরোনো বই,পত্রিকা, অচল পয়সা, টাকা, ডাকটিকেট, পুরাতন মডেলের রেডিও আর কয়েকশো বছরের পুরোনো থালা সংগ্রহ করতে শুরু করলাম। সে সময়, আমার ব্যবসায়িক কোনো পরিকল্পনা বা উদ্দেশ্য ছিল না। তাই সংগ্রহ করে সেগুলো নিজের কাছে রাখতাম। আমার স্ত্রী এই ব্যাপারে খুব বিরক্ত ছিল। তার কথা ছিলকেন আমি ধুলোবালিযুক্ত, ময়লা পুরোনো এই বইগুলো এনে মিছেমিছি ঘর ভর্তি করছি।"
"আমার সংগ্রহে থাকা বই ও পত্রিকার ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করার পর লোকজন আমার সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করে। কেউ কেউ এতো বেশি আগ্রহী ছিল যে বাড়তি দাম দিয়েও এগুলো কিনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আমার কাছে প্রতিটি বইয়ের একটি করেই মূল কপি থাকতো। তাই একজনকে দিলে অন্যদের দেওয়া সম্ভব হতো না, তা নিয়ে বাকিরা হা-হুতাশ করতেন।"
এভাবেই পুরোনো বইয়ের চাহিদা একদল লোকের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠলে, তাদের জন্যে পূর্বের চাল ব্যবসায়ী শরীফ হয়ে ওঠেন পুরোনো বইয়ের এই সংগ্রাহক। শরীফ নিজের সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি, সেগুলো প্রচার করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'ওল্ড কালেকশন' নামের একটি পেইজ খুলেন। সেখানে পুরোনো বই ও পত্রিকার ছবিসহ বিবরণ দেখে সারাদেশ থেকে ক্রেতারা অনলাইনে অর্ডার করেন।
এপর্যন্ত প্রায় ৬ হাজারের বেশি মানুষ তার থেকে পুরোনো বই ও অন্যান্য জিনিস ক্রয় করেছেন। শুরুর দিকে টাঙ্গাইল থেকে একজন ডাক্তার এক হাজার টাকায় একটি পুরোনো পত্রিকা কিনে নেন। শরীফ দেখলেন, কিছু লোকের কাছে এগুলো অনেক মূল্যবান।
১৯৬৭ সালে সেগুনবাগিচার সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত 'অপরিণত পাপ' নামের একটি বই বিক্রি হয়েছে ২২ হাজার টাকায়। উল্লেখ্য, বইটি মাসুদ রানা খ্যাত শেখ আব্দুল হাকিমের লেখা।
'শারাবান তাহুরা' নামের পুরোনো ও বহুল চাহিদাসম্পন্ন একটি বইয়ের দাম নির্ধারিত হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। এছাড়াও, সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গোয়েন্দা সিরিজের বইয়ের চাহিদাও বেশ পুরোনো বই সংগ্রকারী ক্রেতাদের কাছে। বর্তমানে তার 'ওল্ড অ্যান্ড রেয়ার বুক কালেকশন' নামের ফেসবুকে আরেকটি পেজ রয়েছে।
বই ব্যবসায়ী শরীফ জানান, "ক্রেতাদের মধ্যে কয়েকজন আছেন, যারা বইয়ের প্রথম সংস্করণের পুরোনো মূল কপি ছাড়া অন্য কোনো কপি নিবেন না। এক্ষেত্রে বইয়ের মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম দিতেও তারা রাজি। আমার সংগ্রহে ৮০-১০০ বছর পুরোনো বইও আছে। সেখান থেকে কিছু বই বিক্রি হয়ে গেছে। কিছু বইয়ের মূল কপি থেকে ফটোকপি না করায়, আমার কাছেও পরবর্তীতে সেগুলো থাকে না। তবে কেউ কম টাকায় ফটোকপি নিতে চাইলে তাদেরকে দেওয়া হয়।"
"১৩২০ বঙ্গাব্দের কয়েকটি পুথি সাহিত্যের বই আমি সযত্নে রেখে দিয়েছি। আগের দিনে গ্রামে গ্রামে পুথি পাঠের আসর বসতো, তখন এই পুথি সাহিত্যের ব্যাপক চল ছিল। এছাড়াও, পাকিস্তান আমলের জাতীয় পাঠ্যক্রমের কিছু বই আমার সংগ্রহে রাখা আছে। এই বইগুলো কেমন ছিল, তা জানতে আগ্রহ থেকে অনেকেই এগুলো অর্ডার করেন। কেউ কেউ আবার সন্তানদের জন্য বইগুলো অর্ডার করেন। তাদের সময় পড়াশোনা কেমন ছিল, বইয়ে কী কী থাকতো, তা সন্তানদের জানানোর জন্যে।"
পুরোনো বই সমাজে দিয়েছে সম্মান ও মর্যাদা
"বইয়ের সাথে থাকতে গিয়ে মানুষের থেকে যেমন সম্মান পেয়েছি, তেমনি পেয়েছি তাদের ভালোবাসা। সমাজের উচ্চ ও সম্মানিত ব্যক্তিরা আমাকে চেনেন এই বইয়ের জন্যেই। অনেকেই আমার সাথে যোগাযোগ করার পর ভাবেন, আমি হয়তো তাদের মূল বইটি দিতে পারব না। তাদের মধ্যে সংশয় কাজ করে—এতো আগের পুরোনো বই কারও কাছে থাকবে এটা অসম্ভব। কিন্তু, আমি যখন তাদের কাছে বই পৌঁছে দেই, তখন তারা আমাকে ধন্যবাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও চায়ের দাওয়াত দেন। আমার মতো মানুষের জন্য এটা অনেক বড় অর্জন"।
"কেউ কেউ আছেন আমাকে 'বইওয়ালা' বলে সম্বোধন করেন। তারা ভাবেন, পুরোনো বই সংগ্রহ করে বিক্রি করছি—এটা আবার কোনো পেশা হলো নাকি! কিন্তু আমি বলব—এই ধুলোবালির বইগুলো আমাকে জীবিকার সাথে আনন্দ ও সম্মান এনে দিয়েছে। তাই আমি গর্বের সাথে অন্যদের আমার পেশার কথা বলি। এভাবেই বইয়ের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থেকে, আমার দিন কেটে যাচ্ছে"—নিজের আবেগের কথা এভাবেই জানাচ্ছিলেন পুরোনো বই সংগ্রাহক ও বিক্রেতা শরীফ।
শরীফ নিজের সবচেয়ে আনন্দ ও ভালোলাগার গল্প বলতে গিয়ে পুরোনো বই খুঁজে পাওয়ার কিছু ঘটনার বর্ণনা দেন। মূল্যবান পুরোনো বই ও পত্রিকাগুলোর বেশিরভাগ তিনি ভাঙ্গারির ভাঙাচোরা দোকান থেকে পেয়েছেন। লোকজনের ফেলে দেওয়া অপ্রয়োজনীয় জিনিস থেকেই শরীফ খুঁজে নেন মূল্যবান কিছু। দোকানীদের সাথে সখ্যতাও গড়ে তুলেছেন বেশ ভালোমতোই। তাই তাদের দোকানে পুরোনো বই আসলেই তার ডাক পড়ে সেখানে।
বস্তাভর্তি ময়লা ও ধুলো থেকে একটি একটি করে প্রয়োজনীয় বই ও অন্যান্য জিনিস খুঁজে বের করেন শরীফ। এই কাজটি করতে তার মধ্যে প্রচন্ড ভালোলাগা কাজ করে। ধুলা ও ক্লান্তির ঘামে তার জামাকাপড় নষ্ট হলেও; তিনি সেখানে খুঁজে যান মণিমাণিক্য; তাই যা পান, তা যেন তার কষ্ট ও খাটুনি ভুলিয়ে দেয়।
মাঝেমধ্যে প্রয়োজনীয় কোনো কিছু না পেয়ে হতাশ হয়েও ফিরে এসেছেন শরীফ। কিন্তু তার নিজেকে নিয়ে আক্ষেপ কাজ করে এই ভেবে—তিনি যত বেশি বইয়ের সাথে নিজেকে জড়িয়েছেন, ততোই তার নিজের বই পড়ার অভ্যাস ও আগ্রহ কমে গিয়েছে। এ যেন প্রিয় কিছুকে পাওয়ার পর তাকেই অবহেলা করার মতোন।
সংগ্রাহক শরীফের ভবিষ্যত পরিকল্পনা রয়েছে নিজ জেলা নওগাঁতে একটি লাইব্রেরি কাম বই জাদুঘর গড়ে তোলার। যেন পাঠক ও বইপ্রেমীরা সেখানে এসে দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য বই ও পত্রিকা দেখতে পারেন। একদিন বদ্ধ তার বইয়ের গোডাউনটি যেন হয়ে ওঠে পাঠক ও বইপ্রেমীদের প্রিয়স্থান—এটাই শরীফের ভবিষ্যতের লক্ষ্য।