সালিমুল হক: একজন জলবায়ু বিপ্লবী
গেল মাসে মিশরে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন, কপ-২৭ এর শেষ মুহূর্তে যখন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা ক্লান্ত হয়ে সোফায় এলিয়ে পড়েছেন, সালিমুল হক তখনও হতাশ হননি। নিজের ফোনে একের পর এক মেসেজ চেক করে যাচ্ছিলেন তিনি।
বৈঠকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে তখনও সবার একমত হওয়া বাকি। নেচার ম্যাগাজিনকে তিনি বলেছেন, তখনও তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, সম্মেলনে যোগ দেওয়া বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা নতুন ধরণের জলবায়ু তহবিল গঠনের বিষয়ে সম্মত হবেন। এমন একটি তহবিল, যেটি জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশগুলোর 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' (ক্ষতি)-এর ব্যয়ভার বহন করবে।
তিনি বলেছিলেন, "চিন্তা করবেন না, এমনটি হওয়ার পথেই আছে।"
এবং হয়েছিলও তাই। লোহিত সাগরের তীরবর্তী শরম আল-শেখ শহরে স্বাক্ষরিত হয় সেই চুক্তি। তাতে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য তৈরি করা হয়েছে একটি লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল। বিশ্বের উচ্চ কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর ক্ষতির দায়ভার স্বীকার করেছে চুক্তিতে। তারা এই দেশগুলোর কাছে নিজেদের আর্থিক দায়বদ্ধতার স্বীকৃতি দিয়েছে।
আর জলবায়ু অন্দোলনের এই সাফল্যের পিছনে রয়েছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানী সালিমুল খান। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই আন্দোলনের অনানুষ্ঠানিক নেতা হিসেবে ভূমিকা রাখছেন।
সালিমুল হক মূলত একজন উদ্ভিদ-জীববিজ্ঞানী; বর্তমানে ঢাকায় ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট- এর পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগে সালিমুল হকের বাবা পাকিস্তান সরকারের অধীনে কূটনৈতিক চাকরি করতেন। সেই সূত্রে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতেই জন্ম হয় সালিমুল হকের। কিন্তু তার বাবা-মা ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। ফলে যুদ্ধের সময় সপরিবারে তারা পাকিস্তানি আর্মির চোখ এড়িয়ে আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।
তবে সালিমুক হকের বেড়ে ওঠা ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। বাবার কূটনৈতিক বদলির জেরে ছোট থেকেই তিনি নানান জায়গার অভিজ্ঞতা নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।
এখন থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে বায়োকেমিস্ট্রি (জৈব রসায়ন) পড়তে লন্ডনে পাড়ি জমান সালিমুল হক; লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। পরে বাংলাদেশে ফিরে এসে আতিক রহমানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস)। তাদের এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বে ইন্ডিপেন্ডেন্ট থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত; পরিবেশ নীতি নিয়ে গবেষণাই হলো এর প্রধান কাজ।
বাংলাদেশের প্রধান প্রাকৃতিক বিপর্যয় বন্যা নিয়ে কাজ করছে সালিমুল হকের প্রতিষ্ঠান। তিনি এবং তার সহকর্মীরা বাংলাদেশ সরকারকে পরিবেশ নিয়ে গবেষণায় একটি আলাদা বিভাগ খোলার জন্য রাজি করিয়েছিলেন। এবং সেটি গঠনে বিসিএএসের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। এমনকি, বাংলাদেশের প্রথম পরিবেশ বিষয়ক কর্মপরিকল্পনা বানাতেও সহায়তা করেছে তার প্রতিষ্ঠান বিসিএএস।
শুধু দেশেই নয়, সালিমুক হকের কর্ম পরিধি রয়েছে বিশ্বজুড়ে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু গবেষক লিসা শিপার জানান, জলবায়ু গবেষকদের বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছেন সালিমুক হক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতির মুখোমুখি অঞ্চলগুলোর অভিযোজনের উপায়, বন্যার প্রতিরক্ষাব্যবস্থার উন্নতি বা পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে ফসলের ধরনের সামঞ্জস্য তৈরির মতো বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা হয় তার প্রতিষ্ঠিত গবেষকদের এই প্ল্যাটফর্মে।
২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তি নিয়ে বিশ্ব শক্তিগুলোর মধ্যে নানান জটিলতা তৈরি হলেও এবারের কপ-২৭ সম্মেলনে নিজেদের দায়বদ্ধতা মেনে নিয়ে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর পাশে দাঁড়াতে অনেকটাই নমনীয় এবং সম্মত হয়েছে ধনী দেশগুলো। আর এতে বাংলাদেশি-ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সালিমুল হকের অবদানের কথা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। তার অবদান বিশ্ব মিডিয়ায় তুলে ধরেছেন বিশ্বের অন্যান্য জলবায়ু বিজ্ঞানী ও গবেষকরাও।