কেন মায়ের দোয়া নাম রাখতে ভালোবাসেন দোকানিরা?
দেড় কিলোমিটার পথে ১৩টি মায়ের দোয়ার দেখা পেলাম। এর মধ্যে সেলুন ১টি, চটপটির দোকান ১টি, মুদি দোকান ১টি, কনফেকশনারি ১টি, দর্জির দোকান ২টি, টি স্টল ৩টি, টেলিকম সার্ভিসের দোকান ২টি এবং ১টি হোটেল। পথে হয়তো আরো দু'চারটি ছিল, সব তো চোখে পড়ে না। ঢাকায় দোকানের নাম দেখতে দেখতে পথ চললে গাড়ি চাপা পড়ার সম্ভাবনা ১০০ পারসেন্ট না হলেও ৯৯ পারসেন্ট তো বটেই। ওই ১৩টি দোকানের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরটি হলো, একটি চায়ের স্টল। দোকানের ভিতরের শেষ দেওয়াল যেটি রাস্তার দিকে মুখ করা, তাতে একটি সূর্যের মাঝখানে মায়ের দোয়া লেখা, আর সূর্যটি থেকে ছড়াচ্ছে অনেকগুলো রশ্মি। আলমগীর কুমকুম পরিচালিত মায়ের দোয়া ছবিতে যেভাবে কথাটি লেখা হয়েছে এখানেও তেমনটিই দেখতে পেলাম।
উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মায়ের দোয়া ছবির শ্রেষ্ঠাংশে আছেন আলমগীর, শাবানা, অরুনা বিশ্বাস, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। খোশনূর আলমগীর এ ছবির প্রযোজক ছিলেন। ছবির গল্প লিখেছেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু।
মিরপুর ছয় নম্বর মসজিদ মার্কেট থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম। মাঝখানে চিলতে পায়ে চলার রাস্তা রেখে দুই পাশে সারি সারি দোকান। কাপড়ের, জুতার, ঘর সাজানোর, চালের দোকান এগুলো। তবে বেশি আছে মুদি মালের দোকান। দোকানের নামের দিকে চোখ রেখে চলেছি। চাঁদপুর, নোয়াখালি ইত্যাদি জেলার নাম ধরেও বেশ কিছু দোকানের নাম। আরো আছে সততা, বন্ধু ইত্যাদি নামও। তবে বিসমিল্লাহ, ভাই ভাই, আল্লাহর দান নামের দোকানের সংখ্যা সে তুলনায় অনেক বেশি। অবশ্য আজ আমাদের লক্ষ্য মায়ের দোয়া।
রাস্তার ধারে তালুকদার বেকারির উল্টোদিকে মায়ের দোয়া পেয়ে গেলাম। মুদি মালের দোকান। শত শত পণ্য দোকানে। ছোট্ট একটু ফাঁকা জায়গা পেয়ে নাতিউচ্চ এক টুলের ওপর বসে আছেন একজন। বয়স পঞ্চাশের কম হবে না। জানলাম, তিনিই মহাজন। দোকানের বয়স ১০ বছর। দোকান খোলার আগেই নাম ঠিক করে রেখেছিলেন। মহাজনের মায়ের বয়স ৮৫। এখনো শক্তপোক্ত আছেন। বরিশালের বানারীপাড়ায় বাড়ি। দিন কয় আগে মা একা একা বাড়ি বেড়িয়ে এসেছেন। বলছিলেন, "মায়ের জন্যই দুনিয়ায় আসতে পেরেছি। মা যদি পেটে না ধরতেন, তবে আজকের আমি কোথায় থাকতাম! মায়ের সঙ্গে পরামর্শ না করে আমি কোনো কাজ করি না। কোনো বিপদে পড়লে আগে মায়ের কাছেই যাই, সমস্যা খুলে বলি, মা যেমন বলেন তেমন তেমন কাজ করি। মায়ের দোয়া না থাকলে হজ্বও কবুল হয় না।"
মসজিদ মার্কেট ছাড়িয়ে মিরপুর বাংলা স্কুলের দিকে কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর পেলাম মায়ের দোয়া চটপটি। সন্ধ্যা ৭টায় চটপটি দোকানে ভিড় হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখানেও তার ব্যতিক্রম পেলাম না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম যদি একটু ফুরসত মেলে, কিন্তু দোকানির দম ফেলার সুযোগ হচ্ছে না দেখে নতুন দোকানের সন্ধানে পা বাড়ালাম।
বাংলা স্কুলের উল্টোদিকে ছোট একটা গলি পাড়ার ভিতরে ঢুকে গেছে। সেখানে একটি কনফেকশনারি। নাম, মায়ের দোয়া। দোকানির নাম গোলাম মোস্তফা। চাঁদপুরে বাড়ি। দেওয়ান বংশ তাদের। ১১ মাস হয় দোকানের বয়স। আগে মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন মোস্তফা। করোনায় আটকা পড়ে আর যেতে পারেননি। মহল্লার ভিতরে দোকান, আশংকা ছিল বেশি বেচা-বিক্রি হবে না। কিন্তু মায়ের দোয়ার বরকতে চলে ফিরে খেতে পারছেন।
বললেন, "বিদেশে যখন আছিলাম একদিন মায়ের সঙ্গে কথা বলা মিস হলেই মনটা মোচড়াইত। আগে তো ভিডিও কল বেশি আছিল না, মা ফোনও ধরত উল্টাপাল্টা, কথার উত্তরে খালি হু হা করত, আর তাতেই দিল ঠাণ্ডা হয়া যাইত। মায়ের লগে থাকলে যত শান্তি, তা আর কোথাও পাই না। নবীজী বলছেন, মায়ের দিকে নেক নজরে তাকাইলেও সোয়াব হয়।"
স্কুল ডানে রেখে বাঁ দিকে চলন্তিকা মোড়। মোড় থেকে দুটি রাস্তার একটি গেছে মিল্ক ভিটার দিকে অন্যটি পূরবী সিনেমা হলে গিয়ে ঠেকেছে। পাঁচ টাকার একটি কয়েন দিয়ে টস করলাম, শাপলা উঠলে পূরবী হলের পথ ধরলাম। অল্প কিছুদূর যাওয়ার পরই একটি মায়ের দোয়া পেয়ে গেলাম।
একজন প্রায় বৃদ্ধ, কিন্তু শক্তপোক্ত লোক চায়ের দোকানটি সামলাচ্ছেন। দোকানে ভিড় তেমন নেই দেখে সাহস করে এগোলাম। সালাম বিনিময়ের পর জানতে চাইলাম, মা কে কি খুব ভালোবাসেন?
উত্তরে তিনি বললেন, "মায়ের সমান ভালো তো আর কাউকে বাসি না।"
সেজন্যই দোকানের নাম মায়ের দোয়া রেখেছেন?
"দ্যাখেন, মায়ের দোয়া যে পায় সে ভাইসা থাকে, আর যে বদদোয়া পায় সে ডুইবা যায়। মায়েরে খুশি না করতে পারলে আপনের আল্লাহও বেজার হয়। একজনের কথা শুনছিলাম, সে মাকে কষ্ট দিয়ে সৌদি আরব গেছে। সেখানে মক্কা শরীফে হাজীদের বেডিং পত্র গোছাইয়া রাখার কাজ করত। একদিন কাজ করতে গেলে বুকে খুব ব্যথা ওঠে। একসময় টিকতে না পেরে কাজ ফেলাইয়া নিজের থাকার জায়গায় চলে আসে। তখন আর ব্যথা ছিল না। পরের দিন আবার কাজে গেলে একই অবস্থা। তার পরের দিনও একই ঘটনা। এক বন্ধু তাকে এক আলেমের কাছে নিয়ে যায় যেন একটু দোয়া পড়ে দেয়। আলেম জানতে চায়, সে দেশে কোনো মন্দ কাজ করে আসছে কি না, লোকটি স্বীকার করে, আসার আগে সে মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। আলেম তাকে তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে গিয়ে মায়ের কাছে মাফ চেয়ে আসতে বলে।"
এই ঘটনায় কী বোঝা গেল?
দোকানি যোগ করেন, "মা হইল আসল। মায়ের মনে ব্যথা দিলে দ্বীন-দুনিয়া সব নষ্ট। এক জুম্মাবারে হুজুরের কাছে শুনছি, এক সাহাবী আইসা নবীজীকে পরপর তিনবার জিজ্ঞেস করেছেন, দুনিয়াতে কার হক বেশি? নবীজী তিনবারই উত্তর দিয়েছেন, মায়ের। বাবার কথা বলেছেন চতুর্থবারে। দোকানের নাম মায়ের নামে রাখলেই হবে না কেবল, মোহাব্বত রাখতে হবে অন্তরে। তবেই নাম রাইখা বরকত পাইবেন। ইদানিংকার পোলাপাইন মা-বাবার কথাই হোনে না। মা বাবারে তারা পুরাইন্যা কালের মনে করে, নিজেরে মনে করে নয়া দুনিয়ার। মা-বাবার লগে কথা কওনের টাইমও তাগো নাই।"
আপনার ছেলে মেয়েরা কেমন, আপনাদের মানে?
"আমরা গাঁও গেরামে বড় হইছি। পরিবার গ্রামেই রাখছি। ছেলে-মেয়েরা আমাগো কথার বাইরে পাও বাড়ায় না। আমরা যেমন বাবা-মারে ভালোবাসি তারাও আমাদেরকে ভালোবাসে। এখনকার বাবা-মায়েরাও দ্যাখেন গিয়া ডিজিটাল হয়া গেছে। নিজেরা ডিস্কো, পোলাপাইনও ডিস্কো।"
দোকানিকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে এগোতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরেই ওই সুন্দর দোকানটি পেলাম যেটায় মায়ের দোয়া কথাটি সূর্যের মাঝখানে লেখা। দোকানি কিশোর পেরিয়েছে সবে।
জিজ্ঞেস করলাম, দোকান কি আপনার নিজের? সে উত্তর দিল, "না আমি মাঝে মধ্যে টাইম দেই। দোকানটি এলাকার এক বড় ভাইয়ের।"
জানলাম, দোকানের নাম বড় ভাই দিয়েছেন। দোকান সাজিয়েছেনও তিনি। রাত দশটার পর তাকে পাওয়া যেতে পারে।
তাই আবার পা বাড়ালাম। এবার পেলাম কামাল শিকদারকে। তার দোকানের নাম, মায়ের দোয়া কাটিং টু ফিটিং। পাশেই একটা ব্যানারে লেখা, এখানে শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি, পাজামা চাপানো হয়। শার্ট ফুল ফিটিংয়ের মজুরি লেখা আছে ১২০ টাকা, প্যান্ট চাপানোর জন্য নেওয়া হয় ৮০ টাকা। কামাল শিকদার গার্মেন্টে অপারেটর হিসেবে কাজ করেছেন ১৭ বছর। লতিফা নামের এক নারীকে তিনি ওস্তাদ পেয়েছিলেন। মেয়েদের সব রকম পোশাক তৈরির দক্ষতাও আছে তার। এই এলাকা মানে মিরপুর ৭ নম্বরে একাধিক গার্মেন্ট আছে। প্রচুর ডিফেক্টেড মাল (প্যান্ট, শার্ট ইত্যাদি) ইতিউতি ভ্যানে করে বিক্রি হয়। আর সেগুলো ফিটিং করাতে আসে যুববয়সী ছেলের দল।
কামাল শিকদারের বাড়ি স্বরুপকাঠি। চৌদ্দ বছরে বয়সে তার বিয়ে হয়। এখন বয়স ৩৭-৩৮ বছর। বলছিলেন, "জীবনে কোনোদিন কারুর কাছে ঠেকি নাই। ১১ দিনের মাথায় হেলপার থেকে অপারেটর হইছি। মায়ের দোয়া ছাড়া সম্ভব?"
"দিনকয় আগে মা একবার অসুস্থ হয়া পড়ছিল, স্ত্রীকে বাড়িতে পাঠায়া দিছি। মা যতদিন বেঁচে আছে, বাড়িতেই থাকবে। আমার এখন খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নাই, হোটেলে খাই মন চাইলে, আর খাইও না সময় সময়। তবে কোনো কষ্টই কষ্ট না যদি মায়ের মুখে হাসি দেখি, যোগ করেন কামাল।
কামাল শিকদার রাত এগারটা পর্যন্ত দোকানদারি করেন। কোনো কোনো দিন আরো বেশি রাত হয়ে যায়। তবে যতই ব্যস্ততা থাকুক মায়ের সঙ্গে দিনে তিনবার কথা বলার সময় ঠিকই বের করে নেন। তার দুই সন্তান। সন্তানদের নামেও দোকানের নাম রাখার কথা মাথায় এসেছিল, কিন্তু মায়ের ওপরে কেউ নেই ভেবে সে চিন্তা বাদ দিয়েছেন।
কামালের দোকান ছাড়িয়ে ডানদিকে আরেকটি পথ গেছে, তার দুধারে কাঁচাবাজার বসেছে। বেশ ভিড়, গার্মেন্ট ছুটি হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। কর্মীরা বাজার করে ঘরে ফিরছেন। এখানে মায়ের দোয়া নামে একটি সেলুন পেলাম, কিন্তু কথা বলার সুযোগ মিলল না। মায়ের দোয়া নামের ছোট একটা হোটেলও দেখলাম, কিন্তু ভিড় দেখে আর এগুলাম না। শেষে মায়ের দোয়া হোল বাটন নামের এক দোকান দেখে এগিয়ে গেলাম। সেখানে তিনটি আধুনিক সেলাই মেশিন। প্রথমে যাকে পেলাম তিনিই দোকান মালিক।
তিনি বললেন, "আমরা মুরুক্ষ মানুষ, বেশি লেখাপড়া করতে পারি নাই। ছোটবেলায় শুনছি মায়ের পায়ের তলায় বেহেশত, সেটাই মনে রাখছি, আর সে মতোই চলি। দুই দিনের এই দুনিয়া লইয়া বেশি ভাবনা চিন্তা করি না। বেহেশতে অনন্ত জীবন, সেটা পাইতে হইলে মায়ের সেবা করতে হবে। এইটাই বুঝি, আর মেনে চলি। মায়ের কোনো কষ্ট হতে দেই না। এমুন মা পাইছি ভাই, কোনো চাহিদা নাই, খাওয়ার মধ্যে একটু আঙুরের শখ। প্রতিদিন বাসায় যাওয়ার সময় আর কিছু না হোক আঙুর নিয়া যাই।"
হাঁটতে হাঁটতে পূরবী সিনেমা হলের কাছে বড় রাস্তায় পৌঁছলাম। একটা নীল রঙের কাভার্ড ভ্যান রাস্তার একধারে পার্ক করা দেখলাম। তার গায়ে লেখা মায়ের দোয়া পরিবহন। আরো লেখা, মা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ নেয়ামত।
রাত ভারী হয়ে আসছে। দশ নম্বর গোল চক্করের দিকে এগোচ্ছি। ডেল্টা হাসপাতাল, স্বপ্ন সুপার শপ পার হওয়ার পর একটি খাবারের টং ঘরের নাম দেখলাম, মায়ের দোয়া বার্গার। দোকানির বয়স বেশি না। বিশ অথবা বাইশ।
বললেন, "ভাই মায়ের দোয়াতেই বাঁইচা আছি, নাইলে কবেই উইড়া যাইতাম!"