স্বামী হারিয়ে দৌলতন্নেছা পেয়েছিলেন ১৩৩ টাকা ৫০ পয়সা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে!
একাত্তরের ২৫ জুলাই সোহাগপুরের রং হয়ে উঠেছিল লাল। পুরো গাঁ বেদনায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল ক্ষণে ক্ষণে। ভয়ে বাতাসও বইছিল না। সকাল ৭টা থেকে ৯টার মধ্যে মাত্র ২ ঘণ্টায় পাকবাহিনী ১৮৭ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। বিধবাপাড়া নাম পায় সোহাগপুর।
শেরপুর নালিতাবাড়ির এই গ্রামে দু-একজন ছাড়া আর কোনো পুরুষ বেঁচে ছিল না। তবে যুদ্ধে গ্রামটির নারীদের স্বামী হারানোর ইতিহাস আরো পুরোনো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের একটি নথিও তেমনই সাক্ষ্য দিচ্ছে। তখন সোহাগপুর ছিল ময়মনসিংহের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের আন্ডারে।
গ্রামটির এক যুবক, বয়স বুঝি ২০-২৫, জাহাজে খালাসির চাকরি নিয়েছিলেন। যে জাহাজে চাকরি নিয়েছিলেন সেটির নাম 'সিটি অভ ওয়েলিংটন'। ৫ হাজার ৭৩৩ টন ওজনের এ জাহাজটি তৈরি হয়েছিল ১৯২৫ সালে গ্লাসগোতে। লন্ডনের এলারম্যান লাইনস ছিল এর মালিক।
জার্মান বাহিনীর ডুবোজাহাজ ইউ-৫০৬ দিয়ে ব্রিটিশদের এ জাহাজ আক্রান্ত হয় ১৯৪২ সালের ২১ আগস্ট। আটলান্টিক পাড়ের ফ্রি টাউনের দিকে চলছিল তখন জাহাজটি। ইউ-৫০৬ টর্পেডো ছুড়ে 'ওয়েলিংটন'কে ডুবিয়ে দেওয়া।
'সিটি অভ ওয়েলিংটনে'র ৭ জন কর্মীর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাদের একজন ছিলেন সোহাগপুরের আমিনউদ্দিন। তারপর কোলকাতার মেরিন হাউজের শিপিং মাস্টার চিঠি পাঠান ময়মনসিংহের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে। চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়, আমিনউদ্দিনের আয়ের ওপর নির্ভরশীল পোষ্যদের নাম ও পরিচয়। ভারতে ব্রিটিশ সরকার পোষ্যদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি ওই চিঠিতেই নিশ্চিত করে।
এ প্রেক্ষিতে 'রিপোর্ট অন দি এয়ারস অ্যান্ড ডিপেন্ডেন্টস অভ ডিসিজড সিম্যান' শীর্ষক যে প্রতিবেদন প্রস্তুত হয় তা এমন: লস্কর বা খালাসির নাম আমিনউদ্দিন, পিতার নাম আমির। স্ত্রীর নাম দৌলতন্নেছা বিবি, বয়স ১৫।
প্রতিবেদনে আমিনউদ্দিনের সন্তানদের নাম-পরিচয় লিপিবদ্ধ করার জায়গাগুলো শূন্য। সেক্ষেত্রে দৌলতন্নেছাকেই তাঁর একমাত্র পোষ্য হিসাবে নথিভুক্ত করা হয়। দৌলতন্নেছা সম্পর্কে আরো বলা হয়, তিনি বর্তমানে তাঁর পিত্রালয়ে অবস্থান করছেন। ১৯৪৩ সালের কোনো এক সময় দৌলতন্নেছার জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ পোস্টাল মানি অর্ডার মারফত ১৩৩ টাকা ৫০ পয়সা বরাদ্দ হওয়ার রসিদ পাওয়া যায়।
ইতিহাস বলে, পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই কোম্পানির জাহাজে বাঙালি লস্কররা কাজ করতে শুরু করে। তখন সারেংয়ের সহযোগী হিসাবে লস্কর বা খালাসির কাজ পেত বাঙালিরা। দীর্ঘ যাত্রায় বিলাতি সিম্যানদের মৃত্যু ঘটত। কেউ কেউ জাহাজ তীরে ভেড়ার পর পালিয়েও যেতেন। তাই ফেরার পথে ভারতীয় তথা বাঙালিদের সিম্যান করে নিয়ে যেত ইংরেজ বণিকরা। লস্করের কাজ তো সহজ নয়, ইঞ্জিনরুমে দিনরাত ভয়ংকর শব্দ হতো, কয়লা আগুনে ছুড়ে মারতে গিয়ে অনেকে গরমেই মারা যেত, মাঝেমধ্যে ইঞ্জিনই বিস্ফোরিত হতো। তার ওপর ছিল ঝড়-ঝঞ্ঝা, রোগ-ব্যাধি।
তাহলে কেন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে যাওয়া? বাংলা সুজলা-সুফলা বহুকাল ধরেই। চাল-ডাল-মাছের সঙ্গে চুন, লবণ, চায়েও বাংলা ছিল সমৃদ্ধ। তবু বাঙালি খেয়ে না-খেয়ে দিন গুজরান করত, উচ্ছেদ হতো ভূমি থেকে। মধ্যস্বত্বভোগীরা সবসময় বাংলার চাষি, জেলে, জোলাদের খাবারে ভাগ বসিয়েছে, কখনো কখনো পুরোটাই নিয়েছে কেড়ে। ওইসব মৃত্যুমুখী ভুখা বাঙালির তাই সাগরে যাওয়াটা আর ভয়ের কিছু ছিল না।
ইংরেজ শাসনামলে দফায় দফায় দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ তো বটেই, কোটি মানুষও মারা গেছে। যেমন পলাশীর যুদ্ধের মাত্রই এক যুগ পরে ১৭৬৯ সালের দুর্ভিক্ষে মারা গেছে ১ কোটি মানুষ। অথচ কোম্পানি দুর্ভিক্ষের পরের বছরই খাজনা তুলেছিল ১ কোটি ৫৭ লাখ ২৬ হাজার টাকা বেশি।
ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকেও তেতাল্লিশের মন্বন্তরে পথে পথে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কংকালসার দেহ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে সাগরকে ভয় পাওয়ার কারণ আর কত থাকতে পারে?
এক হিসাব থেকে জানা যাচ্ছে, ১৮০৩-১৮১৩ সালের মধ্যে ১০ হাজার ভারতীয় লস্কর ব্রিটেনের বন্দর নগরীগুলোতে পা রেখেছেন। কেবল ১৮৪২ সালে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৩ হাজারে। ১৮৫৫ সাল থেকে ফি বছর ১২ হাজার লস্করের সন্ধান মিলেছে ব্রিটেনের বন্দরগুলোতে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে ব্রিটিশ জাহাজগুলোতে প্রায় ৫২ হাজার ভারতীয় লস্কর কর্মরত থাকার খবর পাওয়া যায়ম যাদের মধ্যে আবার সিংহভাগই বাঙালি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও হাজার হাজার বাঙালি লস্কর ব্রিটিশ জাহাজগুলোতে কর্মরত ছিল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া নেভিগেশন কোম্পানি, পিঅ্যান্ডও এবং আরো কয়েকটি ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানি তাদের নিয়োগ দিয়েছিল। এই লস্করেরা বিশেষত ভারত মহাসাগরে, অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্ড নিউজিল্যান্ড আর্মি কর্পসের সদস্য হিসেবে এবং এডেন বন্দরের যুদ্ধে অংশ নিয়েছে।