যেভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ডাচ স্পাই হয়েছিলেন অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন
নেদারল্যান্ডসে বড় হওয়া এক কিশোরী হিসেবে অস্কারজয়ী অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ডাচ প্রতিরোধ বাহিনীর জন্য বার্তা বহন করেছিলেন।
বিবিসি রেডিও ৪-এর পডকাস্ট "ইন হিস্ট্রি'জ ইয়াংগেস্ট হিরোজ"-এ নিকোলা কফলান সাহসী তরুণদের অসাধারণ গল্প তুলে ধরেন। তিনি দেখান, কীভাবে তারা বিদ্রোহ, ঝুঁকি এবং তারুণ্যের শক্তি দিয়ে ইতিহাস বদলেছে।
এই পডকাস্টের সর্বশেষ পর্বটি ছিল অড্রে হেপবার্নকে নিয়ে। তিনি ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে সিনেমা এবং ফ্যাশনের আইকন হয়ে উঠেছিলেন। পাঁচবার অস্কারের জন্য মনোনীত হওয়া এই অভিনেত্রী ১৯৫৩ সালে 'রোমান হলিডে' সিনেমার জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছিলেন।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কিশোরী অড্রের ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি গোপনে ব্যালে নৃত্য পরিবেশন করতেন এবং তা থেকে সংগৃহীত অর্থ ডাচ প্রতিরোধ বাহিনীর কাজে লাগত।
অড্রে হেপবার্ন ১৯২৯ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা এলা ভ্যান হেমস্ট্রা ছিলেন একজন ডাচ ব্যারোনেস [আভিজাত্যপূর্ণ পরিবারের সদস্য বা সমাজে উচ্চ পদমর্যাদার অধিকারী] এবং বাবা জোসেফ হেপবার্ন-রাসটন ছিলেন ব্রিটিশ-অস্ট্রিয়ান ব্যবসায়ী। লন্ডনে থাকা অবস্থায় তার বাবা-মা সহিংস ও ইহুদিবিদ্বেষী ব্রিটিশ ইউনিয়ন অব ফ্যাসিস্টস (বিইউএফ)-এর নেতা অসওয়াল্ড মোজলের প্রতি আকৃষ্ট হন।
ভ্যান হেমস্ট্রা নাজি জার্মানির প্রশংসা করে বিইউএফ-এর পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। হেপবার্নের যখন ছয় বছর বয়স, তখন তার বাবা পরিবার ছেড়ে চলে যান। পরে তিনি "বিদেশি ফ্যাসিস্টদের সহযোগী" হিসেবে অভিযুক্ত হন এবং পুরো যুদ্ধকাল ব্রিটিশ কারাগারে কাটান।
অড্রে হেপবার্নের যুদ্ধকালীন জীবনের গল্প নিয়ে রবার্ট ম্যাটজেন "ডাচ গার্ল" বইটি লিখেছেন। ম্যাটজেনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অড্রের ছোট ছেলে লুকা ডটি বলেছিলেন, "ছোট্ট মেয়েটা ছিল খুব মিশুক, হাসতে হাসতে খেলতে খেলতে অভিনয় করত। আমার দাদু তাকে 'মাঙ্কি পাজল' ডাকতেন।"
ম্যাটজেন বলেন, "অড্রের মা মনে করেছিলেন, ইংল্যান্ড আর বিশেষ করে কেন্ট তার মেয়ের জন্য নিরাপদ নয়। কারণ জার্মানদের ফ্রান্স পেরিয়ে ইংল্যান্ডে আক্রমণের ঝুঁকি ছিল।"
ভ্যান হেমস্ট্রা তার মেয়েকে ব্রিটিশ বোর্ডিং স্কুল থেকে বের করে আনেন। তারা নেদারল্যান্ডসে একটি পারিবারিক এস্টেটে চলে যান এবং অড্রে সেখানে একটি নাচের স্কুলে ভর্তি হন। তখন তিনি ডাচ নাম অড্রিয়ানচে ভ্যান হেমস্ট্রা ব্যবহার করতেন [অভিনয় শুরু করার পর তিনি তার পদবি হেপবার্ন রেখেছিলেন]। তার মা তখনও আডলফ হিটলারের প্রশংসা করতেন এবং বিশ্বাস করতেন, হিটলার "তার" দেশ আক্রমণ করবে না।
অড্রে হেপবার্নের নেদারল্যান্ডসের অভিজ্ঞতা নিয়ে তার ছেলে ডটি বলেছিলেন, "হল্যান্ডে চলে যাওয়া মানে বাড়িতে ফিরে যাওয়া ছিল না। সে ডাচ বলতে পারত না। তাকে ডাচ স্কুলে যেতে হয়েছিল, যেখানে সে একটা কথাও বুঝতে পারত না। নতুন বাচ্চারা তাকে উপহাস করত।"
হিটলার ১৯৪০ সালের মে মাসে নেদারল্যান্ডস আক্রমণ এবং দখল করেন। ম্যাটজেন সেই পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, "ইস্টার্ন ফ্রন্ট এমন এক চুল্লির মত ছিল, যেখানে আপনি যতই সম্পদ ঢালার চেষ্টা করতেন, তা কখনোই যথেষ্ট হত না। জার্মানরা সৈন্যদের জন্য খাবার ও কাপড় চাইছিল এবং সবকিছুই নেওয়া হয়েছিল ডাচ এবং অন্যান্য দখলকৃত দেশ থেকে।"
হেপবার্নের চাচা কাউন্ট অটো ভ্যান লিম্বুর্গ স্টিরাম নাজিদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেন। ১৯৪২ সালে একটি প্রতিরোধী গোষ্ঠী রটারডামের কাছে একটি জার্মান ট্রেন উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। যদিও ভ্যান লিম্বুর্গ স্টিরাম এতে জড়িত ছিলেন না, তাকে গ্রেপ্তার করা হয় কারণ তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ নাজি-বিরোধী ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
নাজি এজেন্টরা তাকে এবং আরও চারজনকে বনভূমিতে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করেছিল এবং তাদের মরদেহ বেওয়ারিস কবরে ফেলে দিয়েছিল। হেপবার্ন তার চাচাকে একজন পালক পিতার মতো ভালোবাসতেন এবং তার হত্যার ঘটনায় ভীষণ ব্যথিত হন। ম্যাটজেন বলেন, "এটি একটি জাতীয় ঘটনা হয়ে ওঠে। ডাচ জনগণের জন্য এটি একটি উসকানিমূলক মুহূর্ত ছিল।"
যদিও অড্রের পরিবার অভিজাত ছিল, নাজিরা নেদারল্যান্ডস থেকে খাবার ও সম্পদ সরিয়ে নিতে থাকলে ভ্যান হেমস্ট্রা পরিবার খাবারের অভাবে পড়েছিল। হেপবার্নের যখন ১৫ বছর বয়স, তখন তাকে নাজি শিল্পীদের ইউনিয়নে যোগ দিতে বলা হয়। যোগ না দিলে তার নাচ বন্ধ করতে হবে বলে জানানো হয়। অড্রে নাচ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন।
ডটি তার মায়ের প্রাথমিক ভালোবাসা সম্পর্কে বলেন, "নাচের মাধ্যমে তিনি স্বপ্ন দেখতে পারতেন, উড়তে পারতেন, ভুলে যেতে পারতেন। এটি ছিল তার বাস্তবতা থেকে পালানোর উপায়।"
হেপবার্ন একটি নিরাপদ বাড়িতে, জানালা বন্ধ করে এবং একটি মোমবাতির আলোতে নাচতেন, যাতে তাকে কেউ দেখতে না পায়। যখন তিনি পারফর্ম করতেন তখন পিয়ানো খুব হালকাভাবে বাজানো হতো। কিন্তু কোনো তালি দেওয়া যেত না। শো-এর শেষে প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য টাকা সংগ্রহ করা হতো।
ব্যালেরিনা থেকে স্পাই
১৯৪৪ সালের বসন্তে হেপবার্ন হেনড্রিক ভিসার 'ট হুফট নামে একজন চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। হেনড্রিক ডাচ রেজিস্ট্যান্সের [ডাচ প্রতিরোধ] সদস্য ছিলেন এবং হেপবার্ন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তার সহকারীর কাজ বেছে নিয়েছিলেন। যদিও হেপবার্নের মা নাজিদের সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, ডা. হেনড্রিক নাজিদের থেকে লুকিয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। তিনি হেপবার্নকে বিশ্বাস করেছিলেন এবং তাকে সাহায্য করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
১৯৪৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর হেপবার্ন গির্জায় ছিলেন। হঠাৎ ইঞ্জিনের শব্দে গির্জার গীত থেমে যায়। মিত্র বাহিনীর অপারেশন মার্কেট গার্ডেন শুরু হয়। এই ওপারেশনের লক্ষ্য ছিল, রাইন নদীর ওপর নয়টি সেতু দখল করা। হেপবার্ন বাইরে দৌড়ে গিয়ে আকাশের দিকে তাকান এবং দেখতে মান, মিত্র বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য প্যারাশ্যুটে করে নেমে আসছেন।
দুর্ভাগ্যবশত, দুটি ভারী সুরক্ষিত নাজি ডিভিশন সেই এলাকায় এসে পৌঁছেছিল। নাজি ট্যাংকগুলো ভ্যান হেমস্ট্রার বাড়ির সামনে চলে আসে। হেপবার্ন এবং তার পরিবার সেলারে [মাটির নিচের ঘর] লুকিয়ে পড়ে। নয়দিন ধরে যুদ্ধ চলে। শেষে তারা বের হয়ে আসে এবং জানতে পারে নাজিরা বিজয়ী হয়েছে। তিনি একটি ভবন থেকে চিৎকার শুনেন, যেখানে নাজিরা ডাচ রেজিস্ট্যান্সের সদস্যদের অত্যাচার এবং হত্যা করছিল।
যখন জার্মানির দিকে যাওয়া মিত্র বাহিনীর বিমানগুলো জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হয়, ডা. হেনড্রিক হেপবার্নকে একটি গোপন বার্তা ও কোড শব্দ নিয়ে একজন ব্রিটিশ প্যারাট্রুপারের সাথে দেখা করতে বনে পাঠান। হেপবার্ন ওই প্যারাট্রুপারের সাথে সফলভাবে দেখা করেন। কিন্তু ফিরতি পথে ডাচ পুলিশের সাথে তার দেখা হয়ে যায়। তিনি বুনোফুল সংগ্রহ করার অভিনয় করেন পুলিশের সামনে। তারা মুগ্ধ হয়ে তাকে আর প্রশ্ন করেনি। এরপর, তিনি প্রায়ই রেজিস্ট্যান্সের জন্য বার্তা পৌঁছে দিতেন।
"তিনি বিশ্বাস করতেন, সঠিক ও ভুলের মধ্যে এক যুদ্ধ আছে এবং আপনাকে একটি পক্ষ নিতে হবে," ডটি বলেন।
ম্যাটজেন বলেন, "জার্মানরা শিশুদের গুরুত্ব দিত না। 'চল, সরে যাও, ছোট্ট বাচ্চা,' এই ধরনের কথা বলত। ডাচরা যথেষ্ট বাস্তববাদী ছিল এবং দেখতে পেয়েছিল, শিশুরা কিছুটা সন্দেহের বাইরে ছিল এবং তারা সেই বার্তাগুলো নিয়ে যেতে পারত, রেজিস্ট্যান্সের জন্য জরুরি কাজগুলো করতে পারত। আর শিশুরা এটা পছন্দ করত। এটি রোমাঞ্চকর ছিল, বিপজ্জনক ছিল এবং তারা রেজিস্ট্যান্সের নায়ক হয়ে উঠেছিল।"
১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদ্যের অভাবে প্রতি সপ্তাহে ৫০০ ডাচ মানুষ মারা যাচ্ছিলো অন্যান্য অনেকের মতো হেপবার্ন এবং তার পরিবারও তীব্র খাদ্যের অভাবে ভুগছিল। তিনি রক্তস্বল্পতা, জন্ডিস এবং এডিমায় আক্রান্ত হন।
সামনে যুদ্ধ অব্যাহত থাকলেও, হেপবার্ন এবং তার পরিবার তিন সপ্তাহ সেলারে লুকিয়ে থাকেন। অবশেষে ১৯৪৫ ১৬ এপ্রিল শান্তি নেমে আসে । তিনি তামাকের গন্ধ পেলেন, যা যুদ্ধকালে নেদারল্যান্ডসে পাওয়া অসম্ভব ছিল। তিনি সেলার থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন এবং দরজা খুলে দেখলেন, পাঁচজন কানাডিয়ান সৈন্য সিগারেট খাচ্ছে এবং তার দিকে মেশিন গান তাক করে আছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করেন। একজন চিৎকার করে বলেন: "আমরা শুধু একটা শহর মুক্ত করিনি, আমরা একটি ইংরেজ মেয়েও মুক্ত করেছি!"
পরে হেপবার্ন তার ছেলেকে বলেছিলেন, তিনি কখনও তার মায়ের ফ্যাসিবাদী মনোভাবের জন্য তাকে মাফ করেননি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি লন্ডনের ব্যালে রাম্বার্টে স্কলারশিপ পান। যদিও তিনি প্রতিভাবান ছিলেন, তার শারীরিক অবস্থার কারণে ব্যালে নৃত্যশিল্পী হওয়ার মতো সহনশক্তি ছিল না। এরপর তিনি অভিনয়ে চলে আসেন। ওয়েস্ট এন্ড থিয়েটার এবং "দ্য ল্যাভেন্ডার হিল মোব" সিনেমায় ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন।
১৯৫৩ সালে তিনি "রোমান হলিডে"-তে প্রথম প্রধান চরিত্র পান। এটি ব্যাপক সাফল্য লাভ করে এবং ওই ছবির জন্য তিনি অস্কার পান। পরবর্তীতে তিনি এমি, গ্র্যামি এবং টনি পুরস্কারও পান। পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে তিনি সমাজসেবামূলক কাজ চালিয়ে যান, বিশেষ করে ইউনিসেফ-এর জন্য 'গুডউইল অ্যাম্বাসেডর' হিসেবে। ১৯৯৩ সালে তিনি মারা যান।
মাটজেন বলেন, "যুদ্ধ এবং যা কিছু নিয়ে তার অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা হেপবার্নের অন্তর্নিহিত অনুভূতিকে সূক্ষ্ম করে তোলে এবং তাকে বিভিন্ন চরিত্রে প্রবেশের জন্য অভিজ্ঞতা দেয়।"
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়