এরাই বাংলাদেশের ড্রাগন!
ইন্দোনেশিয়ার 'কমোডো ড্রাগন' কিংবা মেক্সিকোর মরু অঞ্চলের 'গিলা-মনস্টার' পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত প্রাণী। এদেরকে কল্পিত প্রাণী ড্রাগনের বংশধর বলে মনে করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রচারমাধ্যমগুলো নিয়মিত এদের ছবি ও সংবাদ প্রচার করে থাকে। আমাদের দেশের টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা মোবাইল স্ক্রিনে প্রায়ই ওদের ছবি ভেসে ওঠে। দর্শক আর লোকজন চোখ বড় বড় করে ড্রাগনের বংশধরদের দেখে। অথচ অনেকেই জানে না যে, কমোডো ড্রাগনের মতো শক্তিশালী আর গিলা মনস্টারের মতো সুন্দর প্রাণী আমাদের বাংলাদেশেও আছে।
আমাদের দেশে মোট তিন প্রজাতির গুই সাপ রয়েছে। এখনো পর্যন্ত দেশের প্রায় সকল অঞ্চলেই যাকে কম বেশি দেখা যায় সে হচ্ছে কালো গুই (Bengal Monitor)। আঞ্চলিক ভাষায় অনেকে গুইল বলেও ডাকে। কালো গুই সাধারণত পাঁচ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এরা খুব শান্ত স্বভাবের সরীসৃপ। ধীর গতিতে চলাচল করতে পছন্দ করে। গ্রামের বসতবাড়ির আশপাশেই এরা বসবাস করতে পছন্দ করে। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে ব্যাঙ, ছোট কাঁকড়া, সাপ, কেঁচো ইত্যাদি। সুযোগ পেলে কৃষকের বাড়ির পোষা মুরগির বাচ্চাও এরা শিকার করে থাকে। কালো গুইদের একটি বিশেষ প্রিয় খাদ্য হচ্ছে ডিম। মুরগির ডিম থেকে সাপের ডিম সবই এদের কাছে অতি উপাদেয় খাদ্য। প্রায় সময় এরা গর্ত খুঁড়ে সাপের ডিম খেয়ে ফেলে। এজন্য গ্রামের মানুষ কালো গুইদের বেশ পছন্দ করে। অনেকেই মনে করে বাড়ির আশপাশে কালো গুই থাকলে সাপের আক্রমণ থেকে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যায়। তাদের এ ধরনের ধারণা অবশ্য অনেকাংশেই সত্য।
কালো গুইদের আরো একটি বিশেষ খাবার হচ্ছে সব ধরনের জীবজন্তুর মৃতদেহ। পরিবেশের পরিষ্কারক হিসাবে এজন্য এদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।
শীতকালে প্রকৃতির বুকে এদের খুব একটা দেখা যায় না। অন্যান্য সরীসৃপের মতো এ সময়টাতে এরাও দুর্বল হয়ে পড়ে। দীর্ঘ সময়ের জন্য মাটির গর্ত অথবা গাছের কোটরে আশ্রয় নেয়। তবে শীতের দাপটে এরা সাপের মতো এতটা দুর্বল হয়ে পড়ে না। প্রতিদিন রোদের তাপ কিছুটা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এরা গাছের কোটর কিংবা মাটির গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসে। যেকোনো খোলা স্থানে মড়ার মত পড়ে থেকে রোদ পোহাতে থাকে। তখন হাবভাব দেখে মনে হয় খাবারের চাইতে একটু রোদের তাপ তাদের দেহের জন্য বেশি দরকারি।
আগেই বলেছি, এরা খুব শান্ত স্বভাবের প্রাণী। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরা ভয়ংকর হয়ে ওঠে, এবং অবশ্যই তা আত্মরক্ষার খাতিরে। কালো গুইয়ের একমাত্র প্রধান শত্রু হচ্ছে কৃষকের পোষা কুকুর। এদের দেখামাত্র কুকুরগুলো তাড়া করে ছুটে আসে। তখন আত্মরক্ষার খাতিরে বাধ্য হয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে তারা। দাঁত কিংবা নখ দিয়ে নয়, ওরা প্রতিরোধ আর আক্রমণ গড়ে তোলে লেজ ব্যবহার করে। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চাবুকের মতো সপাং সপাং শব্দে লেজ চালায় ওরা। ওদের লেজের তীব্র আঘাতে প্রায়ই কুকুরের চোখ-মুখ রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। এই অসম যুদ্ধে প্রায় সময়ই কুকুরদের জয় হয়। কিন্তু তাদের দেহের বিভিন্ন স্থানে লেগে থাকে কালো গুইয়ের লেজের আঘাতের চিহ্ন।
কালো গুই সাধারণত মাটির গর্ত অথবা উইপোকার ঢিবিতে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ২০ থেকে ৩০টি। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে অনেক সময় লাগে। ডিম পাড়ার সাত-আট মাস পর ডিম ফুটে বাচ্চা বেরিয়ে আসে।
আমাদের দেশে খুব সুন্দর এক প্রজাতির গুইসাপ রয়েছে। এদের কেউ বলে সোনা গুই, কেউ বলে হুন গুইল আবার কেউ ডাকে হলুদ গুইল বলে। তবে এরা সোনা গুই নামেই বেশি পরিচিত। ইংরেজিতে এদের বলা হয় Yellow monitor, অনেকে Golden monitor নামেও ডাকে। দেশের প্রকৃতি থেকে সোনা গুইদের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পেতে চলেছে। আকারে কালো গুইদের চাইতে কিছুটা ছোট। সোনা গুইদের স্বভাব কালো গুইদের ঠিক বিপরীত। কালো গুইরা যেমন কৃষকের বাড়ির আশপাশে অবস্থান করে, তেমনি সোনা গুইদের অভ্যাস হচ্ছে লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করা। ওরা বেশ চঞ্চল প্রজাতির সরীসৃপ। এরা জলাভূমির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করে। ডুব সাঁতারে ভীষণ দক্ষ। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পানির নিচে অবস্থান করতে পারে। মাছ, কাঁকড়া, ব্যাঙ ও অন্যান্য ছোট ছোট জলজ প্রাণী এদের প্রিয় খাদ্য। অন্যান্য গুই সাপের মতো এরা গাছে ওঠা তেমন একটা পছন্দ করে না। রেগে গেলে ভয়ংকর ফোঁসফোঁস শব্দ করে ওঠে, অনেকটা গোখরো সাপের মত।
আমাদের সোনা গুই দৈহিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে মেক্সিকোর গিলা মনস্টারের চাইতে কোনো অংশে কম নয়। তবে এরা গিলা মনস্টারের মতো বিষাক্ত নয়।
জলাশয়ের ধারের বড় কোনো গাছের গুঁড়ি অথবা মাটির গর্ত হচ্ছে এদের ডিম দেয়ার নিরাপদ স্থান। শীত শুরু হওয়ার কিছুকাল আগে তারা ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ১০ থেকে ২২টি পর্যন্ত। ডিমের খোসাগুলো বেশ নরম। কালো গুইদের মতো এদের ডিম ফুটতেও সময় লাগে সাত থেকে আট মাস।
আমাদের দেশের তিন প্রজাতির গুই সাপের মধ্যে সবচেয়ে বড় গুই সাপের নাম হচ্ছে রামগদি (Water monitor/Ring lizard) সুন্দরবনসহ দেশের উপকূলীয় দ্বীপসমূহে এদের দেখতে পাওয়া যায়। দৈর্ঘ্যে এরা কমোডো ড্রাগনের চাইতে কোনো অংশে কম নয়। একটি পূর্ণবয়স্ক রামগতি সর্বোচ্চ ১২ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। তবে এদের দেহ কোমোডো ড্রাগনের মতো ভোঁতা আকৃতির নয়, কিছুটা সরু ধরনের। এরা সর্বভুক প্রাণী। বিশাল আকৃতির দেহ নিয়েও এরা চমৎকার গাছ বাইতে পারে। বড় গাছের কোটর এদের নিরাপদ আশ্রয়। এদের প্রজনন ঋতু শুরু হয় বর্ষার প্রারম্ভে। গাছের কোটরে কিংবা মাটিতে গর্ত খুঁড়ে এরা পনেরো থেকে বিশটি ডিম পাড়ে। রামগদিদের ডিম ফোটে নয় মাসে।
গুই সাপের চামড়ার রয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি। এই চামড়ার লোভে যুগের পর যুগ মানুষ এদের হত্যা করে এসেছে। একসময় খোলা বাজারে বিক্রি হতো গুইসাপের চামড়া, টাকার লোভ অনেকে গুই সাপের চামড়া সংগ্রহকে জীবিকা হিসেবে চিনেছিল। এই গুইসাপ শিকারিদের হাতে সবচেয়ে বেশি মারা পড়ত কালো গুই। আশির দশকে, গুইসাপ শিকারিদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল গ্রামের সাধারণ মানুষ। কারণ কালো গুই ওদের কাছে উপকারী এক প্রাণী। বিষাক্ত সাপের ডিম খেয়ে ওরা সাপের বৃদ্ধি রোধ করে। তখন হাজার হাজার গুই সাপের মৃত্যুর কারণে বেড়ে গিয়েছিল বিষাক্ত সাপের সংখ্যা। গ্রামের মানুষ এটা বুঝতে পেরে গুইসাপ শিকারিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের মুখে গুইসাপ শিকারিরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবে গোপনে চলে গুইসাপের চামড়া সংগ্রহের অপতৎপরতা।
বর্তমান সময়ের সমতল এবং উপকূলীয় অঞ্চলের গুইসাপসমূহ কোনোমতে টিকে থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এদের বেঁচে থাকা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে গুইসাপের মাংস অতি প্রিয় খাদ্য। সমতল অঞ্চলে বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইন বেশ কঠোরভাবে পরিচালিত হলেও, পার্বত্য অঞ্চলে তা অনেকটাই অকার্যকর। বান্দরবান, রাঙ্গামাটি আর খাগড়াছড়ির অনেক হোটেলেই আজও গুইসাপের রান্না করা মাংস বিক্রি করা হয়। পার্বত্য অঞ্চলে বাংলাদেশের ড্রাগনদের এই দুরবস্থা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। এ বিষয়ে অবশ্যই বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।